জয়ন্ত সহাস্যে বললে, ব্যাপারটা এতই স্পষ্ট যে কোনও যাদু সৃষ্টি করবার দরকার নেই। আমার যা জানবার তা জেনেছি। এখন আপনারা সকলেই ঘরের ভিতরে আসতে পারেন।
–তাই নাকি? তাই নাকি? বলতে বলতে ও হাসতে হাসতে সর্বপ্রথমেই ঘরের ভিতরে পদার্পণ করলেন যদুবাবু। ছোট্টখাট্ট বললেই তার চেহারা বর্ণনা করা যায় না, ভগবানের দয়ায় তিনি বামন হতে হতে বেঁচে গিয়েছেন—কারণ তার দেহের দৈর্ঘ্য সাড়ে চার ফুটের চেয়ে বেশি নয়। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সেই অনুসারেই মানানসই—যদিও তার দেহখানি ছোটোর ভিতরেই দিব্য নাদুস-নুদুস।
যদুবাবুর পর দেখা দিলেন মাধববাবু, দস্তুরমতো দশাসই চেহারা—উচ্চতাতেও ছয় ফুটের কম হবে না। এলেন আরও জনচারেক ভদ্রলোক।
তিনকড়ি একে একে সকলের সঙ্গে জয়ন্তের আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, আমার তাস-দাবা খেলার সাথি হচ্ছেন এঁরাই।
জয়ন্ত মুখে কিছু বললে না, কেবল একবার করে চোখ বুলিয়ে প্রত্যেকের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিলে।
মাধববাবু বললেন, বলেন কী জয়ন্তবাবু, ব্যাপারটা এখনই আপনার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে?
—আজ্ঞে। খুব স্পষ্ট।
—কিন্তু আমরা তো স্পষ্ট কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
—এখানে কাল রাতে চুরি হয়ে গিয়েছে।
—তাই তো শুনছি।
—চোর ওই গরাদ খুলে এই ঘরে ঢুকেছে।
—তাই তো দেখছি।
—তাহলে ব্যাপারটা কি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না?
—উহুঁ! চোর কে?
—সেটা পুলিশ এসে আবিষ্কার করবে। আমি এখানে চোর ধরতে আসিনি, আপনাদের মতো মজা দেখতে এসেছি।
যদুবাবু আপত্তি করে বললেন, আমরা এখানে মজা দেখতে আসিনি, বন্ধুর দুঃখে সহানুভূতি জানাতে এসেছি।
মাধববাবু বললেন, আমরা ভেবেছিলুম, আপনি যখন এসেছেন, চোর ধরা পড়তে দেরি লাগবে না।
জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললে, পুলিশ যদি চোরকে ধরতে পারে তাহলে দেখবেন, চোর আপনার মতো মাথায় ছফুট উঁচু নয়।
মাধববাবু সবিস্ময়ে বললেন, বলেন কী? কেমন করে জানলেন?
—সে কথা বলবার সময় হবে না। ওই পুলিশ এসে পড়েছে।
। পাঁচ ।।
ইনস্পেকটার হরিহরবাবু একজন সহকারীকে নিয়ে গট গট করে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন। বয়সে প্রৌঢ়, মোটাসোটা দেহ, মুখে উদ্ধত ভাব।
রুক্ষ স্বরে তিনি বললেন, ঘরে এত ভিড় কেন? বাড়ির কর্তা কে?
তিনকড়ি এগিয়ে এসে বললেন, আজ্ঞে আমি।
–আপনারই টাকা চুরি গিয়েছে?
—আজ্ঞে হ্যাঁ
—ওঁরা কে?
—এঁরা আমার বন্ধু। আর উনি হচ্ছেন বিখ্যাত শৌখিন গোয়েন্দা জয়ন্তবাবু।
কৌতুহলী চোখে হরিহর একবার জয়ন্তের মুখের পানে তাকালেন। তারপর বললেন, ইনস্পেকটার সুন্দরবাবুকে মাঝে মাঝে আপনি কোনও কোনও মামলায় সাহায্য করেন।
জয়ন্ত বিনীত ভাবে বললে, আজ্ঞে, ঠিক সাহায্য করি বলতে পারি না, তবে সাহায্য করবার চেষ্টা করি বটে।
মুখ টিপে হেসে হরিহর বললেন, এখানেও কি সেই চেষ্টা করতে এসেছেন?
—আজ্ঞে না, মশায়ের চেহারা দেখেই বুঝেছি, আপনার কাছে আমার চেষ্টা নগণ্য।
—ঠিক। সুন্দরবাবুর সঙ্গে আমার মত মেলে না। আমার মত হচ্ছে, শখের গোয়েন্দার কাছে পেশাদার গোয়েন্দার শেখবার কিছুই নেই।
জয়ন্ত বললে, আপনার মত অভ্রান্ত। আমিও ওই মত মানি।
হরিহর বললেন, এইবার মামলার বৃত্তান্তটা আমি শুনতে চাই।
তিনকড়ি আবার সব কথা বলে গেলেন একে একে।
হরিহর সব শুনে বললেন, যে তোক এই বাজারে বিশ হাজার টাকা রাখে বৈঠকখানার কেতাবের আলমারিতে, তাকেই আমি অপরাধী বলে মনে করি। এ হচ্ছে চোরকে নিমন্ত্রণ। করা আর খামকা পুলিশের কাজ বাড়ানো।
তিনকড়ি চুপ করে রইলেন কাঁচুমাচু মুখে।
জয়ন্ত বললে, টাকা ছিল ওই আলমারির ভিতরে।
হরিহর বললেন, টাকা যখন লোপাট হয়েছে, তখন আলমারিটা হাতড়ে আর কোনও লাভ হবে না।
—ওই যে চেয়ারখানা আলমারির সামনে উলটে পড়ে রয়েছে, ওখানা ছিল ওই টেবিলের সামনে।
–বসবার জন্যে চোর ওখানা টেনে এনেছিল আর কী!
–হতেও পারে, না হতেও পারে।
—না হতেও পারে কেন?
–চোর চটপট কাজ হাসিল করে সরে পড়তে চায়। সে চেয়ার পেতে বসে বিশ্রাম করে। আর করলেও সে টেবিলের সামনেই গিয়ে বসতে পারত, চেয়ারখানা এত দূরে টেনে আনত না। বিশ্রাম করবার জন্যে এখানে ঢালা বিছানাও রয়েছে, তবে চেয়ার নিয়ে টানাটানি কেন?
হরিহর ঠাট্টার সুরে বললেন, কেন? তার জবাব আপনিই দিন না!
—আপনি না পারলে পরে আমাকেই জবাব দিতে হবে বই কি!
হরিহর মুখ ভার করে বললেন, আপনার জবাব শোনবার জন্যে আমার কোনোই আগ্রহ নেই। তিনকড়িবাবু, আলমারির কলে একটা চাবি লাগানো রয়েছে দেখছি।
—ও চাবি আমার নয়।
—চোরের?
–সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
—চাবিটা নতুন।
—আলমারিটা খোলবার জন্যে চোর হয়তো এই চাবিটা গড়িয়েছিল।
—তাহলে সে আগে এখানে এসে লুকিয়ে কলের ছাঁচ তুলে নিয়ে গিয়েছে।
—তাই তো জয়ন্তবাবু বললেন, এ কোনও সন্ধানী চোরের কাজ।
–জয়ন্তবাবু না বললেও এটুকু আমি বুঝতে পারতুম। তিনকড়িবাবু, আপনার বাড়িতে আপনি ছাড়া আর কে কে আছে?
—আমার স্ত্রী। আমার ছেলে নেই, কেবল একটি বিবাহিত মেয়ে আছে। সে শ্বশুরবাড়িতে। এখানে একজন রাত-দিনের চাকর আছে। বামুন আর ঝি ঠিকে।
হরিহর ফিরে নিজের সহকারীকে বললেন, সুশীল, বামুন আর চাকরকে সেপাইদের হেপাজতে রেখে এসো।
তিনকড়ি বললেন, আপনি কি তাদের সন্দেহ করছেন? তারা যে খুব বিশ্বাসী।
হরিহর ধমক দিয়ে বললেন, আরে রাখুন মশাই! জানেন তো সব! এরকম বেশির ভাগ চুরির জন্যেই দায়ী গৃহস্থের বামুন-চাকররা। যাও সুশীল।