শেষটা আমি সাব্যস্ত করলুম, এতটা যুক্তিহীনতা কিছুতেই সম্ভবপর নয়। ওই মূর্তির কোনও অস্তিত্বই নেই, ও কাল্পনিক মূর্তি, ঘটনাক্ষেত্রে তাকে টেনে আনা হয়েছে, অন্য কোনও ব্যক্তির স্বার্থের অনুরোধে।
সেই ব্যক্তি কে? নিশ্চয়ই হরিচরণ! তার সাধুতা আর বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে নরেনবাবুর কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তার সার্টিফিকেট মূল্যহীন, সাধুতার আবরণে সর্বদাই নিজেদের ঢেকে রাখে বলেই অসাধুরা আমাদের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করতে পারে। আবার মানুষের মন এমন আশ্চর্য বস্তু যে, সত্যিকার সাধুও সময়ে সময়ে হঠাৎ অসাধু হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, হরিচরণ, ওই হরিচরণ! কালো চশমাপরা মূর্তিটার সৃষ্টি হয়েছে তারই উর্বর মস্তিষ্কের মধ্যে। নিজে নিরাপদ হবে বলে হরিচরণই ওই রহস্যময় কাল্পনিক মূর্তিটাকে টেনে এনেছে ঘটনাক্ষেত্রে। অতএব–
অতএব হরিচরণকে ডেকে এনে খানিক নাড়াচাড়া করলেই পাওয়া যাবে মামলার মূল সূত্র।
।। তিন ।।
ঠিক এই সময়েই ঘরের বাইরে ডাক শুনলুম—মানিক, অ মানিক! তুমি এখানে আছ নাকি?
এ জয়ন্তের কণ্ঠস্বর! তাড়াতাড়ি উঠে ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দেখি, উঠানের রোয়াকের উপরে হাস্যমুখে দাঁড়িয়ে আছে জয়ন্ত।
—ব্যাপার কী! তুমি কোখেকে
—তোমার রবিবাসরীয় আড্ডায় গিয়েছিলুম তোমাকে অন্বেষণ করতে কিন্তু সেখানে গিয়ে খবর পেলুম তোমার আজকের আসর এইখানে।
নরেনবাবুর সঙ্গে জয়ন্তের পরিচয় করিয়ে দিলুম। তিনি তাকে সাদরে ঘরের ভিতরে নিয়ে এলেন।
জয়ন্ত শুধোলে, ডাক্তারবাবু, আপনি হঠাৎ আমার মানিক অপহরণ করেছেন কেন?
–আজ্ঞে, মানিকবাবুর হাতে আমি একটা মামলার ভার অর্পণ করেছি।
—বটে, বটে, বটে! মানিকও তাহলে আজকাল স্বাধীনভাবে গোয়েন্দার ভূমিকা গ্রহণ করতে চায়! বেশ, বেশ উন্নতিই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম।
আমি একটু লজ্জিত ভাবে বললুম, না ভাই জয়ন্ত, আমি তোমার উপযুক্ত শিষ্য হতে পেরেছি কি না, সেইটেই আমি আজ পরীক্ষা করতে এসেছি।
—দেখছেন ডাক্তারবাবু, বন্ধুবর মানিকের বিনয়েরও অভাব নেই। এ হচ্ছে আসল গুণীর লক্ষণ! তারপর মানিক, মামলাটার মধ্যে তুমি প্রবেশ করতে পেরেছ তো?
—মনে হচ্ছে পেরেছি। মামলাটার কথা তুমি শুনতে চাও?
—আপত্তি নেই।
তারপর দুই চক্ষু মুদে জয়ন্ত আমার মুখে মামলাটার আদ্যপান্ত শ্রবণ করলে। সেই কালো চশমাধারী মূর্তি ও হরিচরণ সম্বন্ধে আমার মতামতও তাকে চুপি চুপি জানিয়ে রাখতে ভুললুম না।
জয়ন্ত চোখ খুলে উঠে দাঁড়িয়ে, তারপর টেবিলের সামনে গিয়ে ডাক্তারবাবুর নিজস্ব চেয়ারের উপর বসে পড়ল। তারপর পূর্ব দিকের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নিষ্পলকনেত্রে। তারপর মুখ নামিয়ে টেবিলের প্যাডের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে। তারপর মৃদু হেসে চুপ করে বসে রইল প্রায় সাত-আট মিনিট ধরে। তার মুখ। সম্পূর্ণ ভাবহীন; কিন্তু আমি বুঝতে পারলুম, তার মন এখন অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ সে জিজ্ঞাসা করলে, ডাক্তারবাবু, ঘটনার দিন যখন আপনি বাইরে যান, তখন এই টেবিলের প্যাডের উপরে আর কোনও কাগজপত্র ছিল?
–না।
–তোমার বিশ্বাস ভুল।
–কী করে জানলে?
—ওই দ্যাখো প্যাডের পরে ছড়ানো লাল কালির মাঝখানে রয়েছে একটা চতুষ্কোণ (কিন্তু সমচতুষ্কোণ নয়) সাদা জায়গা। এ জায়গায় কালি লাগেনি কেন?
—ওখানে বোধহয় কোনও কাগজপত্র ছিল। কালির ধারা তার উপর দিয়েই বয়ে গেছে।
–এতক্ষণে তোমার বুদ্ধি কিঞ্চিৎ খুলেছে দেখে সুখী হলুম।
নরেনবাবু বলে উঠলেন, না মশাই, সেদিন ওই প্যাডের উপরে নিশ্চয়ই কোনও কাগজপত্র ছিল না।
জয়ন্ত সায় দিয়ে বলল, আপনিও ঠিক কথাই বলেছেন ডাক্তারবাবু। তবু এই সাদা অংশটার সৃষ্টি হল কেন, শুনুন। চোর টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে প্রথম প্যাডের তলা থেকে নোটগুলো বার করে নেয়। তারপর সেগুলো প্যাডের উপরেই রেখে গুনে দেখে। ঠিক সেই সময়েই তার গায়ের আলোয়ান বা অন্য কিছু লেগে লাল কালির দোয়াতটা হঠাৎ উলটে যায়।
আমি চমৎকৃত হয়ে বললুম, তা হলে লাল কালি পড়েছিল সেই নোটগুলোর উপর? জয়ন্ত আমার কথার জবাব না দিয়ে বললে, ডাক্তারবাবু, নোটগুলোর নম্বর নিশ্চয়ই আপনার কাছে নেই?
–না মশাই, নম্বর টুকে নেবার সময় পাইনি। তবে বিনোদবাবুর কাছে খবর নিলে নম্বরগুলো পাওয়া যেতে পারে।
জয়ন্ত উঠে দাঁড়িয়ে বললে, আজকে এখনই খবর দিন। নম্বরগুলো পেলেই আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবেন। এখন আমি বিদায় নিলুম, হয় কাল সন্ধ্যার সময়ে নয় দুইএক দিন পরেই আপনার সঙ্গে আবার দেখা করব—এটা চিত্তাকর্ষক হলেও সহজ মামলা। চলো মানিক। নমস্কার ডাক্তারবাবু!
রাস্তায় এসে জয়ন্তকে জিজ্ঞাসা করলুম, কে চোর সে বিষয়ে তুমি কিছু আন্দাজ করতে পেরেছ।
জয়ন্ত ক্রুদ্ধস্বরে বললে, আমি এইটুকুই আন্দাজ করতে পেরেছি যে তুমি হচ্ছ একটি গাড়ল, একটি গর্দভ, একটি ইগ্নোমেরাস।
আমি একেবারে দমে গেলুম।
।। চার ।।
সোমবারের সন্ধ্যা। জয়ন্তের পিছনে গুটি গুটি যাত্রা করলুম নরেনবাবুর বাড়ির দিকে। দেখছি কাল বৈকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত এবং আজ সকাল থেকে বৈকাল পর্যন্ত সে বাড়ির বাইরেই কাটিয়ে দিয়েছে। তার কার্যকলাপ সম্বন্ধে একটি ছোটোখাটো ইঙ্গিত পর্যন্ত আমাকে দেয়নি। আজও তার মুখ এমন গম্ভীর যে কোনও কথা জিজ্ঞাসা করতেও ভরসা হল না।
নরেনবাবু বসেছিলেন আমাদেরই অপেক্ষায়। সাগ্রহে শুধোলেন, কিছু খবরাখবর পেলেন নাকি!