করদ রাজ্য সেরাইকেলা হচ্ছে উড়িষ্যার আর একটি দেশ, এখন মধ্যপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। বছর তিনেক আগে সেরাইকেলার মহারাজা বাহাদুরের আমন্ত্রণে আমি দেশ-বিদেশে সুপরিচিত শ্ৰীযুক্ত হরেন ঘোষের সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলুম। প্রথম দিন বৈকালে পথে বেরিয়েই আধ মাইলের ভেতরেই পরে পরে তিনটি বাচ্চা সাপের সঙ্গে দেখা হল! স্থানীয় লোকদের ডেকে হরেন জিজ্ঞাসা করলেন, ওগুলো কী সাপ? তারা যে নাম বললে তা স্মরণে নেই, কিন্তু আর-একটি যে খবর দিলে তা ভোলবার নয়। তারা বললে, সেরাইকেলায় নাকি সময়ে সময়ে আকাশ থেকে সর্পবৃষ্টিও হয়। এ কথা সত্য কি না জানি না, কিন্তু যে তিন দিন সেরাইকেলায় ছিলুম আমি আর বাড়ি থেকে বেরোইনি। যে-দেশে সর্পবৃষ্টি হয় এবং পথে পথে পদে পদে সাপ করে কিলবিল সেখানে ছাদের তলার চেয়ে ভালো ঠাঁই আর নেই।
এইবারে একত্রিশ বছর আগেকার কথা বলি।
যাচ্ছি গরুর গাড়িতে চড়ে ভুবনেশ্বর থেকে খণ্ডগিরির দিকে। এ পথে তোমরা অনেকে নিশ্চয় গিয়েছ। দু-ধারে খেত, মাঠ, জঙ্গল, মাঝখানে মেটে পথ। তোমরা এ পথে গিয়ে নিরাপদেই ফিরে এসেছ, কিন্তু সেবার আমার যাত্রাটাই ছিল খারাপ। তিনবার তিন রকম সাপের সঙ্গে দেখা হয় যে যাত্রায়, তাকে ভালো বলি কেমন করে?
খণ্ডগিরি যাওয়ার পথে ছোট্ট একটি নদী বা নালা। গোরুর গাড়ি অনায়াসেই সেটা পার হয়ে গেল।
আরও খানিক এগিয়েই গাড়োয়ান গড় থামিয়ে ফেলে একটা ঝোপের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে।
সেদিকে ভালো করে তাকাতে-না-তাকাতেই দেখি, গাছের ওপর থেকে মাঝারি আকারের একটা অজগর নীচের একটা ছাগলের ওপরে ঝাপিয়ে পড়ে তার মাথার দিকটা কামড়ে ধরলে এবং তারপরেই তারা হারিয়ে গেল ঝোপের ভেতরে। কেবল ঝোপটা দুলতে লাগল ঘন ঘন।
সঙ্গীরা ভয় পেয়ে গাড়োয়ানকে আবার ভুবনেশ্বরে ফিরে যেতে বললেন।
কিন্তু গাড়োয়ান আবার গাড়ি চালিয়ে দিয়ে বললে, ভয় নেই বাবু, ও সাপ এখন শিকার নিয়েই ব্যস্ত হয়ে থাকবে, আমাদের দিকে ফিরেও চাইবে না।
অনেকের মতো আমারও আগে ভুল বিশ্বাস ছিল যে, অজগররা প্রথমে ল্যাজ দিয়ে জড়িয়ে শিকার ধরে। সেদিন ভুল ভাল।
তারপর খণ্ডগিরি ও উদয়গিরির তলায় গিয়ে হাজির হলুম যথাসময়ে। ওখানকার বর্ণনা আর দেব না, কারণ ১৩১৬ সালের ভারতী পত্রিকার সে বর্ণনা দিয়েছি।
ওখানে পাহাড়ের ওপরে ছোটো-বড়ো অনেক গুহা আছে—কোনওটির নাম রানিগুহা, কোনওটির নাম ব্যাঘ্রগুহা, কোনওটির নাম সর্পগুহা। কি সর্পগুহায় সাপ দেখিনি, দেখলুম আর একটি গুহায় গিয়ে। ভেতরে কালো রঙের মস্ত-বড়ো একটা ঝুড়ির মতন কী ওটা? ভালো করে পরীক্ষা করবার জন্যে কাছে এগিয়েই দেখি, প্রচণ্ড তীব্র দুটো হিংসুক চোখ নিষ্পলক হয়ে আমার পানে তাকিয়ে আছে! সাপ! অজগর সাপ! এমন প্রকাণ্ড ও স্থূল অজগর সাপ জীবনে আমি আর দেখিনি!
শুনেছি সাপের চোখে সম্মােহনী শক্তি আছে। আছে কি না জানি না, কিন্তু সেই অতিক্রুর দৃষ্টির সামনে আমার পা যেন পাহাড়ের পাথরের মধ্যে ঢুকে গেল আধ ইঞ্চি, আর নড়াতে পারলুম না। সঙ্গীরা তখনও নীচে, কিন্তু তাদের ডাকবার ক্ষমতাও হল না। প্রতি মুহূর্তে মনে হতে লাগল, এইমাত্র পথে ছাগলটার যে দুর্দশা দেখেছি আমারও অদৃষ্টে আজ তাই লেখা আছে।
প্রাণের আশা যখন একেবারেই ছেড়ে দিয়েছি, সাপটা তখন হঠাৎ কুণ্ডলি থেকে মাথা তুলে গুহার দেওয়ালের কোণে একটা বড়ো গর্তের ভেতরে ঢুকতে লাগল ধীরে ধীরে, খুব ধীরে! তার দেহ ঢুকছে আর ঢুকছেই, যেন তার শেষ নেই!
তখন সাড় হল। আমার প্রতি অজগরের এই অসম্ভব অনুগ্রহের কারণ বুঝতে পারলুম। না, বুঝতে চেষ্টাও করলুম না, পাগলের মতো দৌড় মেরে নীচে এসে সকলের কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে সব কথা বললুম।
শুনে সঙ্গীরা তখনই পাহাড় থেকে নেমে গাড়িতে উঠে বসলেন। আমার উপরে সেদিন বোধ হয় শনির দৃষ্টি ছিল, বললুম, তোমরা যাও, আমি পরে যাব! আমাকে খণ্ডগিরির সম্বন্ধে
প্রবন্ধ লিখতে হবে, গুহাগুলোর মাপজোক না নিয়ে আমার ফেরবার উপায় নেই।
আমি থেকে গেলুম। তারপর মাপজোক নিতে নিতে কখন যে বেলা পড়ে এসেছে এবং আকাশে যে পুরু মেঘের উদয় হয়েছে, মোটেই তা খেয়ালে আসেনি। হঠাৎ গায়ে দু-চার ফোটা জল পড়তেই তাড়াতাড়ি পাহাড় থেকে নামতে লাগলুম।
নীচে যখন নেমেছি, এমন তোড়ে বৃষ্টি এল যে দৌড়ে ডাকবাংলোয় ঢােকা ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না।
সন্ধ্যার অন্ধকারের সঙ্গে যখন মেঘের অন্ধকার আরও ঘনিয়ে উঠল, বৃষ্টির সঙ্গে জাগল বিষম ঝোড়ো হাওয়া। বুঝলুম আজ এই নির্জন পার্বত্য অরণ্যেই দুর্যোগের রাত্রি কাটাতে হবে একাকী!
বাংলোর বেয়ারার কাছে খবর নিয়ে জানলুম, আপাতত খাবারের কোনও ব্যবস্থাই হতে পারে না।
অদৃষ্টকে ধিক্কার দিয়ে একটা লণ্ঠন চেয়ে নিয়ে ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে খাটে উঠে শুয়ে পড়লুম।
কী ঝড়! কী বৃষ্টি! অরণ্যের মর্মর আর্তরব, পাহাড়ের গা বেয়ে হুড় হুড় করে জল নেমে আসার শব্দ, মড় মড় করে গাছের ডাল ভেঙে পড়ার আওয়াজ এবং সেই সঙ্গে আচম্বিতে জেগে উঠল ক্ষুধার্ত বা ক্রুদ্ধ বা জল-ঝড়ে বিপন্ন এক ব্যাঘের গর্জনের পর গর্জন!
একলা সেই অচেনা ঘরে শুয়ে চারিদিকেই বিভীষিকার ছবি দেখে ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠতে লাগলুম। একবার মনে হল ঘরের দরজা বন্ধ করিনি, বাঘটা যদি ভিতরে ঢুকে পড়ে? তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দেখি,—না, দরজায় খিল দেওয়াই আছে!