অনেকক্ষণ পরে বাবুর জ্ঞান হল। তার দুর্দশার ইতিহাস শুনে সকলে স্তম্ভিত হয়ে গেল।
বাবু ক্ষীণস্বরে বললেন, পরের ট্রেনে আমি এখান থেকে পালাব। পরের স্টিমারে আমি ভারতবর্ষে ফিরে যাব। আমার চাকরি চাই না, আপনি বাঁচলে বাপের নাম!
ভারতীয় কুলিরা বললে, সিম্বা স্টেশনে আমাদেরও আর থাকা পোযাবে না। গাছের ডালে বসে আর আমরা ঘুমোতে পারব না।
পরদিন থেকে সিম্বায় এল নতুন স্টেশনমাস্টার, নতুন কুলির দল। তাদের পরিণামের কথা ফোরানসাহেব বলেননি।
সিঙ্গির মামা ভোম্বলদাসকে কেউ দেখেনি। কিন্তু তার ভাগনেকে হাতের কাছে পেয়ে একবার একটি মানুষ কীরকম ঠকিয়ে দিয়েছিল, পৃথিবী বিখ্যাত শিকারি লেফটেনান্ট কর্নেল প্যাটার্সন সাহেবের কেতাবে তা লেখা আছে।
এ ঘটনাটিও ঘটেছিল আফ্রিকার পূর্বোক্ত রেলপথ নির্মাণের সময়ে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে হাজার হাজার কুলি কাজ করতে যেত বলে সিংহদের ভোজসভায় মহোৎসব পড়ে গিয়েছিল। এমন সুযোগ সিংহরা আর কখনও পায়নি।
সিংহ-ব্যাঘ্রদের কাছে মানুষের চেয়ে নিরীহ ও সহজ শিকার আর নেই। বনবাসী অধিকাংশ জীবেরই কামড়াবার জন্যে মস্ত ধারালো দাঁত, বা গুঁতোবার জন্যে লম্বা-লম্বা শিং, বা লাথি ছোড়বার ও পালাবার জন্যে খুরওয়ালা দ্রুতগামী পা, বা আঁচড়াবার জন্যে ভীষণ নখওয়ালা চারখানা ঠ্যাং আছে, কিন্তু মানুষ বেচারাদের সেসব কিছুই নেই। তুচ্ছ ভেড়াদেরও মতো তারা জোরসে টু পর্যন্ত মারতে পারে না এবং সাপের মতো বিষ ও পাখির মতো ডানা থেকেও তারা বঞ্চিত। মানুষকে ধরো, মারো আর গপ করে খেয়ে ফ্যালো,তারা
অতীব নিরাপদ সুখাদ্য।
সারাদিনের কাজকর্ম সেরে কুলি এবং অন্যান্য কর্মচারীরা তাঁবু খাটিয়ে অসাড়ে নিদ্রা যেত। সকালে উঠে প্রায়ই দেখত, দলের দুই-এক জন লোক কমেছে। ব্যাপারটা তাদের একরকম গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল।
এক রাত্রে তাঁবুর মধ্যে আরামে ঘুমোচ্ছিল এক গ্রিক। শীতের ঠান্ডা রাত, গ্রিক লোকটির সর্বাঙ্গ লেপে ঢাকা।
নিঝুম রাত, কিন্তু নিস্তব্ধ নয়। আফ্রিকার অরণ্য রাত্রেই বেশি করে শব্দময় হয়ে ওঠে, তার প্রত্যেক শব্দই ভয়াবহ!
একটা সিংহ নিঃশব্দে গ্রিকের তাঁবুর ভেতরে গিয়ে ঢুকল। সিংহরা যখন শিকার করতে চায় তখন টু শব্দটি করে না, তখন সে হয় মৃত্যুর মতন নীরব!
তাঁবুর ভেতরে ঢুকে সিংহ গ্রিক লোকটিকে দেখতে পেলে না, কারণ সে তখন লেপের মধ্যে অদৃশ্য। কিন্তু নরখাদক সিংহরা জানে, শীতকালে মানুষরা থাকে লেপের তলাতেই। এ সিংহটারও সে বুদ্ধি ছিল, কাজেই অন্য কোনও গোলমাল না করে সে প্রকাণ্ড এক হাঁ করে লেপ ও বিছানা একসঙ্গে কামড়ে ধরে বাইরে টেনে নিয়ে গেল।
বলা বাহুল্য গ্রিক-বাবাজির ঘুম তখন ভেঙে গিয়েছে এবং বুঝতে পেরেছে সে পড়েছে। সিংহের কবলে! কিন্তু উয়ে ভেবড়ে গিয়ে সে বোকার মতন চেঁচিয়ে উঠল না, একেবারে চুপটি মেরে রইল। সে যে জেগেছে সিংহ তা সন্দেহ করতেও পারলে না, সস্তা খোরাকের বস্তা নিয়ে মস্ত বনের ভেতরে ঢুকে পড়ল।
বনের মধ্যে দিব্যি একটি নিরিবিলি জায়গা পেয়ে সিংহ তার মোট নামিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসল। মানুষের টাটকা রক্ত-মাংসে আজকের নৈশভোজটা সুসম্পন্ন হবে, তার মনে ফুর্তি। আর ধরে না!
থাবা মেরে একটানে লেপখানা সরিয়ে দিয়েই কিন্তু দুই চক্ষু তার স্তম্ভিত! লেপের তলায় খাবার নেই। ফোক্কা!
সে যখন হিড়হিড় করে লেপ ও বিছানা টেনে আনছিল, দুষ্টু মানুষটা সেই সময়ে কোন ফাঁকে মাঝখান থেকে চুপিচুপি হড়কে বেরিয়ে সরে পড়েছে, কিছুই টের পাওয়া যায়নি!
সাপ, বাঘ, মুরগি
একত্রিশ বছর কেটে গেছে তারপর। ছোটো ছোটো বন্ধুরা, একত্রিশ বছর আগে তোমরা কোথায় ছিলে? নিশ্চয়ই বলতে পারবে না, কারণ গতজন্মের কথা এ জন্মে মনে করা যায় না।
কিন্তু একত্রিশ বছর আগে আমি কোথায় ছিলুম জানো? উড়িষ্যায়। মনে হচ্ছে এ তো সেই সেদিনের কথা!
তখনকার একটি দিনের কথা আমার মনে আজও জ্বলজ্বল করছে। বিশেষ আশ্চর্য কথা নয়, তবে লোকের কাছে বললে নিতান্ত মন্দ শোনাবে না।
উড়িষ্যায় কোনওকালে নাগ রাজার রাজত্ব ছিল কি না জানি না, কিন্তু যতবারই ওঅঞ্চলে গিয়েছি, রকম-বেরকমের সাপের সঙ্গে দেখা হয়েছে।
একবার ওখানে যেরকম গোখরো সাপ দেখেছিলুম, আজও তার জুড়ি খুঁজে পাইনি। এ সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্যে মৌচাক পত্রিকার সম্পাদক মশাইকে আহ্বান করতে পারি। আমরা কয়েকজন সাহিত্যিক ও শিল্পী বন্ধু মিলে বাসা বেঁধেছি তখন ভুবনেশ্বরে।
এক লোক সাপ খেলাতে এসে এমন এক গোখরো বার করলে যাকে দেখেই আমাদের চক্ষু স্থির! ফনা না তুললে তাকে আমরা দূর থেকে অজগর সাপ বলেই ভ্রম করতে পারতুম। ইয়া লম্বা, ইয়া মোটা! মনে হচ্ছে রং ছিল তার চকচকে ও কুচকুচে কালো। হয়তো সেটা ছিল কেউটে জাতীয়।
আমরা ছিলুম উঁচু রোয়াকের ওপরে, সাপুড়ে ছিল উঠোনে। সেই নতুন-ধরা সাপটাকে বার করবামাত্র সে ভীষণ ফোঁশ শব্দের সঙ্গে ফনা তুলে প্রায় আড়াই ফুট উঁচু হয়ে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে মৌচাক সম্পাদকমশাই ইস বলে চিৎকার করে পিছন না ফিরেই পিছন দিকে মারলেন মস্ত-লম্বা এক লক্ষ! সাপ আবার বলল, ফেঁশ! মৌচাক সম্পাদকও আবার বললেন, ইস!—এবং তারপরেই পিছন দিকে আর-একটা তেমনি লাফ! আবার ফোঁশ! আবার ইস! এবং আবার লাফ! সম্পাদকমশাইয়ের বপুখানি ভগবানের ইচ্ছায় বিলক্ষণ হৃষ্টপুষ্ট। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, বাংলাদেশে যদি কোনওদিন পিছনদিকে লাফ মারার প্রতিযোগিতা হয়, তাহলে অমন হৃষ্টপুষ্ট গুরুভার দেহ নিয়েও মৌচাক-সম্পাদক হবেন এখানকার চ্যাম্পিয়ন!