তারপর সন্দেহ হল, খাটের তলায় বোধ হয় কেউ লুকিয়ে আছে।
আবার উঠলুম। লণ্ঠন নিয়ে খাটের তলায় একবার উঁকি মেরেই শিউরে এক লাফে আবার উপরে উঠে পড়লুম।
খাটের তলায় মেঝের উপরে এঁকেবেঁকে একটা একহাত লম্বা সাপ স্থির হয়ে পড়ে আছে।
এমন বিপদে কেউ পড়ে? খাটের উপরে আড়ষ্ট মূর্তির মতো বসে প্রায় অর্ধ অচেতনের মতো শুনতে লাগলুম বৃষ্টির শব্দ, ঝড়ের চিঙ্কার, অরণ্যের কান্না, ব্যাঘ্রের গর্জন।
আমার সেই সময়ের মনের ভাব, খণ্ডগিরির ডাকবাংলোয় রাত্রির ধ্বনি নামে একটি কবিতায় ফোটাবার চেষ্টা করেছিলাম। কবিতাটি অনেককাল আগে ভারতীতে ও আমার যৌবনের গান পুস্তকে প্রকাশিত হয়েছে। তার কয়েক লাইন এখানে তুলে দিলুম
চুপ চুপ! ওই শোন-রম্-ঝম্ রম্-ঝম্!
ঝঞার ঝনঝন—চারধার গম-গম!
আঁৎ সব ছাৎ-ছাৎ, স্যাঁৎ -স্যাঁৎ, হিম-হিম,
ঢাক মুখ, বোজ চোখ ঝিঝিম্ ঝিম্ ঝিম্!
দুদ্দাড় ভাঙ দ্বারঝড় দেয় ঝাপটা,
বাঁশডাল টলটল-ফেঁসফোঁস সাপটা!
কুকুর ঘেউ-ঘেউ-ব্যাঘ্রের দলবল
ঝরনার ঝক্কর-বন্যার কলকল!
বিছনায় আইঢাই, জান যায়, জান যায়,
ক্রন্দন হায়-হায় আন্ধার আবছায়।
ভয়-ভয় সবদিক—এই দিক, ওই দিক–
কে ধায়, কে চায়, কে গায়, নেই ঠিক!
কই চাঁদকই, কই,—আয় ভোর আয় আয়!
প্রাণটা হিমসিম জান যায়, জান যায়!
নিদ্রাদেবী সে রাত্রে আমার কাছে ঘেঁষতে সাহস করলেন না এবং কাছে এলেও আমি তাঁকে আমল দিতুম না। সেই ভাবেই ছবিতে আঁকা মানুষের মতো স্থির হয়ে সারারাত খাটের ওপরে বসে রইলুম।
অবশেষে ঝড় পালাল, বৃষ্টি থামল, বাঘ বিদায় নিলে, ভোর হল।
কিন্তু আমি এখন খাট থেকে নামি কেমন করে? পা বাড়ালেই সাপ-বেটা যদি ফোস করে কামড়ে দেয়?
সাপটা এখনও খাটের তলায় আছে কি না দেখবার জন্যে খুব সাবধানে হেঁট হয়ে একটুখানি মুখ বাড়ালুম।
আশ্চর্য! সে ঠিক তেমনি এঁকেবেঁকে সেইখানেই আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে। তবে কি ওটা মরা সাপ?
সকালের সঙ্গে সঙ্গে তখন আমার সাহসও ফিরে এসেছে। হাতের কাছেই আমার লাঠিগাছা ছিল, সেটা তুলে নিয়ে মেঝের ওপরে বার কয়েক খটাখট শব্দ করলুম। তারপর আবার মুখ বাড়িয়ে দেখি, সাপটা একটুও নড়েনি।
তখন ভরসা করে লাঠিটা দিয়ে লাগালুম এক খোচা সাপটার আড়ষ্ট দেহ খানিক তফাতে গিয়ে ছিটকে পড়ল, এতটুকু নড়ল না!
একটা আস্বস্তির নিশ্বাস ফেলে খাট থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে দেখি, সেটা হচ্ছে স্বাভাবিক রং করা রবারের সাপ, কলকাতার খেলনার দোকানে কিনতে পাওয়া যায়।
বাংলোর বেয়ারা আসতেই সাপটাকে তুলে তার দিকে ছুড়ে ফেলে দিলুম।
সে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গেল।
আমি বললুম, থাম থাম, অত চাঁচাতে হবে না। ওটা রবারের সাপ।
রবারের?
হ্যাঁ। ওই খাটের তলায় ছিল। কিন্তু ওটা কোত্থেকে এল?
খানিকক্ষণ রবারের সাপটার দিকে চেয়ে ভাবতে ভাবতে বেয়ারার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললে, কাল সকালে এক বাবু বাড়ির ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এখানে এসেছিলেন। ওই সাপটাকে এক খোকার হাতে দেখেছিলুম। খোকাই বোধহয় ওটাকে ভুলে ফেলে গিয়েছে।
সম্ভব। কিন্তু অজানা এক খোকার ভুলের জন্যে শাস্তি পেলুম আমি, নিয়তির এটা সুবিচার নয়।
উড়িষ্যায় বেড়াতে এসেছিলুম আমি পাঁচবার। কিন্তু এই খণ্ডগিরি থেকে ফেরবার পথে আরও দু-বার উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল।
একবার সন্ধ্যার মুখে ভুবনেশ্বরে ফিরে যাচ্ছি। পথের পাশের ঝোপে ঝোপে গা ঢাকা দিয়ে একটা চিতাবাঘ অনেকদূর পর্যন্ত অনুসরণ করেছিল আমাদের গোরুর গাড়িকে। সম্ভবত তার দৃষ্টি ছিল গোরুদুটোর ওপরে।
আর-একবার কয়েকটি বন্ধুর সঙ্গে খণ্ডগিরির ডাকবাংলোয় উঠেছি।
উড়ে বেয়ারাকে জিজ্ঞাসা করা হল, এখানে সস্তায় মুরগি পাওয়া যায় কি না?
পাওয়া যায় শুনে মুরগি কেনবার জন্যে তখনই তাকে একটা টাকা দেওয়া হল।
তার পথ চেয়ে সকলে বসে আছি। ঘণ্টা তিনেক পরে বেয়ারা মস্ত এক বস্তা কঁাধে করে এসে হাজির।
ব্যারিস্টার-বন্ধু শ্ৰীযুক্ত সতীশচন্দ্র ভড় সবিস্ময়ে বললেন, এ কী ব্যাপার, একটিমাত্র টাকায় এক বস্তা মুরগি! এত সস্তা!
পাছে বস্তার মধ্যে মুরগিগুলো দম বন্ধ হয়ে মারা পড়ে সেই ভয়ে চটপট বস্তার মুখ খুলে ফেলা হল। দেখা গেল আমাদের ভয় অমূলক, মারা পড়বার কোনও উপায়ই নেই।
কারণ বস্তার মধ্যে রয়েছে কেবল কাড়ি কাড়ি মুড়কি। হতচ্ছাড়া উড়ে-বেয়ারা মুরগি আনেনি, কিনে এনেছে এক টাকার মুড়কি!
সিরাজের বিজয়-অভিযান
[সিরাজের বিজয়-অভিযান দেবসাহিত্য কুটীরের বার্ষিকী পরশমণিতে প্রথম প্রকাশিত হয়।]
।। এক ।।
এই অঞ্চলেই আগে ছিল প্রাচীন কর্ণসুবর্ণ। তারপর তার নাম হয় মাকসুসাবাদ। তারপর মুর্শিদাবাদ।
মহানগরী মুর্শিদাবাদ।
স্বাধীন বাংলার শেষ রাজধানী। বিস্ময়বিমুগ্ধ ক্লাইভ যাকে দেখে লন্ডনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে বর্ণনা করেছিলেন।
আজ সেখানে গেলে দেখা যায়, ধুলায় ধূসর হয়েছে তার গর্বোদ্ধত শির। যে ধুলার বিছানায় পড়ে আছে কঙ্কালসার মুর্শিদাবাদের জরাজীর্ণ মৃতদেহ, সেই ধুলার সঙ্গে কিন্তু মিশিয়ে আছে সুদূর এবং নিকট অতীতের কত মানুষের স্মৃতি!
হিন্দুদের হর্ষবর্ধন, শশাঙ্ক, মহীপাল, রানি ভবানী ও মোহনলাল এবং মুসলমানদের হোসেন সা, মুর্শিদকুলি খাঁ, আলিবর্দি খাঁ, মিরমদন–
এবং সিরাজদ্দৌলা।
মিরজাফর ও মিরকাসিম বাংলায় নকল নবাবির অভিনয় করেছিলেন মাত্র। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব হচ্ছেন সিরাজদ্দৌলা।