জয়ন্ত শেষটা নাচার হয়ে বললে, মানিক, আমাকে রক্ষা করো ভাই! আমি নিজের গুণকীর্তন করতে পারব না কিছুতেই। তুমিই না-হয় ওঁদের দু-একটা মামলার কথা শোনাও।
তাই হল। জয়ন্তের কাহিনি নিয়ে মানিক ঘণ্টা দুই সকলকে মাতিয়ে রাখলে।
তারপর সদাশিববাবু ঘোষণা করলেন, আর নয়, এইবারে খাবার সময় হয়েছে।
আসর ভাঙল।
কিন্তু খেতে বসতে না বসতেই আকাশ বলে ভেঙে পড়ি! বজ্রের হুঙ্কার, ঝড়ের চিৎকার, গঙ্গার হাহাকার! বিদ্যুতের পর বিদ্যুতের অগ্নিবাণের আঘাতে কালো আকাশ যেন খানখান হয়ে গেল। তারপর ঝড় কাবু না হতে হতেই শুরু হল বৃষ্টির পালা। আর সে কি যে সে বৃষ্টি। দেখতে দেখতে মাটির বুক হয়ে গেল জলে জলে জলময়!
সদাশিব বললেন, জয়ন্ত, মানিক! আজ আর বাড়ি যাবার নাম মুখে এনো না। বাড়িতে ফোন করে দাও, আজ এখানেই তোমরা রাত্রিবাস করবে।
জয়ন্ত বললে, তথাস্তু।
।।দুই ।।
সকালে সদাশিব বললেন, যাবার আগে চা পান করে যাও।
মানিক বললে, সাধু প্রস্তাব।
অনতিবিলম্বে চায়ের সঙ্গে এল আরও কিছু কিছু। এবং চায়ের পেয়ালায় দু-একটা চুমুক দিতে না দিতেই হন্তদন্তের মতো ছুটে এসে তিনকড়িবাবু বললেন, আমার সর্বনাশ হয়েছে।
সদাশিব বললেন, ব্যাপার কী তিনকড়িবাবু?
—চোরে আমার বিশ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়েছে।
জয়ন্ত বললে, থানায় খবর পাঠিয়েছেন?
—পাঠিয়েছি। পুলিশ এখনও আসেনি। কিন্তু পুলিশ আসবার আগে আপনাকে আমি চাই।
জয়ন্ত সবিস্ময়ে বললে, আমাকে!
–আজ্ঞে হ্যাঁ পুলিশের চেয়ে আপনার উপরেই আমার বেশি বিশ্বাস।
—আমাকে মাপ করবেন। এ সব সাধারণ চুরির মামলা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই। না। পুলিশ অনায়াসেই এ রকম মামলার কিনারা করতে পারবে।
তিনকড়ি করুণ স্বরে বললেন, সদাশিববাবু, আমার মতন লোকের কাছে এ চুরি সাধারণ চুরি নয়। ওই বিশ হাজার টাকার দাম আমার কাছে কত, আপনি তা জানেন। আপনি দয়া। করে আমার জন্যে জয়ন্তবাবুকে একটু অনুরোধ করেন–
সদাশিব বললেন, বেশ, তা করছি। জয়ন্ত, আমারও ইচ্ছা–
জয়ন্ত বাধা দিয়ে বললে, আর বলতে হবে না, তোমার ইচ্ছা কী বুঝেছি। কিন্তু নিমন্ত্রণ খেতে এসে চুরির মামলা নিয়ে জড়িয়ে পড়বার ইচ্ছা আমার মোটেই নেই। বড়ো জোর তিনকড়িবাবুর মুখে চুরির বিবরণ শুনে ঘটনাস্থলে একবার চোখ বুলিয়ে আসতে পারি। তার বেশি আর কিছু আমি পারব না।
তিনকড়ি আশান্বিত হয়ে বললে, আমার পক্ষে তাই হবে যথেষ্ট।
।। তিন ।।
জয়ন্ত শুধোলে, আপনার টাকাগুলো কোথায় ছিল?
—একতলায়, আমার পড়বার ঘরে বইয়ের আলমারির ভিতরে।
–বলেন কী, অত টাকা রেখে দিয়েছিলেন বইয়ের আলমারির ভিতরে!
–দোতলার ঘরে আমার লোহার সিন্দুক আছে বটে, কিন্তু বছর চারেক আগে একবার চোর এসে সিন্দুক থেকে তিন হাজার টাকা নিয়ে গিয়েছিল, তাই তার ভিতরে আর দামি কিছু রাখতে ভরসা হয় না।
–টাকাগুলো ব্যাংকে জমা রাখেননি কেন?
–তাই তো রেখেছিলুম জয়ন্তবাবু। কিন্তু গেল বছরে ভিতরে ভিতরে খবর পাই, আমার ব্যাংক লাল বাতি জ্বালবার আয়োজন করছে। তাড়াতাড়ি টাকা তুলে আনলুম আর তারই দিন ছয়েক পরে ব্যাংক দরজা বন্ধ করলে, অনেক হতভাগ্যের সর্বনাশ হল। ব্যাপার দেখে আমি এমন নার্ভাস হয়ে গেলুম যে, টাকাগুলো আর কোনও ব্যাংকেই জমা রাখতে পারলুম না।
—আপনার বাড়িতেই যে অত টাকা আছে, এ খবর আর কেউ জানত?
—আমি তো জনপ্রাণীর কাছে ও টাকার কথা বলিনি।
—কিন্তু ব্যাংক থেকে যে আপনি টাকা তুলে এনেছেন এটা তো অনেকেই জানে?
—তা জানে বটে।
—আর নতুন কোনও ব্যাংকে আপনি টাকা জমা রাখেননি, এ খবরটাও তো কেউ কেউ রাখতে পারে?
তাও পারে বটে। কিন্তু চোর কেমন করে জানবে যে এত জায়গা থাকতে আমি বইয়ের আলমারির ভিতরেই অত টাকা লুকিয়ে রেখেছি?
—তিনকড়িবাবু, এ চোর হচ্ছে সন্ধানী। সে কেমন করে আপনার পড়বার ঘরে ঢুকেছে?
–সেটা খালি আমার পড়ার ঘর নয়, আমার বৈঠকখানাও। তার দক্ষিণ দিকে হাতআষ্টেক চওড়া আর বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটুখানি জমি আছে, তার পরেই সরকারি রাস্তা। চোর সেই বেড়া টপকে এসেছে। প্রথমে খড়খড়ির পাখি তুলে ফাক দিয়ে আঙুল গলিয়ে জানলা খুলেছে। তারপর কোনও তীক্ষ্ণ অস্ত্র বা বাটালি দিয়ে একটা গরাদের গোড়ার দিককার কাঠ খানিকটা কেটে ফেলে গরাদটাও সরিয়ে ফেলেছে। তারপর ঘরে ঢুকে নিজের চাবি দিয়ে আলমারি খুলে টাকা নিয়ে সরে পড়েছে। কিন্তু এখনও আমি এই ভেবেই আশ্চর্য হচ্ছি যে টাকা সে আবিষ্কার করলে কেমন করে?
-কেন?
——টাকাগুলো আমি সাধারণ ভাবে রাখিনি। দপ্তরিকে ফরমাজ দিয়ে আমি ঠিক কেতাবের মতো দেখতে একটি বাক্স তৈরি করিয়ে ছিলুম আর তারই ভিতরে রেখেছিলুম বিশ খানা হাজার টাকার নোট। আলমারির বাইরে থেকে দেখলে বাক্সটাকে সোনার জলে নাম লেখা একখানা সাধারণ বই ছাড়া আর কিছুই মনে করবার উপায় ছিল না।
—পড়বার ঘরই আপনার বৈঠকখানা? সেখানে তাস-দাব-পাশার আসরও বসত?
—তা বসত বই কি, রোজ নয়—শনি-রবিবারে আর ছুটির দিনে।
—সে আসরে নিয়মিত ভাবে অনেকেই আসতেন?
–আমার বন্ধুর সংখ্যা বেশি নয় জয়ন্তবাবু নিয়ামত ভাবে আমাদের বৈঠকে যে ছয় সাত জন
লোক আসেন, চুরির খবর পেয়ে তাঁরা সকলেই আমার বাড়িতে ছুটে এসেছেন, আপনি সেখানে গেলেই তাদের দেখতে পাবেন।
–বেশ, তবে তাই হোক। পুলিশের আগেই আমি ঘটনাস্থলে হাজির হতে চাই।
।। চার ।।