এখন গঙ্গাযাত্রীর বৈরাগ্যবাণীর জগৎটাকে মায়াময় বলি, অথবা সূক্ষ্ণ দার্শনিক অর্থেই মায়াময় বলি, প্রশ্ন থেকে যায় এই মায়াবাদের সার্থকতা কি? বিবেকানন্দ কি এই মায়াবাদ প্রচার করেই ভারতের প্রতি বিশ্বের শ্রদ্ধা আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন। সমগ্ৰ মানব সমাজের মৌলিক একতা, বিদ্বেষমুক্ত এক মানবিক সংহতি, স্বাৰ্থ-গন্ধহীন স্বাভাবিক মানবীয় শুভ বুদ্ধি, মানুষ মূলত: শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত অপাপবিদ্ধ,-ব্যক্তিগত লোভ, অন্যের উপর পীড়ন ও শোষণ মূল মানব প্রকৃতির ব্যভিচার-ঔপনিষদিক সমগ্রতাবাদী দর্শনের এই মানবমুখী ব্যাখ্যা জগতের সামনে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে তুলে ধরতে না পারলে প্ৰাচীন ভারতীয় আদর্শের প্রতি পশ্চিম দেশের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করা সম্ভব হত না।
মায়াবাদের সার্থকতার প্রসঙ্গটি আমরা নিছক ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকেই উত্থাপন করিনি, “বিশুদ্ধ দার্শনিক” দৃষ্টিকোণ থেকেও উত্থাপন করেছি। জগতটা যদি মূলত: মিথ্যাই হয় তবে এই দিব্যজ্ঞান লাভ করা না করায় কার কি আসে যায়, যুক্তিতর্কের দিক থেকেই বা কি হানি হয়? জগতটা মিথ্যা হলে আমার এই দিব্যজ্ঞানে বঞ্চিত হবার ঘটনাটি, আর আপনার এই দিব্যজ্ঞান লাভ করার ঘটনাটি উভয়েই সমান মিথ্যা। আমার ও আপনার সকল বিশ্বাস অবিশ্বাস সবই সমান মিথ্যা। আমি যদি বস্তুজগতটাকে সত্য মনে করে মায়ামোহে ডুবে থাকি, আর আপনি যদি অসত্য মনে করে মায়ামোহ উত্তীর্ণ হয়ে থাকেন, উভয়েরই জ্ঞান-অজ্ঞানের সমান মূল্য। কারণ একমাত্ৰ ব্ৰহ্মই সত্য কি মিথ্যা, জগতটা সত্য কি মিথ্যা তা ত আপনার বা আমার বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের উপর নির্ভর করছে না। এজন্য ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভ করার কোন প্রয়োজন পড়েন। কারণ বিজ্ঞানস্বরূপ ব্ৰহ্ম আমার ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভের উপর নির্ভর করে বসে নেই। তিনি স্বয়ম্ভূ নিজে নিজের মতই আছেন; আপনি কঠোর ব্রহ্মচর্য্য গ্রহণ করে জগতে ব্রহ্মজ্ঞান বিতরণ করুন, আর আমি দিব্যি দুদিন ইন্দ্ৰিয় সুখে মগ্ন থাকি। আপনার বরং বৃথা কষ্ট করাটাই সার। কারণ আপনার কৃচ্ছ্রসাধন আর আমার সুখসম্ভোগ দুই শেষ পর্যন্ত সমানে মিথ্যা। আর যে জগতটাই নেই তাকে উদ্ধার করার জন্য এত প্রচার, আয়োজন, এত গাদায় গাদায় বই লেখা, এত বক্তৃতা, সবই পণ্ডশ্রম। জগৎটা উদ্ধার হল আর নাই হল, জগত যে মিথ্যা, সেই মিথ্যা, ব্ৰহ্ম যে সত্য সেই সত্য। সুতরাং শংকর-বেদান্ত মূলত: non-ethical philosophy, শুধু তাই নয়, এক ধরনের atheistic philosophy-ও বটে। কারণ-শংকর বেদান্তের যুক্তি নৈয়ায়িক নিষ্ঠার সহিত অনুসরণ করলে সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরও মূলত মিথ্যা, ঈশ্বরোপাসনার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। পাপ পুণ্যের ভিতরে, ন্যায় অন্যায়ের ভিতরে তফাৎ করার কোন বাস্তব নিরিখ থাকে না। এর উত্তরে বলা হয়ে থাকে ঈশ্বরোপাসনা ও পুণ্যকর্মের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয়, সেই বিশুদ্ধচিত্তে ব্ৰহ্মজ্ঞান প্ৰতিফলিত হওয়ার সুযোগ হয়। এরও উত্তর আগেই আমরা দিয়ে রেখেছি। নাই বা হ’ল ব্রহ্মজ্ঞান, নাই বা জানলাম তিনি সত্য, নাই বা মানলাম জগত মিথ্যা, যা মিথ্যা তা মিথ্যাই রইল, যা সত্য তা সত্যই রইল। আমার ব্ৰহ্মজ্ঞানী হবার প্রয়োজন নেই। আমি ব্ৰহ্মজ্ঞানী হলেও মুক্ত না হলেও মুক্ত, কারণ আমি নেই, তিনিই আছেন। অথবা আমি, তুমি, তিনি কেউ নেই, কেবল এক “Impersonal It’ মাত্র আছে।
এই বে-কায়দার অবস্থা থেকে পারা পাবার জন্য জগতের একটা ব্যবহারিক সত্তা বা Pargmatic existence এর Coneept আমদানী করা হয়েছে। কিন্তু তাতেই বা যুক্তির দিক দিয়ে লাভ কি হল। ব্যবহারিক সত্তাটাও মূলত মিথ্যা। মনে করুন জগতটা অনাদিকাল ধরে দীর্ঘায়ত একটা স্বপ্ন, আর রাতের স্বপ্নটা ঐ স্বপ্নের অন্তবর্তী একটা হ্রস্ব স্বপ্ন। এখন রাতের স্বপ্ন থেকে “জাগতিক” স্বপ্নটা সত্তা হিসাবে উচ্চতর আসন পাবে কি জন্য? স্বপ্নটা দীর্ঘতর হলেই কি সত্যতার হয়? বিশেষত পরমাৰ্থ ব্ৰহ্মসত্যের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহারিক সত্তাটা যখন মিথ্যা, তখন প্রাতিভাসিক সত্তা ও ব্যবহারিক সত্তার মধ্যে উনিশ-বিশ করার যুক্তি কোথায়? এই পার্থক্যটাও মিথ্যা। এখন তাহলে এই মিথ্যা জগতের মিথ্যা জীবগুলোকে মিথ্যা উদ্ধার করার জন্য এই মিথ্যা হস্ত-প্ৰসারণের প্রয়োজন কি? এই প্রশ্নের মুখে শংকর-বেদান্ত আজ পৰ্যন্ত নিরুত্তর। সব চেয়ে বড় কথা, যে বস্তু-জগতের অস্তিত্বের উপর বাস্তব-বিশ্বাস না রাখলে কোন মায়াবাদী বৈদান্তিকের একটি নিমেষও বেঁচে থাকার উপায় নেই, এক পা চলার শক্তি নেই, একটা কথা মুখ দিয়ে বার করার ক্ষমতা নেই, সেই জগতটাকে একটি ব্যবহারিক সত্তার সুক্ষ্ণ সূতায় ঝুলিয়ে রেখে দায় সারার চেষ্টা করলেও দার্শনিক ভণ্ডামির দায় থেকে অব্যাহতি পাবার উপায় নেই।
তাই বলছিলাম, বিবেকানন্দের শাংকরী মায়া সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তিনি যেখানে মায়ার ব্যাখ্যা করেছেন সেখানে আরও দশজন সংসার-বিবাগীর মতই—ঈশ্বর সত্য, জগত মায়াময় এইটুকু বলেই ছেড়ে দিয়েছেন। মায়াবাদের প্রতি তার অনুরাগটা mysticism-এরই একটা অঙ্গ। যে সামাজিক দৃষ্টিতে শ্রমজীবির সাম্যবাদী সমাজবিপ্লবের ন্যায্যতা ও অবশ্যম্ভাবিতা ধরা পড়েছিল সেই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির সহিত মায়াবাদের কোন সামঞ্জস্য নেই। বিবেকানন্দ আরও এক জায়গায় বলেছেন—“শংকরের বিরাট বুদ্ধি ছিল, কিন্তু বিশাল হৃদয় ছিল না”—(“The Sages of India”)। একথা যখন তিনি বলেছিলেন তখন মায়াবাদ তাকে বিভ্রান্তি করেনি। তাঁর মতে তিনি যেভাবে মায়ার ধারণা করেছিলেন তা আধ্যাত্মিক রহস্যবাদের প্ৰতি একটা অলৌকিক বিশ্বাসের সহোদর।