কয়দিনই বা তিনি সিংহাসনে বসবার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয় মাত্র আঠারো বৎসর বয়সে। কিন্তু এর মধ্যেই তার নাম করেছে অমরত্ব অর্জন। কারণ? তিনি ছিলেন স্বাধীনতা-যজ্ঞের পুরোহিত।
বালক সিরাজের ছিল যথেষ্ট বালকতা, প্রচুর দুর্বলতা। সেজন্যে তার নামে শোনা যায় অনেক কুৎসা। কিন্তু সেই নিন্দার খোলস থেকে মুক্ত করে নিলে আমরা যে সিরাজের দেখা। পাই, তিনি হচ্ছেন সোনার বাংলার খাঁটি ছেলে। দেশ মাতৃকার পায়ে পরাবার জন্যে যখন ফিরিঙ্গি দস্যুরা শৃঙ্খল প্রস্তুত করছিল এবং যখন সেই অপকর্মে তাদের সাহায্য করবার জন্যে এগিয়ে এসেছিল হিন্দু ও মুসলমান দেশদ্রোহীর দল, সিরাজ তখন তাদের বাধা দিয়েছিলেন প্রাণপণে। আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি পণরক্ষা করতে পারলেন না, তাঁকে দিতে হল প্রাণ।
এই প্রাণদান, এই আত্মদানের জন্যেই সিরাজের নাম আজ মহনীয়, বরণীয় এবং স্মরণীয়। স্বদেশের জন্যে সিরাজ দিয়েছিলেন বুকের শেষ রক্তবিন্দু।
এই জন্যেই সিরাজের সব দোষ ভুলে লোকে আজও তার জন্যে চোখের জল ফেলে পরমাত্মীয়ের মতো এবং এইজন্যেই সিরাজের মৃতদেহ আজও যেখানে ধুলার সঙ্গে ধুলা হয়ে মিশিয়ে আছে, একদিন আমি সেখানে ছুটে গিয়েছিলুম তীর্থযাত্রীর মতো।
সেখানে গিয়ে কানে শ্রবণ করলুম অতীতের গৌরববাহিনী বাণী, প্রাণে অনুভব করলুম স্মৃতির চিতাগ্নিজ্বালা, মানসচোখে দর্শন করলুম পলাশির রক্তাক্ত দুঃস্বপ্ন।
আগে সেই কথা বলব।
।। দুই ।।
পনেরো বৎসর আগেকার কথা।
এক সাহিত্যিক বন্ধুর আমন্ত্রণে প্রথমে জিয়াগঞ্জে গিয়ে উঠলুম। জিয়াগঞ্জকে মুর্শিদাবাদের শহরতলি বলা যায়।
তারপর সেখান থেকে গঙ্গাজলে নৌকা ভাসিয়ে চললুম খোসবাগের দিকে, সেখানেই আছে সিরাজদ্দৌলার সমাধি। আমার সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় কয়েকজন যুবক।
নৌকা ভাসছে গঙ্গানদীতে, না কোনও ছোটো খালের জলে? স্থানে স্থানে শিশুরাও পায়ে হেঁটে গঙ্গা পার হয়ে যায়, এ আমি স্বচক্ষে দেখলুম। স্রোতের নাম-গন্ধও নেই। এ গঙ্গার একটিমাত্র গুণ, কলকাতার মতো জল এখানে পঙ্কিল নয়। সমুদ্রনীল স্বচ্ছ জল, তলা পর্যন্ত দেখা যায়। স্পঞ্জের মতো দেখতে পুঞ্জ পুঞ্জ শ্যাওলা ভাসে। গঙ্গার তলদেশে বার বার দৃষ্টিচালনা করেও কোনও ছোটো-বড়ো জলচর জীব আবিষ্কার করতে পারলুম না। শুনলুম কেবল বর্ষাকালেই এখানকার গঙ্গা আবার হয়ে ওঠে বেগবতী স্রোতস্বতী।
গঙ্গাতীরের দিকে তাকালে চোখে পড়ে ধ্বংসস্তুপ আর ধ্বংসস্তুপ আর ধ্বংসস্তুপ। কেবল তীরে নয়, নদীগর্ভেও ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় যেখানে সেখানে। বোঝা গেল, যেখান দিয়ে আমাদের নৌকা বয়ে যাচ্ছে, আগে সেখানেও ছিল মানুষের বসতি।
সঙ্গীরা দেখিয়ে দিলেন—ওই জগৎ শেঠের ভিটে!
জগৎ শেঠ? সারা ভারতে অদ্বিতীয় ধনকুবের বলে খ্যাতি যার ছড়িয়ে পড়েছিল, টাকার দরকার হলে যাঁর কাছে হাত পাততেন নবাব-বাদশারাও, যাঁর প্রকাণ্ড প্রাসাদ ছিল মুর্শিদাবাদের
অন্যতম প্রধান গৌরব—সেই মহীয়ান জগৎ শেঠের বাস্তুভিটা?
কিন্তু কোনও প্রাসাদই চোখে পড়ল না। কেবল গঙ্গাতীরে এবং গঙ্গানীরে দেখা গেল একটা ভাঙা স্যুপের খানিক খানিক অংশ। এখানে একটা গোরু, ওখানে একটা কুকুর এবং এক জায়গায় চুপ করে বসে আছে কী একটা পাখি।
দেশকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেবার সময়ে হিন্দুদের মধ্যে প্রধান চক্রী ছিলেন এই জগৎ শেঠ। তিনি বার বার চক্রান্ত করেছিলেন বাংলার তিন নবাবের বিরুদ্ধে—সরফরাজ, সিরাজদ্দৌলা এবং মিরকাসিম। অবশেষে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তিস্বরূপ তাকে মুঙ্গেরের গঙ্গায় ড়ুবিয়ে মারা হয় সেটা হচ্ছে মানুষের প্রতিশোেধ। তারপর এখানে তার প্রাসাদও গঙ্গাগর্ভে লাভ করেছে সলিলসমাধি—এটা হচ্ছে প্রকৃতির প্রতিশোধ। জগৎ শেঠের নিঃস্ব বংশধররা আজ উদরান্নের জন্যে পরমুখাপেক্ষী, তার বিপুল বিত্তের এক কপর্দকও আর বিদ্যমান নেই, কিন্তু ইতিহাসে অমর হয়ে আছে তার বিশ্বাসঘাতকতার ঘৃণ্য কাহিনি।
আবার শুনলুম-ওই নবাব আলিবর্দির টাকশাল! ইতিহাসে লেখে, নবাবের টাকশালের অস্তিত্ব ছিল জগৎ শেঠের প্রাসাদের চৌহদ্দির মধ্যেই। সেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছে দুতিনটে জীর্ণ দেওয়াল—তাদের উপরে নেই ছাদের আবরণ।
আবার শোনা গেল—ওই সিরাজদ্দৌলার প্রমোশালা! সিরাজদ্দৌলা ছিলেন বৃদ্ধ আলিবর্দির নয়নের মণি। দাদুর কাছে আবদার ধরে রাশি রাশি টাকা ফেলে তিনি ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে যে রম্য প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, হিরা ঝিলের স্বচ্ছ জলে সে দেখত তার নিজের প্রতিচ্ছবি। সিরাজের পতনের পরে ক্লাইভের সঙ্গে মিরজাফর এসে এই প্রাসাদের মধ্যেই বাংলার মসনদে আরোহণ করেছিলেন।
কিন্তু আজ বুজে গিয়েছে সে হিরা ঝিল। বাংলার শূন্য মসনদ স্থানান্তরিত। প্রমোদশালার বদলে দেখলুম পুঞ্জীভূত রাবিশ!
যদুপতির সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছে মথুরাপুরী এবং শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছে অযোধ্যা ধাম। এখানেও হয়েছে সেই মহাকাল নাটকের পুনরাভিনয়।
।। তিন ।।
নৌকা ভিড়ল কূলে। সূর্য তখন অস্তগত। শেষবেলার আলো করছে পালাই পালাই।
অন্তরের মধ্যে আসন্ন সন্ধ্যার বিষন্নতাকে অনুভব করতে করতে অগ্রসর হলুম খোসবাগের সমাধিমন্দিরের দিকে।
নদীর বালুকাশয্যার পরেই বনজঙ্গল। তার মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে এলোমেলো এবড়ো-খেবড়ো ধুলোয় ধুলোয় ধূলিময় সংকীর্ণ পথ। চারিদিক নির্জন—জনপ্রাণীর সাড়া নেই। সেদিন চতুর্দশী–এখনও চাঁদের উঁকি মারবার সময় হয়নি।