এটা আমাদের লক্ষ্য করতে হবে যে বিবেকানন্দ ব্ৰহ্মবাদকে শোষণব্যবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারেননি। তাই অন্ততঃ দু’জায়গায় শংকরের হৃদয়হীন সংকীর্ণতার কথা উল্লেখ করেছেন। বুদ্ধের হৃদয় ও শংকরের বুদ্ধির একত্র মিলন হওয়াটাই তার কাম্য ছিল। মূল প্রশ্নটা কিন্তু হৃদয়ের নয়, এ হল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রশ্ন। শুধু হৃদয়ের প্রশ্ন হলে ব্যক্তিগতভাবে পরোপকারের চেষ্টা করে, কতকটা সেবাধর্মের অনুষ্ঠান করে দরদী হৃদয়ের দাবী মেটানো সম্ভব হত। বিবেকানন্দের হৃদয়ের দরদ সমাজটাকে ঢেলে সাজাবার প্রশ্ন নিয়ে আলোড়ির হয়েছিল। প্রশ্নটা তিনি যে কত জোরালো ভাবে তুলেছিলেন তা আমরা আগেই দেখেছি। অবশ্য সমাজের মৌলিক পরিবর্তনের তিনি যে পথ বেছে নিয়েছিলেন সেই মিশন-মার্ক পন্থা কোনদিনই সমাজ-বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারবে না। তিনি সমস্যার সমাধান দিতে না পারলেও সমস্যাটির মূল চরিত্র যে হৃদয় ও বুদ্ধি দিয়ে অনুভব করেছিলেন, বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন সেটাও একটা মস্ত বড় কৃতিত্ব। পরিচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে বলিষ্ঠভাবে কোন একটা মূল প্রশ্ন সমাজের সামনে তুলে ধরাটাও মহতী প্ৰজার পরিচায়ক। বিবেকানন্দ সে কাজ সার্থকভাবেই করেছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রদর্শিত সমাধান-পদ্ধতিটা ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের কুয়াশায় কলুষিত ছিল এ বিষয়ে কোনো বস্তুবাদীর সংশয় থাকা উচিত নয়। এ বিষয়ে শুধু বিবেকানন্দ কেন, ঊনবিংশ শতকের ভারতীয় মনীষার উজ্জ্বলতম পরিণতি যে রবীন্দ্ৰনাথ তার প্রজ্ঞাদৃষ্টিও এই কুয়াশার আবরণকে ভেদ করে বাহির হতে পারেনি, যদিও বিবেকানন্দের তুলনায় রবীন্দ্রনাথের এই আবরণটা অনেক বেশী পাতলা ছিল। পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার জ্ঞানবিজ্ঞানের আলোক-ধারায় স্নান করেও ধারা প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির জ্যোতির্ময় রূপটিকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরে আত্মপ্ৰতিষ্ঠার পথ খুঁজেছিলেন এবং সেই পথেই স্বজাতির ভিতরে আত্মোপলব্ধিপ্ৰদীপ্ত স্বাদেশিকতা উদ্বোধিত করার চেষ্টা করেছিলেন, রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পৰ্যন্ত সেই সকল ভারত পথিকই আধুনিক বুদ্ধিদ্বারা পরিমার্জিত ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের মধ্যে এক পরম প্ৰশান্তি লাভ করেছিলেন। টোলঘরের সংস্কৃত পড়া বিদ্যাসাগরই এই ধারার বিস্ময়কর ব্যতিক্ৰম। আর এদের ভিতরে রবীন্দ্রনাথই অধ্যাত্মবাদকে লোকোত্তর ব্ৰহ্মলোক থেকে টেনে এনে মানব-সমাজের সামগ্রিক রূপের মধ্যে এক বৃহত্তম মানবিকতাবোধের সঙ্গে একাত্ম করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এখানে বিবেকানন্দের দার্শনিক দৃষ্টির সামনে সব চেয়ে বড় বাধা ছিল শংকরের মায়াবাদ। এ বাধা তিনি অতিক্রম করতে পারেন নি। তাঁর সমাজ দর্শনে তিনি যে ঔপনিষদিক ঐক্য ও সমগ্ৰতাবোধকে তুলে ধরেছিলেন তার সঙ্গে মায়াবাদের যে একটা মৌলিক দার্শনিক অসঙ্গতি আছে একথা তিনি স্বীকার করতে রাজী ছিলেন না। কিভাবে তিনি কষ্টকল্পিত সঙ্গতির চেষ্টা করেছিলেন আমাদের প্রবন্ধের প্রারম্ভে উদ্ধৃত চিঠিখানির উপসংহারই তার প্ৰমাণ। শ্রমজীবির বিপ্লবের দ্বারা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার পর মানুষ বুঝতে পারবে সমাজ সংসার সব মিথ্যা, ঈশ্বরই একমাত্র সত্য। তখন ঈশ্বরানুভূতির দরজায় গিয়ে মানুষকে ধর্ণা দিতে হবে। এই সত্যোপলব্ধির জন্যও তাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে মানুষকে যেতে হবে। মানুষকে সবরকম অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে বুঝতে দেয়া হোক, শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর ছাড়া গতি নেই। তাঁর বিচারবুদ্ধি ছিল বিজ্ঞানধর্মী ও মানবধর্মী, সমাজ-বাস্তবের বিশ্লেষণে তাই তিনি আধুনিক সত্যদৃষ্টির পথে অনেকদূর অগ্রসর হতে পেরেছিলেন, কিন্তু হৃদয়টি ছিল দ্বিখণ্ডিত। নিপীড়িড় মানুষের মর্মবেদনায়, সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতিবাদে প্রচণ্ড বিক্ষোভে এই হৃদয় উদ্বেলিত হত, আর একদিকে অলৌকিক অনুভূতির উপর গভীর বিশ্বাস, শংকর-বেদান্তের প্রতি প্ৰগাঢ় অনুরাগ ঐ একই হৃদয়কে এক লোকোত্তর প্রশান্তির কোলে টেনে নিয়ে যেত—শেষ পর্য্যন্ত সব মিথ্যা, সবই মায়া। শংকর-প্রদর্শত অধ্যাত্মবাদই ভারতের সব চেয়ে বড় ঐতিহ্য। এই অধ্যাত্মবাদের পুনরুজ্জীবনের দ্বারাই মানুষের চরম মুক্তি সম্ভব হবে এ বিশ্বাস তিনি ছাড়তে পারেন নি। দেশবিদেশে বৈপ্লবিক প্ৰচেষ্টার সাময়িক বিফলতা, ভারতবর্ষের সমাজজীবনের গ্লানিময় পরিবেশ, বৃটিশ শাসনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ফলহীন নিরুপায় প্ৰতিবাদ, নিপীড়িত শ্রেণীর মধ্যে ঐক্য ও সংহতির অভাব, শ্রমজীবি মানুষের আত্মিক ও নৈতিক চরিত্রের সীমাহীন দুর্বলতা এ সব কিছু মিলিয়ে তার হৃদয়ে মাঝে মাঝে হয়ত এমন এক হতাশার সৃষ্টি করত যার ফলে মায়াবাদকে আরও বেশী করে আঁকড়ে ধরার এক বিপরীত প্রেরণা তিনি আরও বেশী করে অনুভব করতেন। রামকৃষ্ণদেবের হৃদয়টিও ছিল মানবিকতা ও অলৌকিকতার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। রামকৃষ্ণ অলৌকিক ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং উপযুক্ত শিষ্যকে প্রত্যক্ষ করাতে পারেন, এই লোকোত্তর বিশ্বাসে তার বিন্দুমাত্র শিথিলতা ছিল না। ঈশ্বর-প্রত্যক্ষটাও কেন্দ্রীভূত সমাহিত চিত্তের উপর প্ৰযুক্ত একধরণের self-hypnotic প্রক্রিয়া কিনা, এ জাতীয় সন্দেহ ও অবিশ্বাসকে তিনি শেষ পৰ্য্যন্ত আমল দেননি। রামকৃষ্ণের চরিত্রের কতগুলি অপূর্ব মানবিক গুণ বিবেকানন্দের উপর যাদুর মত কাজ করেছে এবং এই মানবিক আকর্ষণ অলৌকিকতা পৰ্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। এই সবকিছু মিলিয়েই বিবেকানন্দের চরিত্রে স্ববিরোধিতার উৎস আমাদের সন্ধান করতে হবে।