পরদিনের (১৯শে জুন) অবস্থা আরও সঙ্গীন। আর্মেনিয়ান ও ইউরেশীয়ান সৈন্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আর লড়াই করতে চাইলে না। ইউরোপীয় সৈন্যদেরও প্রায় সেই অবস্থা, তারা অস্ত্রধারণ করে রইল অত্যন্ত নাচার ভাবেই। অনেকেই দিশেহারা হয়ে কেল্লা ছেড়ে জাহাজে গিয়ে উঠে বসল। গভর্নর ড্রেক ও সেনাধ্যক্ষ মিঞ্চিনও প্রমাদ গুণে যঃ পলায়তি স জীবতি ভেবে চটপট চম্পট দিলেন জাহাজের উদ্দেশে।
আর্মেনিয়ান ও ইউরেশীয়ানদের বাদ দিলেও দুর্গের মধ্যে তখনও সক্ষম শ্বেতাঙ্গ যোদ্ধা ছিল একশো সত্তর জন। গভর্নর ও সেনাপতির কাপুরুষতা দেখে তারা খাপ্পা হয়ে উঠল। সকলে মিলে তাদের পদচ্যুত করে গভর্নর ও সেনাধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত করলে হলওয়েলকে।
হলওয়েল শত্রুদের বাধা দেবার শেষ চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু সফল হলেন না। নবাবের সেপাইদের অত্যুগ্র অগ্নিবৃষ্টির সামনে দুর্গপ্রাকারে তিষ্ঠানেই অসম্ভব, শ্বেতাঙ্গরা দলে দলে হল পপাত ধরণীতলে।
সেই রাত্রে দুর্গের চারিদিককার বাড়িঘর দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল। ইংরেজ সৈন্যরাও তখন আর সেনানীদের হুকুম মানতে রাজি হল না, তারা মদের ভাণ্ডার লুটে বেহেড মাতাল হয়ে হই হই করে বেড়াতে লাগল। অনেক ইউরোপীয় সৈন্য দুর্গ থেকে বেরিয়ে পড়ে সিরাজের পক্ষে যোগদান করলে।
পরদিন ২০শে জুন রবিবার। হলওয়েলও হাল ছাড়তে বাধ্য হলেন। গঙ্গার বুকে তখনও জাহাজের উপরে গভর্নর ড্রেক প্রভৃতি পলাতক ইংরেজরা বিরাজ করছিলেন। হলওয়েল সঙ্কেত করে তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। ড্রেক ইচ্ছা করলেই নৌকা পাঠিয়ে হলওয়েল প্রভৃতিকে উদ্ধার করতে পারতেন। কিন্তু তখন তাঁর আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছে, আবার এই বিপজ্জনক স্থানে এসে নবাবি গুলি হজম করবার সাহস তার হল না। তারপর বীরবর বোধকরি চাচা আপন বাঁচা প্রবাদেরই কথা স্মরণ করে জাহাজ নিয়ে সরে পড়লেন পলতার বন্দরের দিকে।
বেলা চারটের সময়ে নবাবের সৈন্যরা চারিদিক থেকে পাঁচিল টপকে কেল্লার ভিতরে লাফিয়ে পড়ল। যারা বাধা দেবার চেষ্টা করলে তারা হল কচু কাটা। হলওয়েল তখন আত্মসমর্পণ করলেন সদলবলে। কলকাতার পতন হল।
কলকাতার ও বাংলার অন্যান্য জায়গায় বিলাতি কুঠি সিরাজের হস্তগত হওয়ার ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কিছু কম এক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল। সাধারণ ব্যক্তিদেরও। হারাতে হয়েছিল এক কোটি ষাট লক্ষ টাকা। ওলন্দাজ ও ফরাসি বণিকরাও ভয়ে ভয়ে সিরাজের হাত তুলে দিয়েছিলেন যথাক্রমে সাড়ে চারি লক্ষ ও সাড়ে তিন লক্ষ টাকা।
তিন দিন পরে কলকাতা জয় ও ফিরিঙ্গি দলন করে সিরাজ মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়ে বিজয়োৎসবের আয়োজন করলেন মহাসমারোহে।(২)
।। সাত ।।
পুত্রহীন আলিবর্দির তিন কন্যার সঙ্গে তার তিন ভ্রাতুষ্পত্রের বিবাহ হয়েছিল। মধ্যম। ভ্রাতুস্পুত্র সৈয়দ আহম্মদ পেয়েছিলেন পূর্ণিয়ায় নবাবি করবার ভার। তিনি পরলোক গমন করবার পর তার ছেলে সওকত জং হলেন পূর্ণিয়ার নবাব (১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ)। সেই সময়েই সিরাজ করেন মাতামহের সিংহাসনে আরোহণ।
ছোটো মাসির ছেলে সিরাজ তার চেয়ে বয়োকনিষ্ঠ হয়েও হবেন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সর্বময় কর্তা, এটা সওকতের মোটেই ভালো লাগল না। তার ধারণা হল আলিবর্দির সিংহাসনের উপরে তারই দাবি সর্বাগ্রে। তার উপর বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর তখন থেকেই সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করেছিলেন। তিনি সওকতকে মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করবার জন্যে গোপনে প্ররোচনা দিতে লাগলেন।
সওকতও টোপ গিলতে দেরি করলেন না। তিনি দিল্লির বাদশার উজির ইমাদ-উলমুল্ককে এক কোটি টাকা উৎকোচ দিয়ে নিজের নামে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব বলে ফারমান আনিয়ে মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করবার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগলেন এবং সিরাজকে সোজাসুজি জানিয়ে দিতে কসুর করলেন না যে—ভালোয় ভালোয় সুড়সুড় করে সিংহাসন থেকে নেমে পড়ো। ঢাকায় গিয়ে আমার তবে থেকে চাকরি করো!
সওকতের দম্ভ পূর্ণ করবার জন্যেই সিরাজ সসৈন্যে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ইংরেজরা নিজমূর্তি ধারণ করে বলে পিছনে শত্ৰু রেখে তিনি পূর্ণিয়ায় যেতে পারেননি। জুন মাসে কলকাতার পতন ও ইংরেজ বিতাড়িত হল বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নেমে এল বাদলের ঘনঘটা। তারপর বর্ষাকাল কাটিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে সিরাজ আবার বেরিয়ে পড়লেন সদলবলে।
সওকত ছিল একেবারেই অপদার্থ জীব। তার হামবড়া ভাবের জন্যে কেহই তাকে পছন্দ করত না। সর্বদাই তিনি নেশায় চুর হয়ে ইয়ারদের সঙ্গে নর্তকীদের নাচগান নিয়ে মেতে থাকতেন।
সিরাজের সেনাপতি রাজা মোহনলাল সর্বাগ্রে নিজের ফৌজ নিয়ে পূর্ণিয়ায় প্রবেশ করলেন। মণিহারি নামক স্থানের কাছে সওকতও সসৈন্যে এগিয়ে এলেন সিরাজকে বাধা দেবার জন্যে।
সৈন্যবলে সিরাজ ছিলেন সওকতের চেয়ে অধিকতর বলীয়ান। কিন্তু পূর্ণিয়ার ফৌজের সামনে ছিল এক বিস্তীর্ণ জলাভূমি, যা উত্তীর্ণ হওয়া সহজসাধ্য নয়। কাজেই সিরাজের গোলন্দাজরা জলাভূমির এপারে দাঁড়িয়েই কামান দাগতে লাগল। সওকতের গোলন্দাজদের সেনাপতির নাম শ্যামসুন্দর, জাতে বাঙালি কায়স্থ। তিনিও দাগতে লাগলেন নিজেদের কামান।
দুই পক্ষে কামানযুদ্ধ চলছে, এমন সময়ে সওকত নিজের অশ্বারোহী সেনাদলকে অগ্রসর হবার জন্যে হুকুম দিলেন।
প্রবীণ সেনাপতিরা নারাজ। বললেন, ওই অগ্নিবৃষ্টির মধ্যে দুর্গম জলাভূমির জল-কাদা পার হবার চেষ্টা করলে আমাদের সকলকেই মারা পড়তে হবে।