একখানা ছোটোখাটো দোতলা বাড়ি। সামনে অপেক্ষা করছে জনকয়েক কৌতুহলী লোক, জয়ন্ত ও মানিক তাদের মধ্যে কারুকে কারুকে গতকল্য সন্ধ্যায় দেখেছিল সদাশিববাবুর বাড়িতেও।
তিনকড়ি বাড়ির ভিতরে ঢুকে তার পাঠ গৃহের দরজার তালা খুলে ফেললেন।
জয়ন্ত গলা তুলে সকলকে শুনিয়ে বলল, তিনকড়িবাবু, বাইরে এঁদের এইখানেই অপেক্ষা করতে বলুন। আগে আমরা ঘরের ভিতরটা পরীক্ষা করে দেখি, তারপর অন্য কথা।
মাঝারি আকারের ঘর। মাঝখানে একখানা গালিচা-বিছানো তক্তাপোষ। একদিকে একটি আর একদিকে দুটি বই-ভরা আলমারি এবং ছোটো টেবিল ও দু খানা চেয়ার। আর একদিকেও পুস্তক-পূর্ণ সেলফ। একটি আলমারির সামনে মেঝের উপরে উলটে পড়ে রয়েছে একখানা চেয়ার। ঘরের এখানে-ওখানে যেখানে-সেখানেও ছড়ানো রয়েছে নানা আকারের কেতাব ও মাসিকপত্র প্রভৃতি। দেখলেই বোঝা যায় যে তিনকড়িবাবু হচ্ছেন দস্তুরমতো গ্রন্থকীট।
জয়ন্ত মিনিট দুয়েক ধরে নীরবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘরের চারিদিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করতে লাগল। তারপর জিজ্ঞাসা করলে, তিনকড়িবাবুর টাকা চুরি গিয়েছে কোন আলমারির ভিতর থেকে?
তিনকড়ি অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখিয়ে দিলেন।
—ওর সামনে একখানা চেয়ার উলটে রয়েছে কেন?
–জানি না। তবে ওটা হচ্ছে চোরেরই কীর্তি। কারণ কাল রাত্রে আমি যখন এ ঘর থেকে দরজা বন্ধ করে যাই, চেয়ারখানা তখন চার পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েই ছিল।
–আপনি কাল যখন ঘর থেকে বেরিয়ে যান চেয়ারখানা তখন কোথায় ছিল?
—ওদিককার টেবিলের সামনে।
–তা হলে চোবই চেয়ারখানা আলমারির সামনে টেনে এনেছে।
—তা ছাড়া আর কী?
জয়ন্ত পকেট থেকে রুপোর ছোট্ট ডিপে বার করে নস্য নিতে নিতে (এটা হচ্ছে তার আনন্দের লক্ষণ—নিশ্চয়ই সে কোনও উল্লেখযোগ্য সূত্র আবিষ্কার করেছে) বললে, বটে বটে, বটে! আপনার সেই জাল কেতাবে পুরে আসল নোটগুলো আলমারির কোন তাকে রেখেছিলেন?
তিনকড়ি থতমত খেয়ে বললেন, জাল কেতাব?
–হ্যাঁ জাল কেতাব। অর্থাৎ যা কেতাবের মতো দেখতে, কিন্তু কেতাব নয়।
—ও বুঝেছি। সেই কেতাব-বাক্সটা ছিল আলমারির সব-উপর তাকে।
—যা ভেবেছি তাই, বলতে বলতে জয়ন্ত আলমারির কাছে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর আলমারিটা পরীক্ষা করতে করতে আবার বললে, আলমারির কলে যে চাবিটা লাগানো রয়েছে সেটা কি আপনার?
তিনকড়ি বললেন, আজ্ঞে না। ওটা নিশ্চয়ই চোরের সম্পত্তি।
—তাহলে এ চোর পেশাদার চোর নয়।
–কী করে বুঝলেন?
–পেশাদার চোরের কাছে প্রায়ই চাবির গোছা থাকে, এ রকম একটিমাত্র চাবি থাকে। এখানে চোর এসেছিল একটিমাত্র চাবি নিয়ে। তার মানে সে জানত, এই একটিমাত্র চাবি দিয়েই সে কেল্লা ফতে করতে পারবে। যদি বলেন সে এতটা নিশ্চিত হয়েছিল কেন? তবে তার উত্তর হচ্ছে, সে আন্দে থাকতেই যে-কোনও সুযোগে এই আলমারির কলে একটা মোমের বা অন্য কিছুর ছাঁচ তুলে নিয়ে বিশেষ একটি চাবি গড়ে তবে এখানে এসেছিল। চুরি তার ব্যাবসা নয়, এ চাবি পরে তার কোনও কাজে লাগবে না, তাই চাবিটাকে সে এখানে পরিত্যাগ করেই প্রস্থান করেছে। …তিনকড়িবাবু, দেখছি ওই জানালাটার একটা গরাদ নেই। চোর কি ঐ খান দিয়েই ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেছিল?
–আজ্ঞে হ্যাঁ
জয়ন্ত জানালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর জানালাটা ভালো করে পরীক্ষা করে ফাক দিয়ে গলে বাইরে গিয়ে লাফিয়ে পড়ল।
মাটির উপরে কিছুক্ষণ হুমড়ি খেয়ে বসে কী পর্যবেক্ষণ করলে। তারপর উঠে বললে, মানিক, কাল রাত্রে কখন বৃষ্টি থেমেছিল তুমি তা জানেনা তো?
মানিক বললে, হ্যা আমি তখনও জেগেছিলুম। বৃষ্টি থেমেছিল রাত দুটোর সময়ে।
—তাহলে এখানে চোরের আবির্ভাব হয়েছে রাত দুটোর পরে।
সদাশিব শুধোলেন, এ কথা কেমন করে জানলেন?
জয়ন্ত বললে, খুব সহজেই। ভিজে মাটির উপরে রয়েছে কয়েকটা স্পষ্ট পায়ের দাগ। নিশ্চয়ই চোরের পদচিহ্ন। কালকের প্রবল বৃষ্টিপাতের ভিতরে চোর এখানে এলে সব পায়ের দাগ ধুয়ে মুছে যেত। হ্যাঁ, পায়ের দাগেও বেশ বিশেষত্ব আছে।
তিনকড়ি সাগ্রহে বললেন, কী বিশেষত্ব?
–যথাসময়ে প্রকাশ্য বলতে বলতে জয়ন্ত আবার জানালার ফাঁক দিয়ে গলে ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়াল। তারপর নিম্নস্বরে আবার বললে, তিনকড়িবাবু, একটা কথা জিজ্ঞাস্য আছে।
—আজ্ঞা করুন।
–আপনি কি আলমারির ভিতর থেকে কেতাবখানা মাঝে মাঝে বার করতেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, করতুম। দেখতুম নোটগুলো যথাস্থানে আছে কি না।
—তখন নিশ্চয়ই ঘরের ভিতরে আপনি একলা থাকতেন?
–সে কথা জিজ্ঞাসা করাই বাহুল্য।
জানালার ভিতর দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে জয়ন্ত নিজের মনে কী ভাবতে লাগল কিছুক্ষণ। তারপর শুধোলে, রাস্তার ওপারে ওই যে লাল রঙের বাড়ি রয়েছে, ওখানা কার বাড়ি?
–যদুবাবুর। আমার এক বিশেষ বন্ধু।
—তার পাশের ওই হলদে বাড়িখানা?
–মাধববাবুর। তিনিও আমার বিশেষ বন্ধু।
—আচ্ছা, অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ করছি, একটি ছোট্টখাট্ট ভদ্রলোক বারবার দরজার ওপাশ থেকে উঁকিঝুঁকি মারছেন, উনি কে?
তিনকড়ি বললেন, আমিও দেখেছি। ওঁরই নাম যদুবাবু।
যদুবাবুও জয়ন্তের প্রশ্ন শুনতে পেলেন। দরজার সামনে এসে তিনি বললেন, জয়ন্তবাবু, ক্ষমা করবেন। আমি আমার কৌতূহল সংবরণ করতে পারছিলাম না। কে না জানে, আপনি হচ্ছেন এক আশ্চর্য যাদুকর গোয়েন্দা। আজ এখানে এসে আবার কি যাদু সৃষ্টি করেন তাই দেখবার জন্যে আমার আগ্রহের আর সীমা নেই।