“শূদ্ৰ-বিপ্লবে”র আত্মিক প্রকৃতি সম্পর্কে একটা হতাশাক্লিষ্ট সংশয়ই শুধু ভঁাকে ঈশ্বর-প্রত্যাশার স্নিগ্ধ সান্ত্ৰনার বুকে টেনে নিয়েছে-একথা অৰ্দ্ধসত্য-মাত্র। একটা ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মত, রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পৰ্যন্ত বাংলার নবজাগৃতির ঋত্বিককুলের উপর ঔপনিষদিক ব্ৰহ্মবাদের প্রভাব ছিল অসামান্য। এর একমাত্র ব্যতিক্ৰম বোধ বীর-সিংহের সিংহ শিশু ঈশ্বরচন্দ্ৰ, যিনি ঈশ্বরের সিংহাসনের সামনে নতজানু হওয়ার প্রয়োজন বোধ কোনদিন অনুভব করেননি। তিনি যেমন “সোহং”-বাদও প্রচার করেননি, তেমনি মানুষের অনেক রকম দাসত্বের মধ্যে আবার ইশ্বরের দাসত্ব আমদানী করলে কারুর কোনো মঙ্গল হবে এমন কোন ধারণাও পোষণ করেননি। বিবেকানন্দের প্রদীপ্ত সমাজচেতনাও ব্রহ্মবিজ্ঞানের ধারাস্নানে আত্মশুদ্ধি করেছে।
শক্তি ও সভ্যতার উচ্ছ্রিত অহঙ্কারে প্রমত্ত এক বিজাতীয় শাসন ভারতবর্ষকে নাগপাশে বেঁধেছিল। শ্বাসরুদ্ধ পরাধীন জাতি তখন আত্মপ্ৰকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ খুঁজেছে। পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার আলোকজাত বাংলার মনীষা তখন স্বদেশ ঐতিহ্যের মধ্যে এমন একটা বিরাট আদর্শের সন্ধান করেছে যার উপর নির্ভর করে স্বদেশ আবার আত্মসমীক্ষা ও আত্মপ্রত্যয়ে উদ্বুদ্ধ হবে এবং সভ্যতাগর্বী পশ্চিমী সমাজও যাকে শ্রদ্ধা জানাতে বাধ্য হবে।
উপনিষদের ব্ৰহ্মবাদ স্বভাবতই এমন একটা আদর্শের সন্ধান দিয়েছে। দার্শনিক পরিভাষায় যাকে Monism বলে, মানুষের মনন ধারার উপর তার বিপুল প্রভাব অনস্বীকাৰ্য। এই Monism বস্তুতান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর দ্বারা পরিশুদ্ধ হলে মার্কসবাদেও পৰ্যবসিত হতে পারে। Monism-এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্য কোন বাংলা তর্জমা মনে আসছে না বলে মার্কসবাদের একটা নামকরণ করা যেতে পারে বস্তুতান্ত্রিক অদ্বৈতবাদ। লেনিনের মতে যে গ্ৰন্থ একপুরুষ ধরে রুশিয়ার মার্কসবাদীদের শিক্ষিত করেছে, প্লেখানভ তাঁর সেই প্রখ্যাত গ্রন্থের নাম দিয়েছিলেন “The Development of the Monistic View of History”। আবার বস্তুজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অন্তরলোকেই যখন সেই একক সত্যের সন্ধান করা হয় তখন Monism পরিণত হয় শঙ্করাচার্য্যের অদ্বৈতবাদে, যে মতে—এক দ্বৈতহীন নিরাকার বিজ্ঞানই একমাত্র সত্য—বাকী সব মিথ্যা, একটা অনাদি ভ্রান্তিবিলাস মাত্র।
সুতরাং অদৈত্ববাদকে আপনি কোন দৃষ্টিভঙ্গীতে গ্রহণ করবেন তাঁর উপর আপনার চিন্তাধারার গতি ও প্রকৃতি অনেকখানি নির্ভর করছে। বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধও তার দর্শনকে অদ্বৈতবাদী বলছেন, কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য অর্থে। অনন্ত বিজ্ঞানক্ষণের বিরামহীন স্রোতের মধ্যে বিলীয়মান এক একটি ক্ষণিক বিজ্ঞান, এই একমাত্র সত্য, এক মুহূর্ত্তে সে একক যদিও সাকার, শঙ্কর-সম্মত বিজ্ঞানের মত নিরাকার নয়। বৌদ্ধ বিজ্ঞানবাদের উপর আপনার চিন্তাধারার গতি ও প্রকৃতি অনেকখানি নির্ভর করছে। বহির্জগতের অস্তিত্ব বা অনস্তিতের দিক থেকে এই সাদৃশ্য কতখানি যুক্তিসহ অবশ্যই তা বিচার্য্য বিষয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই দুয়ের মধ্যে যে একটা দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান রয়েছে সেদিকে দৃষ্টি না দিলে একদেশদর্শিতার দায়ে অভিযুক্ত হতে হয়। বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ পূর্ণতা বা সমগ্রতাকে স্বীকার করেনি। যা “সমগ্র” তার সত্য নয়, অংশটাই একমাত্র সত্য, যে অংশ নিরংশ অর্থাৎ বিশ্লেষণ করে যার ভিতরে আর কোন অংশের ধারণা করা যাবে না। তাই সত্য। তাই এক্ষণের বিজ্ঞানটুকুই একমাত্র সত্য, বিজ্ঞান-ক্ষণের সন্তান অর্থাৎ স্রোত বা প্ৰবাহটা সত্য নয়, ওটাও বিকল্প মাত্ৰ। আচাৰ্য্য ধৰ্মকীতি তার “প্ৰমাণবাতিকের” পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ধরে অবয়বীর অস্তিত্ব খণ্ডন করেছেন, অবয়বটাকেই সত্য বলে প্ৰমাণ করার চেষ্টা করেছেন। একটা সামগ্রিক ঐক্যের ধারণা বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ দর্শনের সম্পূর্ণ বিরোধী। অপরদিকে, অনন্ত বৈচিত্র্যময় জগৎসংসার একটা সুত্রে বাধা, বৈচিত্র্যের পিছনে কোথাও একটা সুনিবিড় ঐক্য বর্তমান, বহু মানুষের বহু অভিজ্ঞতা, বস্তুজগতের বহু খণ্ড খণ্ড অভিব্যক্তি সব কিছুর পিছনে একটা সামগ্রিক ঐকিক সত্তা কাজ করে যাচ্ছে, উপনিষদের প্রথম পাঠকের মনেও এই প্রাথমিক ধারণা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু বুদ্ধের বাণী শুনলে যে ধারণাই হোক না কেন, দিকৃপাল বৌদ্ধ দার্শনিকদের সঙ্গে পরিচয় হলে এই সামগ্রিক ঐক্যের ধারণাটা অবলুপ্ত হতে বাধ্য। এই পূর্ণতম ঐক্যের ধারণাকে আমরা অনেকভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারি। শংকর-সম্মত নিরাকার ব্রহ্মবিজ্ঞানবাদ, রামানুজ-প্ৰদৰ্শিত বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, এমন কি হেগেলীয় সমগ্রতাবাদ দিয়েও এর ব্যাখ্যা করা চলে। এই দার্শনিক ঐক্যানুভূতির সঙ্গে মাক্সর্বাদেরও কোনো মৌলিক বিরোধ নেই।
সেই প্রাচীন যুগেও বিশ্বপ্রকৃতিকে যতটুকু পৰ্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছিল তার ভিতর দিয়েও একটা সুবিম্ভন্ত বিধিবদ্ধতা, একটা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত নিয়মানুবর্তিতার ধারণা মানুষের মনে বদ্ধমূল হয়েছিল। আর একদিকে প্রাচীন জাৰ্য্যসমাজের জটিলতাবর্জিত ঐর্কিক আন্তঃপ্রকৃতিও একটা সামগ্রিক ঐক্যানুভূতির ভিতরে মানুষের সমাজকে ৰাচিয়ে রেখেছিল, এগিয়ে নিয়েছিল, বিশ্ব প্রকৃতির মহাপ্ত সন্ধানে মানুষকে অনুপ্রেরিত করেছিল। আমাদের বহুমুখী অভিজ্ঞতার যে ঘটনাপুঞ্জ নিক্ষিপ্ত ও খণ্ড খণ্ড আকারে দেখা দেয় তার ভিতরে একটা সাধারণ নিয়মসূত্রের অস্তিত্ব অনুসরণ করা, এক অখণ্ড পূর্ণতার সন্ধান করা বোধহয় মানব-সভ্যতার সৃষ্টি ও অগ্রগতির প্রধান উৎস। “যিনি এক তিনি বহু হলেন” এ শুধু শঙ্কর-বেদান্তের কথা নয়। এ বস্তুবাদী মার্ক্সবাদেরও মূল কথা। কারণ কারণ, এ মননশীল মানবমনে প্ৰতিফলিত বস্তুসত্যের প্রথম প্ৰকাশ। কিন্তু বহুরূপে পরিব্যাপ্ত সেই একের স্বরূপ কি? সে কি এক সর্বনিয়ন্তা ঈশ্বর, সে কি এক নিরাকার বিজ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্ম, সে কি এক অব্যৰ্থ অন্ধ নিয়তি, এক সর্বগ্রাসী মহাকাল, অথবা সে এক মূল বস্তুপ্রকৃতি (primordia mater) যা আপনে নিয়মে বহু ধারায় বিভক্ত ও বিবর্তিত হয়ে এই বিচিত্র বস্তুজগতে পরিণতি লাভ করেছে? আধুনিক বিজ্ঞানসমৃদ্ধ বস্তুবাদ এই শেষের সূত্রটিকে সত্য বলে বিশ্বাস করে।