“সমাজের নীচেকার লোকটিও এই দুঃখময় পৃথিবীতে একটু সুদিনের মুখ দেখুক। এর ফলে এই তথাকথিত সুখাস্বাদের অভিজ্ঞতা পার হয়ে এরা সবাই এসে শেষ পৰ্য্যন্ত পরমেশ্বরের শরণ নেবে; এই পৃথিবী, তার গভর্ণমেণ্ট, তার আর যত সমস্যা সম্পর্কে এদের সকল মিথ্যা মায়ামোহ তখন কেটে যাবে।” (Swami Vivekananda–Comeplete Works, Vol, VI–
Sixth Edition, 1956. pp. 381-82)
এই দীর্ঘ উদ্ধৃতিটির ভিতরে বিবেকানন্দের মানসপরিধি, তার ভাবনার স্বরূপ সার্থকভাবে প্ৰতিফলিত হয়েছে। যে চিঠিখান থেকে এই উদ্ধৃতিটি দেওয়া হল তার প্রারম্ভ ও পরিণতির সঙ্গতিটা অবশ্য লক্ষণীয়। বাস্তব সমাজব্যবস্থাটাকে উন্নত করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে একদিন আমাদের সকল দুঃখের অবসান ঘটবে এই ধারণাটা যে ভুল সে কথাটা প্ৰমাণ করাই চিঠিখানার মূল উদ্দেশ্য।
“আর একটা মস্তবড় ভুল আমরা করে থাকি এই ভেবে যে পৃথিবীতে মঙ্গলের পরিমাণটা ক্রমবর্ধিষ্ণু এবং অমঙ্গলের পরিমাণটা ক্রমক্ষয়িষ্ণু। এর থেকে এটাই প্ৰমাণ করার চেষ্টা হয়ে থাকে যে, অমঙ্গলটা ক্ৰমশঃ ক্ষয় হয়ে লোপ পেয়ে যাবে, এবং শেষ পৰ্য্যন্ত মঙ্গলটাই শুধু থাকবে।…কিন্তু সমাজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মঙ্গল যত বাড়ছে, অমঙ্গলও ততই বেড়ে চলেছে।” ।(ঐ পৃ:৩৭৯-৮০)। এই হল চিঠিখানার গোড়ার কথা। উপসংহারের দিকটা আমরা প্ৰথমেই উদ্ধৃত করেছি। এখন উপক্রম ও উপসংহার মিলিয়ে দেখুন। সমাজ-জীবনের ব্যবহারিক বা বস্তুতান্ত্রিক অগ্রগতির ধারা মানুষের সমস্যার শেষ সমাধান করতে পারে না। চিত্ত ও চেতনাকে ঈশ্বরভাবে ভাবিত করে তবেই মানুষের নিষ্কৃতি।
অথচ, একথা ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে এই চিঠিখানারই মধ্যপথে বিবেকানন্দ ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়,বৈশ্য ও শূদ্র এই চারবর্ণের ক্ৰমান্বয়ী আধিপত্যের ভিত্তিতে সমাজ বিবর্তনের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। একথা অকুষ্ঠিতভাবেই স্বীকার করা চলে যে উনবিংশ শতাব্দীর প্রান্তবাসী এই সাধক-সন্ন্যাসীই ভারতীয় মনীষীদের ভিতরে সর্বপ্রথম শ্রেণীস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ বিবর্তনের ধারা অনুধাবন করার মত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিয়েছেন। তার বিশ্লেষণ-পদ্ধতি আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের দিক থেকে কতটা অসম্পূর্ণ সে কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনের মূল সূত্রের ভিতরে তিনি যে শ্রেণীস্বার্থের সন্ধান পেয়েছেন এবং সে-কথা যে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্ৰকাশ করেছেন ভারতীয় সমাজদর্শনের ক্ষেত্রে তাঁর এই মৌলিকত্ব অনস্বীকার্য।
তিনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়,বৈশ্য ও শূদ্র এই চারিটি শব্দের ব্যঞ্জনগত ব্যাপক অর্থ গ্ৰহণ করেছেন এবং এর দ্বারা সমগ্ৰ মানবসমাজের ইতিহাস ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের প্রথম স্তরটিকে ব্ৰাহ্মণ্য সভ্যতা বলে সামগ্রিক ভাবে চিহ্নিত করা যুক্তিযুক্ত কিনা সে বিষয়ে ন্যায়সঙ্গত সন্দেহ থাকলেও, এবং ক্ষয়িষ্ণু ব্ৰাহ্মণ্য সভ্যতার সঙ্গে উন্মেষমুখী ক্ষাত্রসভ্যতার সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছবার ধারণাটিকে একটি অতিসরলীকৃত সূত্র বলে অগ্রাহ করলেও বৈশ্য ও শূদ্র সভ্যতা সম্পর্কে বিবেকানন্দ যা বলেছেন তা আধুনিক সভ্যতার মর্মভেদী এক সুগভীর অন্তদৃষ্টির পরিচায়ক।
বৈশ্য শাসনের মূলগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিবেকানন্দ বলেছেন-“It is awful in its silent crushing and blood-sucking power.”
এখানে “silent” কথাটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বিবেকানন্দ মোটেই মার্কসবাদী ছিলেন না একথা মনে রাখলে এই শব্দটির ব্যঞ্জনাময় বৈশিষ্ট্য আমাদের আরও বেশী বিস্মিত করে। মার্কসবাদী সমাজবিজ্ঞানী সমাজবাস্তবের আরও সুনিপুণ বিশ্লেষণ করে এই কথাই অন্তভাবে বলতেন–পণ্যপ্রধান পুঁজিবাদী সভ্যতায় শ্রমিকের শ্রমজাত Surplus value বা উদ্বৃত্ত মূল্য মুনাফার আকারে নিঙড়ে নেয়ার এমন একটি কৌশল আছে যে শ্রমিকের মোট শ্রমের কত অংশ তার নিজের জন্য, আর কত অংশ মালিকের মুনাফার জন্য বিনা পারিশ্রমিকে নিয়োজিত হচ্ছে সে হিসাব করা শ্রমিকের পক্ষে অসাধ্য হয়ে ওঠে। ভূমিপ্রধান ক্ষত্রিযুগে শ্রমজীবী মানুষের স্বাৰ্থমুখী শ্রম ও মালিকমুখী শ্রমের পরিমাণিক পার্থক্যটা যত সহজে চোখে পড়ে পণ্যপ্ৰধান বৈশ্য সভ্যতায় তত সহজে চোখে পড়ে না। মার্কস যাকে commodity fetishism বলেছেন সেই পণ্যময়ী জুজুমূর্তির অন্তরালে শ্রমিকের শ্রমসঞ্জাত মূল্য-পরিমাণটা ঢাকা পড়ে যায়। পণ্যের বিনিময় যে মূলতঃ শ্রমশক্তির মূল্যের বিনিময়, আর সেই মূল্যের একটা বিরাট অংশ যে উদ্বত্ত হয়ে মুনাফার আকারে শোষণ করে নেয়া হয়— উৎপাদনের এই সামাজিক ইতিহাসটা চাপা পড়ে যায়। (Thus the determination of the magnitude of value by labour time is a secret hidden away beneath the manifest fluctuations in the relative values of commodities. (Capital l p. 49. Everyman’s Edition)
এইজন্যই পুঁজিবাদী আমলে শোষণটা চলে নিঃশব্দে, কারণ শোষণকে শোষণ বলে চেনা যায় না, এবং এই শোষণের পরিমাণটাও নিঃশব্দে বেড়ে চলে। পণ্যের গায়ে তার মূল্যোৎপত্তির ইতিহাসটা ব্যাখ্যা করে লেখা থাকে না–“value does not wear an explanatory label.” (ঐ পৃ: ৪৭)। এতটা বিশ্লেষণী চিন্তার ভিত্তিতে বিবেকানন্দ ও-কথাটি বলেননি। কিন্তু একটা ব্যাপার তিনি পরিষ্কারভাবেই লক্ষ্য করেছেন, পণ্যবাহিনী বৈশ্যসভ্যতার আড়ালে মানুষের রক্ত শোষণ চলে নিঃশব্দে, এবং এই শোষণ আরো বেশী ভয়ঙ্কর।