বৈশ্য-সভ্যতার মূল্যনিরূপণে বিবেকানন্দ একদেশদর্শী ছিলেন না। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পৰ্যন্ত বিপুল পরিমাণ পণ্যসঞ্চালনের মারফত মানুষের সঙ্গে মানুষের নির্বিড় যোগসূত্র স্থাপন করেছে এই বৈশ্যসভ্যতা, এবং একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন সীমাবদ্ধ জ্ঞান বিজ্ঞান কৃষি ও সভ্যতার অমূল্য সম্পাদরাশি ছড়িয়ে দিয়েছে সারা পৃথিবীতে।
(The wisdom, civilisation and arts that accumulated in the heart of the social body during the Brahmin and Kshatriya supremacies are being diffused in all directions by the arteries of commerce to the different market places of the Vaisya. But for the rising of this Vaishya power who would have carried to-day the culture, learning, requirements and articles of food and luxury of one end of the world to the other.–“Modern India” প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য)
কিন্তু ঠিক এর পরই তিনি প্রশ্ন করছেন—“যাদের শারীরিক শ্রমের ওপর নির্ভর করে ব্ৰাহ্মণের প্রভাব, ক্ষত্ৰিয়ের ক্ষমতা ও বৈশ্যের সম্পদ সম্ভব হয়েছে তারা কোথায়? সব দেশে সব যুগে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে “নীচু জাতি,” “অন্ত্যজ,” অথচ যারাই হল আসলে সমাজের শরীর, তাদের ইতিহাসটা কি? উচ্চবর্ণের একচ্ছত্র অধিকার-কবলিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে একটু ভাগ বসাবার অপরাধে ভারতবর্ষে যাদের জন্য জিহ্বা ও মাংস উপড়ে নেওয়ার মত কোমল শাস্তি বিধান করা হয়েছে ভারতের সেই চলন্ত শবগুলি, বিশ্বের সেই ভারবাহী পশুগুলি, সেই শূদ্র জনসাধারণ, তাদের ভাগ্যে কি লেখা আছে?” (Modern India)
বৈশ্য সভ্যতার উন্নামক বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এর এমন একটি সাধারণ চরিত্র লক্ষ্য করেছেন যা যে কোনও সানন্দ-বিস্ময়ে সমর্থন করবেন। তিনি বললেন—ক্ষত্রিয়ের হাত থেকে ক্ষমতা করায়ত্ত করার সময়ে বৈশ্যদের এমন কোন সদিচ্ছা ছিলনা যে ক্ষমতাটা শূদ্ৰশ্রেণীর হাতে পড়ুক। (That the royal power may not anyhow stand in the way of the inflow of his riches, the merchant is ever careful. But for all that, he has never the least wish that the power shquld pass on from the Kingly to the Shudra Claes-Modern India)। এই একই প্রবন্ধের প্রারম্ভে তিনি দেখিয়েছেন যে শাসনক্ষমতায় জনসাধারণের প্রকৃত অধিকার ভারতবর্ষে কোন দিন ছিল না–না ব্ৰাহ্মণযুগে, না ক্ষত্ৰিয়-বৌদ্ধযুগে। ইতস্ততঃ পরোক্ষভাবে, বিক্ষিপ্ত ও বিশৃঙ্খলভাবে জনসাধারণ আত্মপ্রকাশের জন্য সংগ্ৰাম করেছে। কিন্তু তারা নিজেদের ভিতরে কোন সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে পারে নি। শিক্ষাদীক্ষা যখন সবই ছিল ঋষিদের হাতে তখন স্বভাবতই জনতার পক্ষে এমন কোন শিক্ষালাভের সম্ভাবনা ছিল না যার দ্বারা তারা কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, মানুষের সামগ্রিক ও সাধারণ মঙ্গলের জন্য একতাবদ্ধ হতে পারে। এদিকে কিন্তু পারস্পরিক স্বার্থের খাতিরে ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্ৰিয় শেষ পৰ্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হ’ল। এই ধরণের ঐক্যের সহজাত পাপ হিসেবে এরা সবাই মিলে জনসাধারণের রক্তশোষণ, শক্রের উপর প্রতিহিংসা, অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন করার কাজগুলি চালিয়ে যেতে লাগল, এবং শেষ পর্যন্ত পশ্চিমাগত মুসলমান আক্রমণকারীদের হাতে সপ্তা ও সহজ শিকারে পরিণত হল। শোষিত জনসাধারণের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতীয় সমাজেতিহাসের এমন স্পষ্ট বিচার বিবেকানন্দের পূর্বে অন্য কোনও ভারতীয় মনীষী করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। অক্টোবরের রুশ বিপ্লবের সঙ্গে পূর্ববর্তী বিপ্লবগুলির মৌলিক পার্থক্য দেখাতে গিয়ে মাক্সবাদী দার্শনিকরা বলেছেন-পূর্ববর্তী বিপ্লবগুলিতে একদল শোষকশ্রেণীর জায়গায় আর একদল শোষকশ্রেণী ক্ষমতায় প্ৰতিষ্ঠিত হয়েছে মাত্ৰ, শোষিত শ্রেণীর হাতে কোন দিনই ক্ষমতা আসেনি। কিন্তু অক্টোবর বিপ্লবই হল পৃথিবীর প্রথম বিপ্লব যা শোষিত শ্রেণীকে ক্ষমতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিবেকানন্দ “শূদ্ৰ-বিপ্লব” দেখে যান নি, কিন্তু প্রাক্-শূদ্ৰ-বিপ্লবগুলিতে শেষপৰ্যন্ত যে শোষকশ্রেণীর হাতেই সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা বহাল রয়েছে এ-ঘটনা তা’র সন্ধানী চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি। সমকালীন পশ্চিমী সমাজের গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করে আসন্ন “শূদ্ৰ-বিপ্লবী” সম্পর্কে বিবেকানন্দ নিঃসংশয় ছিলেন- “সোশ্যালিজম, এনাকিজম, নিহিলিজম এবং এই জাতীয় অন্যান্য মতবাদগুলি আসন্ন সমাজবিপ্লবের অগ্রদূত” (Modern India)। – “শূদ্রের আধিপত্য অবশ্যম্ভাবী, কেউ একে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না– They must have it, none can resist it”–(Works-Vol. VI P. 81.)
বিবেকানন্দ সমাজদৃষ্টির আর একটি চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত উল্লেখ না করলে সমালোচকের দৃষ্টি উন্মুক্ত বলে বিবেচিত হবে না। বিপ্লবী শ্রমিক-সংগঠনে অভিজ্ঞ সচেতন রাজনৈতিক কর্মীমাত্রেই জানেন যে শ্রমিকশ্রেণীকে পঙ্গু করে রাখার জন্য পুঁজিপতি শ্রেণীর একটা চিরাচরিত অপকৌশল আছে। নিপীড়িত শ্রেণীর ভিতরে যদি কেউ বিদ্যাবুদ্ধি ও গুণগরিমায় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন, চতুর পুঁজিপতিশ্রেণী তাকে ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধা ও ক্ষমতা দিয়ে নিজেদের দলে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে, যার ফলে সে আপন শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিচুত হয়ে শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদের সেবাতেই আত্মনিয়োগ করে, পুঁজিবাদের স্বার্থে নিজশ্রেণীর উপর নিজের বিস্তীর্ণ প্রভাবের অপব্যবহার করে, এবং বিপ্লবের পথ থেকে শ্রমিক শ্রেণীকে প্ৰতিনিবৃত্ত করে। বিলাতের র্যামসে ম্যাকৃডোলাণ্ড থেকে আরম্ভ করে দেশে দেশে এই দৃষ্টান্তের অভাব নেই। বিবেকানন্দ প্রাচীন ভারতীয় সমাজেও নিপীড়িত শ্রেণীর মানুষের এই স্বধৰ্মচুতি ও স্বশ্রেণী-দ্রোহিতা দেখতে পেয়েছেন।