চিত্রকল্প রচনায় সংস্কৃত কবি বাণভট্ট অদ্বিতীয়। সংস্কৃত সাহিত্যের বাঁধাধরা চিরাচরিত উপমামণ্ডলীও গণ্ডীরেখা তিনি দুঃসাহসের সঙ্গে অনেকদূর অতিক্রম করে গিয়েছেন। এদিক থেকে বিচার করলে বাণভট্ট সংস্কৃত সাহিত্যে most unconventional poet যেমন most unconventional dramatist হলেন শূদ্রক। অন্তগামী জীৰ্ণরশ্মি বৃদ্ধ সূর্যের গায়ে তিনি পারাবতের পায়ের পাটল রং মাখিয়ে দিয়েছেন-“পারাবত-পাদ-পাটলিয়াগো রবিরস্বরতলাদলম্বত’। জীবনানন্দ দাস বাংলা কবিতার চিত্র বিতানে যে ধূসর রংএর আধিপত্যসৃষ্ট করেছিলেন, বাণভট্টের কাব্যে সেই ধূসরিমা আধিপত্যের দাবি করেননি, কিন্তু কখনো কখনো এমন একটি নিটোল আবহমণ্ডল সৃষ্টি করেছে যার মোহ পাঠককে অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। রাত্রি শেষের আকাশে কয়েকটি পাণ্ডুর তারকা মাত্র অবশিষ্ট আছে, প্ৰভাত-কালীন নবজন্মের পূর্বে এই মৃত্যুবিলীন জরাগ্রস্ত আকাশের নির্বিড় রিক্ততাকে বাণভট্ট প্রকাশ করলেন বৃদ্ধ পারাব্বতের ডানার ধূসরবর্ণে-“অল্পাবশেষপাণ্ডুতারকে জরৎপারাবতপক্ষধূসারে নভসি)। অসামান্য শব্দধ্বনির ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ সমাসগুলি সমুদ্রের তরঙ্গের মত গড়িয়ে চলেছে, তারি মধ্যে ব্যঞ্জনগম্ভীর অফুরন্ত চিন্ত্ৰৈশ্বৰ্য্য ছড়িয়ে পড়েছে। কলমকে তুলির মত ব্যবহার করতে বাণভট্টের দোসর নেই। এবিষয়ে রবীন্দ্ৰনাথই সর্বপ্রথম পাঠকসমাজকে দৃষ্টিদান করেছেন। আলঙ্কারিকদের অতিশয়োক্তি মূলে না। থাকলে বানভট্টের এই চিত্রগুলিও কিন্তু ঐশ্বৰ্য্যমণ্ডিত হত না।
মনে হতে পারে। আধুনিক কবি ও পাঠক বাহুল্যপক্ষপাতী নন। যন্ত্রনির্ভর সমাজ-জীবনে কাজের তাগিদে উর্ধর্বশ্বাসে ধাবমান মানুষের কাছে সাজের বাহুল্য বর্জনীয়, ভাষার আতিশয্যেরও সময় নেই। আমাদের প্রাচীন অট্টালিকাগুলিতে গম্ভীর স্তম্ভগুলি যে নিষ্প্রয়োজন সৌন্দর্যের আতিশয্য সৃষ্টি করত তাকে ছাঁটাই করে architecture এখন functional হয়ে উঠেছে। কাব্যসাহিত্যে ভাষা-ব্যবহারেও লক্ষ্যে বা অলক্ষ্যে, জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে কলা দেবীও functional হয়ে উঠেছেন। সরস্বতী দেবী হলেও মহিলা। functional art পরিধান-কলায় প্রযুক্ত হয়ে fashionable মহিলাদের অঙ্গবাসকে প্রায় বক্ষোবাসে এনে দাঁড় করিয়েছে। দেবী সরস্বতীও এ যুগধর্মকে উপেক্ষা করতে পারেন না। তাই সারস্বত-সজ্জাকেও যথাসম্ভব বাহুল্যবজিত হতে হবে। অবশ্য আধুনিক বাংলা উপন্যাসের সুদীর্ঘ ক্লান্তিকর পাঁচালী ও কড়চা এই নূতন সারস্বত বিধিকে মেনে নেয়নি। মেনে নিয়েছে। বোধ হয় বাংলা কৰিতা। এখন মনে হচ্ছে উচ্চাঙ্গ গণিতের ফরমুলা সাজিয়েও বোধ হয় কবিতা তৈরী করা সম্ভব।
যারা সব চেয়ে বৈষয়িক তাদেরই বোধ হয় বাহুল্য বর্জনে সব চেয়ে বেশী উৎসাহ থাকা উচিত ছিল। ব্যবসায়ীদের মত বৈষয়িক বোধ হয় আর কারুর নেই। কাজ হাসিল করার দিকে একাগ্র তাদের দৃষ্টি। কত অল্প খরচে কত বেশী কাজ হাসিল করা যায় এবিষয়ে তারা খুবই সতর্ক। তবু দেখুন সরকার যখন বিজ্ঞাপনের খরচ কমাবার প্রস্তাব করলেন তখন শুধু খবরের কাগজের মালিকরাই নন, শুধু বিজ্ঞাপনী এজেন্সীগুলিই নয়, মূল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলিও ঘোর আপত্তি তুলল। আপনার আমার কাছে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনগুলি কৌতুকাবহ বাহুল্য ছাড়া আর কিছুই নয়। বোর্ণভিটার মালিক চান আমরা যেন বোর্ণভিটা কিনে খাই । খবরের কাগজে একদিন একটা অনুরোধ জ্ঞাপক নোটিস দিলেই চলত। কিন্তু কাগজের অৰ্দ্ধেক পাতা জুড়ে কি বিপুল কাণ্ড। দুটো চাকার উপর একটা বোর্ণভিটার পিঁপা দাঁড়িয়ে আছে । তার ওপর দাড়িয়ে আছে এক পালোয়ান । এক হাতে কাপ থেকে গরম ধোঁয়া উড়ছে। আর এক হাতে চারটা লাগাম দিয়ে দূরে চারটা মহাতেজী বেয়াড়া ঘোড়াকে বাগ মানাচ্ছে। এই অতিশয়োক্তির তাৎপৰ্য কি ? –বোর্ণ ভিটা কিনে খাও । এই বিজ্ঞাপনাবাগীশ ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বোধ হয় আমাদের প্রাচীন পূর্বমীমাংসক দার্শনিকদের শ্রেষ্ঠ উত্তরসাধক। পূর্বমীমাংসাদর্শনে বিধি আর অর্থবাদ নিয়ে প্ৰকাণ্ড বিচার চলেছে। বিধি মানে কোন কাৰ্য্যে প্রবৃত্তিজ্ঞাপক বৈদিক নির্দেশবাক্য-যেমন, বায়ু দেবতাকে শ্বেত ছাগ বলি দাও। এটাই আসল বক্তব্য। এই বিধিবাক্যগুলিই স্বতন্ত্র প্রামাণিক বাক্য। তারপর আছে বায়ুদেবতার মাহাত্ম্যাবর্ণনামুখর মন্ত্রবাক্য। এই স্তুতিমাহাত্ম্যময় মন্ত্রবাক্যগুলিকে বলা হয়। অর্থবাদ । এখন বিচার চলল, এই অর্থবাদ-বাক্যগুলি প্রমাণ কি অপ্রমাণ ? পূর্বপক্ষ বললেন, এগুলির প্রামাণ্য নেই। কারণ, এদের মধ্যে অনেক আজগুবি, অবিশ্বাস্থ্য, অসম্ভব, পরস্পরবিরোধী অতিশয়োক্তি আছে। উত্তরপক্ষ সিদ্ধান্ত করলেন- এই অর্থবাদ বাক্যগুলির স্বতন্ত্র প্রামাণ্য নেই একথা ঠিক, তাই বলে এগুলি অপ্ৰমাণ নয়। বিধিবাক্য-নির্দিষ্ট কর্তব্যকর্মে প্রবৃত্ত করতে এই অতিশয়োক্তিগুলি সাহায্য করে। তাই বিধিবাক্যের সঙ্গে একার্থিতা-প্ৰাপ্তির দ্বারা অর্থবাদ-বাক্যেরও প্রামাণ্য স্বীকার করা যেতে পারে। বিধিবাক্যই প্ৰধান। চাপরাসীর চাপরাসে যেমন মালিকেরই মহিমা প্ৰতিফলিত হয়ে চাপরাসীকেও কিছুটা মৰ্যাদা দান করে, অতিশয়োক্তিরূপী অর্থবাদ-বাক্যও তেমনি স্বপ্ৰধান বিধিবাক্যের মাহাত্ম্য থেকে কিছুটা গৌরব ধার করে প্রামাণ্য লাভ করে।