বেদুইন বললে, আচ্ছা।
খানিক বাদে উট বললে, মহাশয়, মাথা আর বুক তো ঠান্ডা হল, কিন্তু দেহের বাকি অংশ যে ঝলসে যাচ্ছে। ওটুকুকে আর বাইরে রাখি কেন?
বেদুইন বললে, আচ্ছা ভিতরে এসো।
উট নিজের গোটা দেহ নিয়ে তাঁবুর ভিতরে ঢুকল। ছোট্ট তাঁবু, একসঙ্গে উট আর বেদুইনের ঠাঁই হল না। অতএব উটকে ভিতরে রেখে বেদুইনকেই বেরিয়ে যেতে হল তাঁবুর বাইরে।
এ দেশে এসে ফিরিঙ্গি বণিকরাও অবলম্বন করেছিল তথাকথিত উষ্ট্রনীতি।
প্রথমে তারা বিবিধ পণ্য নিয়ে এখানে পদার্পণ করে। কিছু কিছু জমি ইজারা নেয়। মাথা রাখবার জন্যে ঘরবাড়ি বানায়। তারপর নানা অছিলায় দুর্গ প্রভৃতি নির্মাণ করতে থাকে। তারপর ক্রমে ক্রমে ভিন্ন মূর্তি ধারণ করে।
কিন্তু ধূর্ত ফিরিঙ্গি বণিকরা নবাব-বাদশাদের চোখে ধূলো দিতে পারেনি।
পর্তুগিজরা যখন হুগলিতে অন্যায় রূপে প্রবল হয়ে ওঠবার চেষ্টা করছিল, তখন ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট সাজাহান সৈন্য পাঠিয়ে দেন তাদের উৎখাত করবার জন্যে। মোগল সাম্রাজ্যের সেই পূর্ণগৌরবের যুগেও পর্তুগিজরা সহজে বাগ মানেনি। জলপথে ও স্থলপথে মোগলদের তারা প্রাণপণে বাধা দেয়। প্রায় তিন মাস ধরে লড়াই করে মোগলদের ঠেকিয়ে রেখে অবশেষে পর্তুগিজরা পরাজয় স্বীকার করে। তাদের বন্দি করে আগ্রায় সাজাহানের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বন্দিদের কেউ কেউ মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে মুক্তি পায়, কিন্তু অধিকাংশই ভোগ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এই ব্যাপারের পর থেকে বাংলা দেশে শক্তি হিসাবে পর্তুগিজদের বিষদাঁত একেবারে ভেঙে যায়।
পর্তুগিজদের পর ইংরেজদের পালা। কিন্তু অনেক আগেও ইংরেজরা জোর যার মুল্লুক তার নীতির অনুসরণ করতে ছাড়েনি। ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দেও শায়েস্তা খাঁর আমলে ইংরেজরা একবার হিজলি নামক স্থানে মোগলদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল। তারপর ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে নানা লযোগের সুযোগে তারা কলকাতায় পুরাতন ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ নির্মাণ করে। তারপর নব মুর্শিদকুলি খাঁ ১৭১৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের আর কোনও নূতন দুর্গ নির্মাণ করতে নিষেধ করে দেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই ইংরেজরা বাংলা দেশে প্রধান হয়ে ওঠবার চেষ্টা করে। মোগল বাদশাহেব রাজশক্তি তখন যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে। দেখে ইংরেজরা সাহস পেয়ে বাংলা দেশে আবার কেল্লা তৈরি ও ফৌজ গঠন করতে চায়।
কিন্তু নবাব আলিবর্দিও নির্বোধ নন। কারণ ইতিমধ্যেই তিনি দেখেছিলেন, ফরাসি ফিরিঙ্গি দুপ্লে ঠিক ওই উপায়েই দাক্ষিণাত্যের মুসলমান শাসকদেরও চেয়ে প্রবল হয়ে উঠেছে। ইংরেজদের ডেকে তিনি বলেন, তোমরা হচ্ছ সওদাগর, তোমাদের আবার কেল্লার দরকার কী? আমিই যখন তোমাদের রক্ষা করবার ভার নিয়েছি, তখন আর কোনও শত্রুকেই তোমাদের ভয় করবার দরকার নেই।
আলিবর্দির জীবদ্দশাতেই সিরাজ যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। অল্পবয়সেই তিনি রাজ্যচালনার কূটকৌশল কিছু কিছু আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন এবং মাতামহের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন একাধিক রণক্ষেত্রে। রীতিমতো বালকবয়সেই সিরাজ পেয়েছিলেন সেনাচালনার ভার। মুতাক্ষেরীন পাঠে বোঝা যায়, রণক্ষেত্রে শত্রুর সামনে নির্ভীক ভাবে দাঁড়িয়ে সিরাজ যাতে সৈন্যচালনায় দক্ষ হতে পারেন, সেই উদ্দেশেই আলিবর্দি তার উত্তরাধিকারী দৌহিত্রকে দিয়েছিলেন উপযোগী শিক্ষালাভের সুযোগ।
হলওয়েল বলেন, আলিবর্দি তার মৃত্যুশয্যায় নাকি সিরাজকে উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, বাংলাদেশ থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করতে। আধুনিক ঐতিহাসিক বলেন, এ উক্তির কোনও প্রমাণ নেই। প্রমাণ থাক আর না থাক, আলিবর্দি যে ইংরেজদের সুনজরে দেখতেন না, এটা সিরাজের অবিদিত থাকবার কথা নয়। তার উপরে বাল্যকাল থেকেই ফিরিঙ্গিরা ছিল তার চোখের বালি। তিনি বলতেন, ফিরিঙ্গিদের শাসন করবার জন্যে দরকার কেবল একজোড়া চটিজুতো।
এই সিরাজ সিংহাসনের অধিকারী হয়েছেন বলে কলকাতার ইংরেজরা দস্তুরমতো তটস্থ হয়ে উঠল।
।। ছয় ।।
সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের ঝগড়া বাধল কেন? এর উত্তরে দেখানো যায় একাধিক কারণ।
রাজা রাজবল্লভ ছিলেন ঢাকার একজন পদস্থ রাজকর্মচারী। তহবিল তছরুপাতের অভিযোগে তিনি কারারুদ্ধ হন। সেই খবর পেয়ে তাঁর পুত্র কৃষ্ণবল্লভ পিতার সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে গোপনে কলকাতায় পালিয়ে যান এবং ইংরেজরাও তাঁকে আশ্রয় দিয়ে করে অন্যায়কে সমর্থন।
এই বে-আইনি কার্যের প্রতিবাদ করে সিরাজ কলকাতায় ইংরেজদের কাছে দূত প্রেরণ করেন। উদ্ধত ইংরেজরা দূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়।
দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে অতিশয় গুরুতর। আলিবর্দির নির্দেশ ছিল, ইংরেজরা আর কোনও নূতন কেল্লা তৈরি করতে পারবে না এবং ইংরেজরাও মেনে নিয়ে ছিল এই নির্দেশ।
কিন্তু গুপ্তচরের মুখে সিরাজ খবর পেলেন, ইংরেজরা কেবল কলকাতার পুরাতন দুর্গেরই সংস্কার করছে না, বাগবাজারের খালের ধারে একটি নূতন উপদুর্গও নির্মাণ করেছে। শর্ত অনুযায়ী ইংরেজরা এ কাজ করতে পারে না এবং এটা হচ্ছে নবাবের তাঁবেদার হয়েও তার প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করা। কোনও স্বাধীন নৃপতিই এমন অপমান সহ্য করতে পারেন না।
সে-সময়ে সিরাজের হাত ছিল জোড়া। তার আত্মীয় পূর্ণিয়ার নবাব সওকত জং তখন বিদ্রোহী হয়েছেন, নিজেকে বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার অধীশ্বর বলে ঘোষণা করেছেন। আগে এই বিদ্রোহ দমন করা দরকার। অতএব শর্তভঙ্গ করার জন্যে প্রতিবাদ করে ইংরেজদের কাছে এক দূত পাঠিয়ে সিরাজ মুর্শিদাবাদ থেকে সসৈন্যে বেরিয়ে পড়লেন সওকতের নবাবির স্বপ্ন পণ্ড করে দেবার জন্যে।