কিন্তু সওকত হচ্ছেন মস্তবড়ো সবজান্তা—যুদ্ধ না করেও সেরা যোদ্ধা। তিনি মহা খাপ্পা। হয়ে সেনাপতিদের যা মুখে আসে তাই বলে গালাগালি দিতে লাগলেন।
সে গালাগালি দীর্ঘকাল ধরে সহ্য করতে না পেরে সেনানীরা রাগের মাথায় অশ্বারোহী ফৌজ নিয়ে জলাভূমির ভিতর দিয়েই বাংলার সৈন্যদের আক্রমণ করতে চললেন।
হাবলা সওকত জানতেন না, কত ধানে হয় কত চাল! তিনি ভাবলেন, আমার ঘোড়সওয়াররা যখন হামলা দিতে ছুটেছে, তখন লড়াই তো ফতে হয়ে গিয়েছেই! আমি আর এখানে দাঁড়িয়ে মিছে মাথা ঘামিয়ে মরি কেন?
নিজের তাবুর ভিতরে ঢুকে তিনি বললেন, লে আও ভাং। নাচো, গাও, ফুর্তি করো!
তাঁবুর ভিতরে চলছে যখন নবাবি ফুর্তির হুল্লোড়, জলাভূমির উপরে তখন সিরাজের কামানগুলো ঘন ঘন হুমকি দিয়ে হু হু করে ছুটিয়ে দিয়েছে অগ্নিময় মৃত্যুঝড়! পূর্ণিয়ার অশ্বারোহীরা দলে দলে হতাহত হয়ে জলাভূমিকে করে তুললে রক্তরাঙা! অবশেষে তারা আর অসম্ভবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারলে না, ছত্রভঙ্গ হয়ে দিকে দিকে পলায়ন করতে লাগল।
সেনাপতিরা তখন পলায়মান সৈনিকদের আবার উৎসাহিত করবার জন্যে তাঁবুর ভিতর থেকে সওকতকে বাইরে টেনে আনলেন। কিন্তু নবাব বাহাদুরের তখন শশাচনীয় অবস্থা নেশার চোটে আর দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। সকলে মিলে ধরাধরি করে তাকে হাতির উপরে তুলে দিলে। কিন্তু কাকে তিনি উৎসাহিত করবেন? রণক্ষেত্রে তখন উপস্থিত আছে মাত্র পনেরো-ষোলো জন পূর্ণিয়ার সৈনিক।
শত্রুপক্ষের এক গুলিতে সওকত ইহলোক ত্যাগ করলেন সেই বেহুঁস অবস্থাতেই। মাটির উপরে পড়ে গেল নবাবের রত্নখচিত উষ্ণীষ।
মণিহারির যুদ্ধে জয়ী হয়ে সিরাজ ব্যর্থ করে দিলেন মিরজাফরের প্রথম ষড়যন্ত্র।
১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ হচ্ছে বিজয়ী সিরাজের জীবনে সবচেয়ে মহিমময়। ফিরিঙ্গিরা পলাতক, প্রতিদ্বন্দ্বী সওকত পরাজিত ও নিহত, বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের থোতা মুখ ভোঁতা— সিরাজদ্দৌলা হচ্ছেন বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার একাধিপতি।
—————
(১) অনুরূপ দুর্ঘটনা ঘটেছিল ইউরোপের ওয়াটার্ল যুদ্ধক্ষেত্রে যেখানে ফরাসি নেপোলিয়ন হারেন, ইংরেজ ওয়েলিংটন জেতেন। ভিক্টর হিউগো বলেন—ফরাসিরা হেরে গিয়েছিল খালি কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির জন্যে। হঠাৎ বর্ষা নেমে যদি ফরাসিদের বারুদের গাদা ভিজে না যেত, তবে জার্মান সেনাপতি কুচার নূতন সৈন্য নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হবার অনেক আগেই ওয়েলিংটন হেরে ভূত হয়ে যেতেন। নেপোলিয়নের প্রচণ্ড আক্রমণে কাবু হয়ে প্রায় হাল ছেড়ে ওয়েলিংটন আকুলভাবে বলে উঠেছিলেন—হয় রাত্রি আসুক, নয় আসুক ব্লচার, হে ভগবান? এবং ব্লচার এসে ইংরেজদের মান ও প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। ক্লাইভও পালিয়ে গিয়ে আমবাগানে লুকিয়ে রাত্রি কিংবা মিরজাফরের সাহায্যের জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন। পলাশিতেও বৃষ্টি এসে সিরাজের বারুদের গাদা ভিজিয়ে না দিলে এবং মিরজাফর বিশ্বাসহন্তা না হলে ইংরেজদের জয়লাভের কোনও আশাই ছিল না।
(২) আমাদের বক্তব্য বিষয় হচ্ছে—সিরাজের বিজয়-অভিযান। সুতরাং অন্ধকূপ-হত্যার প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। এবং ওই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা না করবার আর একটা কারণ হচ্ছে, ও ব্যাপারটা নিয়ে ঐতিহাসিকরা পরস্পর বিরোধী মত পোষণ করেন। অবরুদ্ধ কলকাতার গভর্নর হলওয়েল বলেন, ঘটনাটা ঘটেছিল—১৪৬ জন ইংরেজ কারারুদ্ধ হয়েছিল অন্ধকূপের মধ্যে। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং আরও কেউ কেউ (যেমন মিঃ লিটল) প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন, অন্ধকূপ-হত্যার কাহিনি একেবারেই অমূলক। এই মত অনুসারেই ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট পর্যন্ত অবশেষে কলকাতার লালদিঘি থেকে অন্ধকূপ-হত্যার স্মৃতিস্তম্ভ সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্যার যদুনাথ সরকার এবং আরও কারুর কারুর মতানুসারে, অন্ধকূপ হত্যা-কাহিনি হয়তো একেবারেই ভিত্তিহীন নয়। কিন্তু হলওয়েল অত্যুক্তি করেছেন, কারণ অন্ধকূপের ২৬৭ বর্গ ফুট আয়তনের মধ্যে ১৪৬ জন ইংরেজের স্থান সংকুলান হওয়া অসম্ভব। খুব সম্ভব বন্দি ইংরেজদের সংখ্যা ষাটজনের বেশি ছিল না।
এখানে আর একটা কথা উল্লেখযোগ্য। অন্ধকূপ বা ব্ল্যাক হোল হচ্ছে ইংরেজদেরই দ্বারা নির্মিত কারাগার। সিরাজ কখনও তা চোখেও দেখেননি, তার আয়তনের কথাও জানতেন না। বন্দি ইংরেজ সৈনিকরা মাতাল হয়ে রক্ষীদের মারধর করতে থাকে। রক্ষীরা সিরাজের কাছে গিয়ে অভিযোগ করে। সিরাজ জিজ্ঞাসা করেন, এখানে ফিরিঙ্গিদের কোনও কারাগার আছে? তারা অন্ধকূপের নাম করে। সিরাজ হুকুম দেন, মাতাল ফিরিঙ্গিগুলোকে যেন তার ভিতরে আটক করে রাখা হয়। যে ডালে বসেছিল মাতলামি করে সেই ডাল কাটতে গিয়ে দুর্বত্ত ইংরেজদের ঝাপ দিতে হয়েছিল স্বখাত সলিলেই। অন্ধকূপ হত্যা আংশিকভাবে সত্য হলেও সিরাজের উপরে কোনোই দোষারোপ করা যায় না।