প্রাচীন ঔপনিষদিক যুগের মানবিক গৌরবকে ফিরিয়ে এনে বর্তমানকে উদ্ধৃদ্ধ করতে গেলে কিঞ্চিৎ বিপদের সম্ভাবনাও আছে। বিবেকানন্দ Hindu Revivalism-এর মারফত জগতশুদ্ধি ও জাতিশুদ্ধির চেষ্টা করেছিলেন। এই শুদ্ধি-পদ্ধতিতে প্ৰাচীনযুগের মানবধর্মী গৌরবদীপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তার রহস্যঘন অধ্যাত্মবাদের কুজ্বাটিকাকেও আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসার আশংকা থাকে। বিবেকানন্দের মানবধর্মও তাই অধ্যাত্মবাদের কুয়াসা থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
কিন্তু রাজশক্তি, বিত্তশক্তি ও মোহন্ত শক্তি যে চেষ্টাই করুক না কেন, নিপীড়িত লাঞ্ছিত মানুষের বিবেকবাণী যে বীর সন্ন্যাসীর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল তার প্রদীপ্তমূর্তিকে শংকর-বেদান্তের ধূম্রমায়ায় চিরদিন আবৃত রাখা যাবেনা। দেশের মানুষ মানুষ-বিবেকানন্দকে খুঁজে বের করবে—যে মানুষ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রান্তসন্ধ্যায় দ্বিধাহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন–‘আসন্ন শূদ্রবিপ্লবের পদধ্বনি আমি শুনতে পাচ্ছি। সে আসবেই, কেউ তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।’
পৃথিবীর এক বিরাট অংশ জুড়ে সে বিপ্লব আজ এসে গেছে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেই দেশের শূদ্র জনসাধায়ণ ব্ৰাহ্মণের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের ক্ষমতা ও বৈশ্যের সম্পদশক্তিকে আয়ত্ত করে তাকে অতিক্রম করে চলে গেছে। শূদ্র-বিপ্লবের ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা-প্রতিষ্ঠিত হবার পরও যদি মানুষ কোনও রহস্যময় ঈশ্বরের কাছে আত্মসম্পর্পণের প্রয়োজন অনুভব করে, তাহলে তাই করবে। কিন্তু সে বিপ্লব, সে সমাজতন্ত্র আগে আসুক। এওত হতে পারে, শোষণহীন পৃথিবীতে সকল মানবিকগুণের অফুরন্ত উন্মেষে চির-ভাস্বর এক ঐক্যবদ্ধ মানবসমাজই তখন ঈশ্বরের স্থান গ্রহণ করবে। সে সমাজ হিরণ্যগৰ্ভ; সেই সহস্রশীর্ষ, সহস্রচক্ষু, সহস্রপাদ বিরাট পুরুষের জ্যোতিতে বিশ্ব জ্যোতির্ময় হবে। উপনিষদের প্রাচীন প্রজ্ঞামন্ত্র যে ঐক্য ও সমগ্রতার কথা ঘোষণা করেছিল। এই পথেই তার চরম সার্থকতা প্ৰমাণিত হবে। আমাদের ভারতবর্ষেও সেদিন যখন আসবে তখন দেশের মানুষ শ্রদ্ধানম কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। সেই বৈদান্তিক সন্ন্যাসীকে যিনি প্রচার করতে চাইলেন শংকরবেদান্ত, কিন্তু ঘোষণা করলেন শোষিত মানুষের মর্মবাণী, আহ্বান জানালেন সাম্যবাদী শূদ্র-বিপ্লবকে।
[বিবেকানন্দের সমাজচিন্তামূলক উদ্ধৃতিগুলি খুঁজে দেখতে ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের “Swami Vivekananda–Patriot Prophet’ গ্রন্থখানি থেকে অনেক সাহায্য পেয়েছি। ডঃ দত্তের গ্রন্থে বিবেকানন্দের গ্রন্থাবলীর যে পৃষ্ঠা নির্দেশ করা হয়েছে তার সঙ্গে আমি যে পৃষ্ঠা নির্দেশ করেছি। তার অসঙ্গতি আছে। কারণ, আমি গ্রন্থাবলীর পরবর্তী সংস্করণগুলি ব্যবহার করেছি।–লেখক।]
ভাষার দর্শন
কথায় বলে বোবার শত্রু নেই, এর কারণ বোধ হয় বোবার সমাজ নেই। মানুষের সমাজে শক্রতা ও একটা সামাজিক সম্বন্ধ। কিন্তু ভাষা ছাড়া কোনো সামাজিক সম্বন্ধই গড়ে উঠতে পারে না। যাত্রাগানে দুই পক্ষ যুদ্ধ করার আগে রৌদ্ররস ও বীররস সৃষ্টি করার জন্য ক্ৰোধোদ্দীপ্ত বীরদর্পিত ভাষণের দ্বারা বেশ কিছুক্ষণ ধরে আসর গরম করে নেয়। তারপর আরম্ভ করে। ঘোরতর যুদ্ধ। তখন সরল হৃদয় শিশুদর্শকের মনে আবিভূতি হয় ভয়ানক রস। কিন্তু উন্ন্যাসিক আধুনিক সেয়ানা দর্শক উপভোগ করেন হাস্যরস। সাহিত্যরসিকের আসরে যাত্রাগান কতখানি রসোত্তীৰ্ণ সে আলোচনা বন্ধ থাক। কিন্তু মনে করা যাক রঙ্গমঞ্চে যুযুৎসু দুইপক্ষের কুশীলবগণ কোনো কথা না বলে কেবল স্থাণুর মতন দাঁড়িয়ে রইল, আর কতক্ষণ পরে হঠাৎ মল্লযুদ্ধ আরম্ভ করে দিল। তখন মল্লযুদ্ধটা মঞ্চের কুশীলবদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। কারণ তাদের রুদ্ধবাক যুদ্ধলীলা দর্শকদের মুখর করে তুলবে, মল্লক্ষেত্রে টেনে আনবে। এখানে কিন্তু বোরারও শত্রু আছে। আসরের দর্শকবৃন্দ ও মঞ্চের কুশীলববৃন্দের একত্ৰ উপস্থিতির পিছনে একটা সুগভীর সামাজিক প্রত্যাশ রয়েছে। একদল আনন্দ দান ক’রে আনন্দ পাবে, আর এক দল আনন্দের দান গ্ৰহণ করবে। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে যদি প্ৰত্যাশিত সম্পর্কের ছেদ ঘটে। তবে স্বভাবতই তার স্থান গ্ৰহণ করবে একটা বিরূপ সম্পর্ক। যাদের কাছে থেকে আশা করা গিয়েছিল অনর্গল ভাষা, তারা যদি অহেতুক এই আশাভঙ্গ ক’রে বোবার মতন ব্যবহার করে, তাহলে এই নকল মৌনের মধ্যে যে উলেক্ষা ও অবজ্ঞা প্রচ্ছন্ন থাকে তাই সৃষ্টি করে তিক্ততা ও শত্ৰুতা। আপাতদৃষ্টিতে ভাষার অভাবটাই এখানে বিরূপতার কারণ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। যারা কথা বলছে না। তারা কথা বলতে জানেনা এটা সত্য বলে মনে করতে পারলে দর্শকরা মারমুখো হয়ে উঠত না। কিন্তু কথা বলার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কথা বলতে পারছে না, অথচ লোক ডাকা হয়েছে কথা শোনাবার জন্য। বিক্ষোভের আসল কারণ তাই। ভাষার অভাবের পিছনে ভাষা বলার এই অপ্ৰযুক্ত ক্ষমতাটাই তিক্ততার কারণ। সংসারে পরমাত্মীয়ও অনেক সময় खङिग्नভরে কথা বন্ধ করে দেয়। এখানেও অভিমান প্ৰকাশের কারণ ভাষার অভাব নয়। কিন্তু অবরুদ্ধ ভাষার পিছনে ভাষা প্রয়োগের ভাবমূলক ক্ষমতাটাই অভিমান প্রকাশের কারণ। অপর পক্ষের পাল্টা অভিমানের পালাটাও এই জন্যেই। বোবা স্বামীর উপর স্ত্রীও অভিমান করে না। কিন্তু বোবাকেও সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে টেনে আনার জন্য ইশারা-ইঙ্গিত ও অঙ্গভঙ্গিমার ভাষা শিক্ষা দেয়া দরকার হয়।