তা হলে সমগ্রতা ও একতাকে কোন দৃষ্টিভঙ্গীতে গ্ৰহণ করা হবে তার উপর দার্শনিক মতের মূলগত ভেদটাও অনেকটা নির্ভর করছে। একটা অপেক্ষাকৃত স্থূল উদাহরণ দেয়া যাক। উপনিষদের একটা বহুজন-শ্রুত বাণী- “মা গৃধঃ কস্যচিন্ধনম”। এর তাৎপৰ্য্যাৰ্থ অনেকরকম কল্পনা করা যেতে পারে। মনে করুন প্ৰাচীন আৰ্য্যদের যৌথ সমাজব্যবস্থার শেষ দশায় যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিন্দু বিন্দু বিকাশ আরম্ভ হয়েছে তখন একথাটি ব্যক্তিগত লোভের বিরুদ্ধে প্ৰযুক্ত হতে পারে। কার ধন? কারুর একার নয়, কিন্তু সকলের। সুতরাং লোভ করবে না। আবার শ্রমজীবি মানুষের বঞ্চনার উপর প্রতিষ্ঠিত শ্রেণীবিভক্ত সমাজে এই একই কথার তাৎপর্য একেবারে উল্টে যাবে। মনুসংহিতার সমাজে এর অর্থ হবে শূদ্রের প্রতি কঠোর হুঁসিশারী। মনু বিধান দিয়েছেন শূদ্রের ধনসঞ্চায়ের অধিকার নেই। কাজেই শূদ্র যদি সমাজে তার শ্রমের ন্যায্য ফল দাবী করে, মনুর মতে সে হবে অন্যের ধানে লোভ করার সামিল। শোষক শ্রেণীর লোভকে গোপন করার জন্য শোষিত শ্রেণীকেই লোভী বলে চিত্রিত করার এ এক বিচিত্র প্ৰয়াস। অনেকদিন আমাদের এমন তর্ক শুনতে হয়েছে কমিউনিষ্টরা ছোটলোকদের স্বাভাবিক লোভ, ঈর্ষ্যা ও পরশ্রীকাতরতায় ইন্ধন যুগিয়ে শ্ৰেণীবিদ্বেষ প্রচার করছে। শ্রেণীবিদ্বেষ যার রক্তে ও অস্থিমজ্জায় মিশে আছে সেই মালিকশ্রেণীর পক্ষে শ্রেণীসাম্য প্রচারের কি অপূর্ব চাতুরী। আবার রবীন্দ্রনাথের মত স্থিতপ্ৰজ্ঞ মনীষী উপনিষদের এই প্ৰখ্যাত কথাটির প্রাচীনতম তাৎপর্ষে ফিরে গেলেন। বর্তমানযুগে ধনিকশ্রেণীর দুরন্ত মুনাফালোভকেই তিনি উপনিষদের মন্ত্র দ্বারা আঘাত করলেন।
উপনিষদ মানুষের ঐক্য ও সমগ্রতাবোধের প্রাচীনতম বাণীমূর্তি। উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার মনীষিবৃন্দ উপনিষদের মন্ত্রগুলিকে এই অর্থেই গ্ৰহণ করেছেন। যে দেশে সভ্যতার ঊষালগ্ন উপনিষদের উদাত্ত মন্ত্রে মুখর হয়ে উঠেছিল সে দেশ ছোট নয়, সে জাতি তুচ্ছ নয়, পরাধীন জাতির অবলুপ্ত আত্মচেতনাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এই উদ্দীপনা, এই উদ্বোধনী শক্তির প্রয়োজন ছিল। সভ্যতাগর্বিত বিদেশী শাসকবর্গের সামনে স্ফীতবক্ষে দাঁড়াবার জন্য যে সাহসের প্রয়োজন প্ৰাচীন ভারতের প্রজ্ঞাবাণী সেই আত্মোপলব্ধির সাহস সঞ্চার করেছিল। রবীন্দ্ৰনাথ “ভারত-তীৰ্থকে” বৈদিকমন্ত্রের বাস্তব রূপায়ণ বলে কল্পনা করেছেন। সমগ্ৰতাবাদী ঔপনিষদিক দর্শনকে বিবেকানন্দ যেভাবে তার সমাজ-দর্শনে পরিণত করলেন তার তুলনা বিরল।
“সমগ্রের জীবনেই ব্যক্তির জীবন, সমগ্রের সুখেই ব্যক্তির সুখ। সমগ্রকে বাদ দিয়ে ব্যক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না—এই হ’ল শাশ্বত সত্য, এই সেই প্ৰস্তার-ভিত্তি যার উপর বিশ্বসংসার গড়ে উঠেছে। … এই প্ৰকৃতির নিয়ম, … … চিরদিন কেউ সমাজকে বঞ্চনা করে চলতে পারেনা … সমাজের উপর তলায় যতই জঞ্জাল পুঞ্জীভূত হোক না কেন, সেই জঞ্জালোয় নীচে সমাজের প্ৰাণশক্তির অক্ষয় ধারা স্পন্দিত হতে থাকে। • সমাজ পৃথিবীর মত সৰ্বংসহ, অনেক ধৈৰ্যের সঙ্গে অনেকদিন অত্যাচার সহ করে চলে। কিন্তু একদিন সে জাগে, ভূমিকম্পের শক্তি নিয়ে জাগে। লক্ষ বছরের নীরব প্ৰতীক্ষার যুগে যে তুচ্ছতা ও স্বার্থপরতার গ্লানিময় আবর্জনা সমাজের বুকে জমে উঠেছিল। এই ভূমিকম্প এক নিমেষে তা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।” [“Modern India”-“বর্তমান ভারত” নামে মূল বাংলা প্ৰবন্ধটি এই প্ৰবন্ধ লেখার সময় লেখকের হাতের কাছে ছিলনা, তাই মূলের ইংরেজী অনুবাদ থেকে পুনরানুবাদ করতে হ’ল-এজন্য পাঠক মার্জনা করবেন।]
ঔপনিষদিক দর্শনের এই সামাজিক পরিণতির সঙ্গে শঙ্কর প্রচারিত বেদান্ত-দর্শনের কোন সঙ্গতি নেই। বিবেকানন্দ নিজেকে অবশ্য শঙ্করণ রোদান্তের ধারক বলে মনে করতেন। কিন্তু মনুসংহিতার যে সমাজবিধানকে বিবেকানন্দ তীব্ৰতম ভাষায় আক্রমণ করেছেন শঙ্কর-বেদান্তু, সেই সমাজের শাসন অবনত মন্তকে মেনে নিয়েছিল। শুধু তাই নয়, আজিও ‘মোহাতমহারাজের মনুসংহিতার সনাতন ধর্মের শাসন ভারতবর্ষে পুনঃ প্ৰতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। শংকরের মায়াবাদকে কায়মনোবাক্যে গ্রহণ করলে এই সনাতন পথই গ্রহণ করতে হবে। একমাত্র নিরাকার বিজ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্মই যখন সত্য, সমাজ সংসার, সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য শেষ পৰ্যন্ত সবই যখন মিথ্যা, তখন নিপীড়িত মানুষের কল্যাণ-কামনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ধনিক শ্রেণীর শোষণব্যবস্থাকে অবলুপ্ত করে বঞ্চিত মানুষকে মানবিক মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার প্ৰয়াসটাও মিথ্যা, মূল্যহীন। রাজশক্তি ও বিত্তবানদের অনুগ্রহে মঠগুলি বেঁচে থাকুক, মোহন্তরা বেঁচে থাকুন, এই মঠ-মিশনগুলিতে অকাতরে অর্থদান করার জন্য ধনিকের মুনাফা-শোষণের পবিত্র অধিকার চিরকাল বেঁচে থাকুক, এই মায়াময় সংসারে এইটুকু মায়া বেঁচে থাকলেই যথেষ্ট।
বলা বাহুল্য, বিবেকানন্দ এ জাতীয় মায়াবাদে বিশ্বাস করতেন না। “গীতা-পাঠের চেয়ে ফুটবল খেলার মধ্য দিয়ে তোমরা স্বর্গের অনেক কাছাকাছি যেতে পারবে। এগুলি দুঃসাহসিক কথা, কিন্তু তোমাদের ভালবাসি বলেই বলছি। বাইসেপ মাস্ল মজবুত করলে গীতা অনেক ভাল বুঝতে পারবে” (“Vedanta and Indian life’)। ঊনবিংশ শতাব্দীর যে বৈদান্তিক সন্ন্যাসী একথা বলতে পেরেছিলেন তিনি নিশ্চয়ই নমস্ত। শংকরাচাৰ্য্য নিজে তার মায়াবাদ যেভাবে বুঝেছিলেন, শংকরানুবর্তী পরবর্তী দুর্ধর্ষ তার্কিক দার্শনিকবৃন্দ এই মায়াবাদকে যেভাবে অনির্বচনীয়তা-সর্বস্ব বলে ব্যাখ্যা করেছেন, বিবেকানন্দ মায়াবাদকে সেই একই অর্থে গ্ৰহণ করেছেন কিনা শেষ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। বিবেকানন্দ যেখানে বেদাভেজ ব্যাখ্যা করেছেন সেই “জ্ঞানযোগে”, অথবা “কলম্বো থেকে আলমোড়া পৰ্যন্ত বক্তৃতাবলী”তে কোথাও শ্ৰীহৰ্ষ, চিৎসুখাচাৰ্য বা মধুসূদন সরস্বতীর মত মায়াবাদের ব্যাখ্যা করেন নি। সর্বত্রই তিনি হৃদয়ের দরদ মিশিয়ে এক মানবধর্মী বৈদান্তিক ব্যাখ্যার উপর জোর দিয়েছেন। শংকর থেকে মধুসুদন সরস্বতী পৰ্যন্ত কোন বৈদাক্তিকের ভিতরে এই বৃহত্তম মানবিকতার লেশমাত্র পাওয়া যাবে না। কারণ তারা সমাজদর্শনকে দর্শনের মধ্যে গণনা করেননি, অথবা মনুসংহিতাকেই সমাজদর্শনের শেষ ও সার কথা বলে ধরে নিয়েছিলেন। বিবেকানন্দ বার বার ঘুরে ফিরে দর্শনের মানবিক মর্মকেন্দ্রে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সকল মানুষ যখন এক, নিখিল বিশ্ব যখন একই ব্রহ্মের সংহতমূর্তি (Perfect solidarity of the Universe) তখন মানুষের উপর মানুষের বৈষম্যমূলক শোষণ ও নিপীড়ন এই শাশ্বত সত্যের বিরোধী, অদ্বৈত বেদান্তের ব্যভিচার। অথচ বিবেকানন্দ যাঁকে নিজের দার্শনিক গুরু বলে মনে করতেন সেই শংকর ও তার শিষ্যপরস্পরা কিন্তু অনায়াসে সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত একটা শোষণমূলক সমাজ-ব্যবস্থার সঙ্গে ব্ৰহ্মবাদকে দিব্যি মিলিয়ে নিতে পেরেছিলেন। মায়াবাদকে এই শোষণব্যবস্থার সহায় হিসাবে প্রয়োগ করাও অসম্ভব নয়। যদিও এরকম কল্পনা করা অন্যায় হবে না যে সকল মায়াবাদী দার্শনিক সজ্ঞানে শোষণব্যবস্থার সহায়ক হিসাবে মায়াবাদকে গড়ে তুলেছিলেন।