।। চার ।।
পরদিন পলাশির প্রান্তর দিয়ে রেলগাড়ি যখন ঊধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে, কামরার জানলার কাছে বসে মানসনেত্রে দেখলুম এক মর্মস্পর্শী দৃশ্য….
ধু ধু করছে পলাশির প্রান্তর। প্রভাতসূর্য করছে কিরণ বিকিরণ। গঙ্গার তরঙ্গভঙ্গে উচ্ছলিত হয়ে উঠছে স্বর্ণাভ রৌদ্র। আম্রকানন এক লক্ষ বৃক্ষে পরিপূর্ণ। তারই সামনে ইংরেজদের সেনাদল। দলে তারা ভারী নয়—সংখ্যায় তিন হাজার দুই শত জন মাত্র।
পলাশি গ্রামের সামনে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। ছাউনির ভিতর থেকে কাতারে কাতারে বাংলার সৈন্য প্রান্তরের উপরে বেরিয়ে আসতে লাগল—সংখ্যায় তারা প্রায় পঞ্চাশ হাজার। প্রান্তরের দুই মাইল ব্যাপী স্থান আচ্ছন্ন করে নবাবি সৈন্যরা রচনা করলে অর্ধচন্দ্র ন্যূহ। সেই ব্যহ অগ্রসর হয়ে ইংরেজদের ফৌজকে ঘিরে ফেলতে পারে অনায়াসেই, তখন গঙ্গাজলে ঝাপ দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনও উপায় থাকবে না। ইংরেজদের পক্ষে বাধা দেওয়া অসম্ভব—পঞ্চাশ হাজারের বিরুদ্ধে তিন হাজার!
ঘোর নির্ঘোষে বেজে উঠল কাড়া-নাকাড়া, সদর্পে উড়তে লাগল বাংলার পতাকা, আকাশ-বাতাস পরিপূর্ণ হয়ে গেল বাঙালি বীরদের বিজয়হুঙ্কারে।
চোখের সামনে জেগে উঠল দুই নায়কের অশ্বারোহী ও অস্ত্রধারী দৃপ্ত মূর্তি—মিরমদন ও মোহনলাল।
দেখলুম তরুণ সিরাজকে। মিরজাফরকে তিনি মিনতি করছেন এবং বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর তাকে দিচ্ছেন শূন্যগর্ভ মৌখিক আশ্বাস।
আম্রকাননের সামনে দেখলুম মসীজীবী অসিধারী জালিয়াত ক্লাইভকেও। নবাবের বৃহতী বাহিনীর রণহুঙ্কার শ্রবণ করে বক্ষ তাঁর কেঁপে কেঁপে উঠছে মুহুর্মুহুঃ। বিপক্ষ সৈন্যসাগরে তার নগণ্য ফৌজ তলিয়ে যাবে ক্ষুদ্র তটিনীর মতো। তার একমাত্র আশা বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের নিশ্চেষ্ট। মিরজাফর যদি সিরাজকে সাহায্য করেন, তাহলে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার!
বাংলার গোলন্দাজরা কামানের পর কামান দাগতে শুরু করলে—ঘন ঘন বজ্রনাদ, হু হু করে ছুটে আসে নিরেট অগ্নিপিও, লুটিয়ে পড়ে মরণাহত ইংরেজ সৈন্য। আধ ঘণ্টার মধ্যে ত্রিশজন ইংরেজ সৈন্য নিহত ও আহত!
ক্লাইভ প্রমাদ গুণে চার করে হুকুম দিলেন—আর এ ফর্দা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা। নয়! পিছিয়ে পড়ো—সবাই পিছিয়ে পড়ে আম্রকুঞ্জে আশ্রয় নাও!
ইংরেজরা বেগে আমবাগানের ভিতরে পালিয়ে গেল—আত্মগোপন করলে বড়ো বড়ো গাছের গুড়ির আড়ালে।
তারপরেই আচম্বিতে আকাশ ভেঙে বজ্রপাত এবং ধারাপাত। ঘনবর্ষণে পলাশির মাঠ হয়ে উঠল বিশাল জলাভূমির মতো।
সমস্ত বারুদ ভিজে স্যাৎসেঁতে। নীরব হয়ে গেল সিরাজের অগ্নিহীন কামানগুলো!(১) নিজেদের কামানগুলো অকর্মণ্য দেখে বীর মিরমদন কিছুমাত্র দমলেন না। তিনি ভাবলেন, বৃষ্টিপাতের ফলে তাঁদের মতো ইংরেজদেরও সমস্ত বারুদ ভিজে গিয়েছে। অতএব তার আদেশে নবাবের অশ্বারোহী সৈন্যদল মহাবিক্রমে ইংরেজদের আক্রমণ করবার জন্যে অগ্রসর হল।
কিন্তু না, ইংরেজদের বারুদ ভিজে যায়নি, তারা বুদ্ধিমানের মতো বারুদের স্কুপ ঢাকা দিয়ে রেখেছিল। তাদের কামানের গোলাগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে আক্রমণােদ্যত নবাব সৈন্যদের উপরে গিয়ে পড়তে লাগল। সাংঘাতিক আঘাত পেয়ে সেনানায়ক মিরমদন বীরের মতো প্রাণ দিলেন সম্মুখসমরে।
তখনও ইংরেজরা আমবাগান ছেড়ে বাইরে মুখ বাড়াতে সাহস করলে না, কারণ তখনও ব্যাঘ্র-বিক্রমে যুদ্ধ করছে কাশ্মীরি হিন্দু মোহনলালের অধীনস্থ সৈন্যগণ এবং নবাবের বৈতনিক ফরাসি সৈনিকরা।
কিন্তু অবশেষে বেইমান মিরজাফর ও রায়দুর্লভ প্রমুখ শয়তানরাই করলে বাংলার সর্বনাশ। প্রায় আটত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে এতক্ষণ তারা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল অচল কাঠের পুতুলের মতো। এখন চুপিচুপি দূত পাঠিয়ে ক্লাইভকে আক্রমণ করবার পরামর্শ দিয়ে বিশ্বাসঘাতী মিরজাফর প্রভৃতি সসৈন্যে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে লাগলেন।
তারপর?
তারপর আমার মানসনেত্র হল অশ্রুবাষ্পকুল, আর কিছু দেখতে পেলুম না। তারপরের কথা লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়, কিন্তু তা আর এখানে পড়ে শোনাবার দরকার নেই, কারণ আজ আমি বলতে বসেছি সেই বালক-বীর বিজেতা সিরাজের কাহিনি, যিনি বিজাতীয় ফিরিঙ্গি বণিকদের স্পর্ধা সহ্য করেননি, তাদের কলকাতা থেকে দূর করে দিয়ে তবে ছেড়েছিলেন।
।। পাঁচ ।।
যেমন অনেক দাগি অপরাধী পুলিশের চোখে ধূলো দেবার জন্যে বাইরে নিরীহ দোকানি সেজে দোকান চালায়, কিন্তু ভিতরে ভিতরে করে চুরি ও রাহাজানি, এদেশে এসে ইংরেজরাও সেই নীতিই অবলম্বন করেছিল।
বাইরে তারা নির্বিরোধী বণিক ছাড়া যেন আর কিছুই নয়। বাজারে নিজেদের মাল বেচে কিছু লাভের সাত সাগরে পাড়ি দিয়ে তারা এ দেশে আসে এবং ধরনধারণে জাহির করে, যেন তারা নবাব-বাদশার দাসানুদাস।
কিন্তু তলে তলে তাদের আসল ফন্দি ছিল—ছুঁচ হয়ে ঢুকব, ফাল হয়ে বেরুব।
একটি বিখ্যাত গল্প আছে। আরব দেশের মরুভূমিতে তাঁবু খাটিয়ে বাস করত এক বেদুইন।
দুপুরের ঝাঝালো রোদে পুড়ে মরুবালু আগুন হয়ে উঠেছে। এমন সময়ে একটা উট পুঁকতে ধুকতে এসে বললে, মহাশয়, রোদের তাপে প্রাণ যায়। আপনার এই তাবুর ছায়ায় মাথাটা একটু গলিয়ে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেব কি?
বেদুইন দয়াপরবশ হয়ে বললে, আচ্ছা।
অল্পক্ষণ পরে উট বললে, মহাশয়, মাথা তো বাঁচল, কিন্তু বুক যে জ্বলে যায়! তাবুর ভিতরে বুক পর্যন্ত রাখতে পারব কি?