আর একটা কথা উল্লেখ করা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। অবশ্য রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের গোড়া ভক্তের দল এজন্য এই প্ৰবন্ধ-লেখকের ভিতরে “অৰ্বাচীনের আস্পৰ্দ্ধা” র সন্ধান পাবেন বলে আশংকা আছে। তথাপি একথা স্পষ্ট করেই বলা প্রয়োজন যে শংকরের মায়াবাদের প্রকৃত দার্শনিক-চরিত্র সম্পর্কে বিবেকানন্দের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। শংকর-বেদান্তের বিবেকানন্দকৃতী ব্যাখ্যার ভিতরে যুক্তির চেয়ে আবেগের প্রাবল্য অনেক বেশী। মায়াবাদের তিনি কোথাও বিশেষ বিস্তৃত অর্থ করেন নি, অথচ বেদান্ত সম্বন্ধে সাধারণভাবে তিনি অনেক বক্তব্যই উপস্থিত করেছেন।
“অদ্বৈত-মতে এক বিজ্ঞান স্বরূপ ব্ৰহ্ম জগতের উপাদান কারণ ও নিমিত্তে কারণ, দুইই বটে। ব্ৰহ্ম জগত রূপে অভিব্যক্তি হয়েছে। কিন্তু পরিণত হয়নি; জগত্ নেই, ব্রহ্মই আছে। মায়া সম্পর্কে ধারণা করতে হলে বেদান্তের এই মূলকথাটি বুঝতে হবে।…যা আছে তা শুধু ব্ৰহ্ম, পার্থক্য ও বহুত্ব সবই মায়াকৃত। … … ভারতবর্ষ হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর সকল জাতির কাছে এই challenge জানিয়েছে। ফল হয়েছে, সেই জাতিগুলি সব মুছে গেছে, তোমরা বেঁচে আছ। জগতটা ভ্ৰান্তিমাত্র, সব কিছু মায়া। তুমি নখ দিয়ে মাটি খুঁটেই খাবার খাও বা সোনার থালায় করেই খাও, তুমি প্ৰবল প্ৰতাপশালী রাজচক্রবর্তী হয়ে প্রাসাদেই বাস কর, অথবা তুমি দীনতম ভিক্ষুকই হও, শেষ পরিণতি মৃত্যু, সব সমান, সব মায়া। এই হল বিশ্বের প্রতি ভারতের challenge” (The Vedanta in All its Phases–Lectures from Colombo to Almora, P 323-324) এই উদ্ধৃতির ভিতরে প্রথম অংশটুকু শংকর বেদান্তের একটা মূল কথা বটে, কিন্তু পরে যেভাবে মায়াবাদের ব্যাখ্যার উপসংহার টানলেন—ওগুলো কোনও দার্শনিক কথা নয়। মায়াবাদের স্বরূপ বুঝতে এ কথাগুলি বিন্দুমাত্র সাহায্য করে না। এ জাতীয় মায়াবাদের প্রচার হিন্দুঘরের দর্শনানভিজ্ঞ বৃদ্ধবৃদ্ধার দলও দিনরাত করে থাকেন। “রাজা প্ৰজা ধনী দরিদ্র মৃত্যুতে সব সমান, সংসার মিথ্যা মায়াময়”। এর বেশী আর কিছুই বলা হল না। আর এ কথাটিই যদি বিশ্বের প্রতি ভারতবর্ষের challenge হয়ে থাকে, তবে বিশ্বের পক্ষে এই challenge-এর কোন উত্তর দেবার প্রয়োজন পড়ে না। ভারতবর্ষ অনেকবার নিজের মুমূর্ষু অবস্থার ভিতর দিয়ে নিজেই এর উত্তর দিয়েছে।
শঙ্কর-বেদান্তের অধ্যবসায়ী ছাত্র মাত্রেই জানেন যে মায়াবাদের মূলকথা মায়া বা অবিদ্যার ভাব-রূপতা এবং অনির্বচনীয়তা (Positiveness and Indefinability)। শংকরশিষ্য পদ্মপাদ থেকে আরম্ভ করে ষোড়শ শতাব্দীর মধুসূদন সরস্বতী পৰ্যন্ত কয়েক শ’ বছর ধরে, কয়েক হাজার পৃষ্ঠা ধরে এই অনির্বাচ্যতাবাদের রহস্য উদঘাটন করেছেন। সেই সূক্ষ্ম দার্শনিক বিচারের মধ্যে না গিয়ে ‘সব মায়ার খেলা’ বলে ছেড়ে দিলে কিছুই বোঝা যায় না, challenge তো দূরের কথা। কিন্তু এত পরিশ্রম, এত, কূট তর্কের পরও সার কথাটা এই মাত্র দাঁড়াল—জগতের অস্তিত্ব বা নাস্তিত্ব কোনটাই মুক্তি বা তর্কের দ্বারা, কোন ন্যায়সম্মত ধারণার দ্বারা নিরূপণ করা যায় না; নির্বাচন করা যায় না। সুতরাং জগত অনির্বচনীয়, অথচ একে অভাব বা শুদ্ধ negation বলেও কল্পনা করা যায় না, জগতের প্রতীতিটা ভাবরূপেই হয়ে থাকে। এই অর্থেই জগত মায়াময়। এই ভাবরূপে প্ৰতিভাত, অথচ যুক্তি ও সংজ্ঞার দ্বারা অস্তি বা নাস্তি রূপে অনির্বচনীয় বিশ্বপ্ৰপঞ্চের ভাবনা থেকে যদি একটা abstract principle-এর কল্পনা করা যায়, যা সৎও নয়, অসৎও নয়, সদসৎও নয়, সেই ভাবরূপ অনির্বচনীয়তা সর্বস্ব abostraction-এর নাম দেয়া হয়েছে “মায়া” ভা “অবিদ্যা”—“সদসদ্ভ্যাম্ অনির্বাচ্যা মিথ্যাভূত সনাতনী”। এই অর্থেই জগৎ মিথ্যা। যেহেতু এই অবিদ্যাকে সৎ বা অসৎ অথবা সদসৎ কোনও ভাবেই নির্বাচন করা যায় না, সুতরাং একে ব্রহ্মের অতিরিক্ত একটি দ্বিতীয় সত্তারূপেও দাঁড় করানো যায় না। তাই ভাবরূপ অবিদ্যা স্বীকারের দ্বারা ব্রহ্মের অদ্বৈততত্ত্ব খণ্ডিত হয় না।
অদ্বৈত বৈদান্তিকদের ভিতরে দুর্ধর্ষতম তার্কিক কবি-দার্শনিক শ্ৰীহৰ্ষ “মায়া” সম্পর্কে এই জাতীয় ব্যাখ্যার মধ্যে একধরণের scepticism বা সন্দেহবাদের আশংকা করেই পূৰ্বপক্ষের একটা আপত্তিও সঙ্গে সঙ্গে আশঙ্কা করেছেন—“আপনারা যদি জগতের কোন যুক্তিসিদ্ধ সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে না পারেন, তবে উপযুক্ত আচার্যের কাছে সংজ্ঞা-নির্ধারণ-প্ৰণালীটাি শিক্ষা করে নিন, আপনার ন্যায়শাস্ত্র অনুসারে সংজ্ঞা ঠিক করা যাবে না বলে জগতটা মিথ্যা হয়ে যাবে এমন দাবী করবেন কেন? পূর্বপক্ষ এ আপত্তি তুলতে পারেন। তাদের আমরা অদ্বৈতবাদীরা এই কথাই বলব,–আপনার যারা জগতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন, আপনারাই আপনাদের বিশ্বাস অনুসারে এই অস্তিত্বের লক্ষণটা কি বলুন। আমরা দেখিয়ে দেব কোন লক্ষণই ধোপে টিকবে না। তবে কি জগতের অস্তিত্ব নেই? তাহলে আপনারাই জগতের নাস্তিত্বে লক্ষণ বলুন। আমরা দেখিয়ে দেব তাও সম্ভব নয়। সুতরাং জগতের অস্তিত্ব নাস্তিত্ব নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। আপনাদের যুক্তি অনুসরণ করেই জগতটাকে অনির্বাচনীয় বলছি। যদি আমাদের কথা বলেন, আমরা একটি মাত্রই সত্তা নিয়ে সন্তুষ্ট আছি, সেই এক অদ্বিতীয় বিজ্ঞানস্বরূপ ব্ৰহ্মসত্যের উপর নির্ভর করেই আমরা চরিতার্থ।”।