কুলিরা গাছে চড়ে রাত কাটায়। কিন্তু বাবুর সে ভরসাও হয় না, গাছে চড়ে ঘুমোবার অভ্যাস তাঁর নেই।
ভারতের বাবু, বুদ্ধি তো কম নয়। চট করে একটা উপায় আবিষ্কার করে ফেললেন।
স্টেশনের প্লাটফর্মের ওপরে পড়ে ছিল প্রকাণ্ড একটা জলের ট্যাংক, তার ভেতরে জল ছিল না।
বাবু ট্যাংকের ফোকরে মাথা গলিয়ে দেখলেন, কোনওরকমে ভেতরে তার ঠাঁই হতে পারে। খুশি হয়ে তিনি মনে মনে বললেন, সিম্বা স্টেশনের ধুম্বো সিংহ! আজ থেকে এর মধ্যে ঢুকে তোকে আমি সুবৃহৎ কদলী দেখাব! লোহার ট্যাংক তুই ভাঙতেও পারবি না, আর এই ছোট্ট ফোকর দিয়ে তোর অতখানি গতরও গলবে না! ওহো, কী মজা!
মজার কথাই বটে! বাবু তখনই কুলিদের হুকুম দিলেন, এই! ট্যাংকটাকে তোরা আমার তাঁবুর ভেতর টেনে নিয়ে যা
সে রাত্রে ট্যাংকের মধ্যে বালিশ ও বিছানা ফেলে দিয়ে বাবুও ঢুকে পড়লেন। ট্যাংকের ফোকরটা রইল ওপর দিকে। সে রাত্রেও সিংহরা মানুষের গন্ধ পাই বলে চাচাতে ও চতুর্দিকে টহল দিতে লাগল। বাবু মনে মনে হেসে বললেন, ততাদের আমি থােড়াই কেয়ার করি! আর তোরা আমাকে খুঁজে পাবি না। অনেক রাত পরে বাবু আজ নিশ্চিন্ত হয়ে নিদ্রাদেবীর সেবা করলেন।
এক রাত, দুই রাত, তিন রাত যায়। বাবু রোজ প্রাণ ভরে ঘুমোন। স্টেশনের অন্যান্য লোক বাবুর সৌভাগ্যে হিংসায় ফেটে মরে। এমন মজার শয়ন-গৃহ সিম্বা স্টেশনে আর ছিল না। কেল্লার মতো দুর্ভেদ্য শয়ন-গৃহ, পশুরাজের জারিজুরি সেখানে খাটবে না।
চতুর্থ রাত্রে এক সিংহের ভারী খিদে পেলে। খাবারের দোকান সিম্বা স্টেশনে, কিন্তু সেখানে খাবারের গন্ধটুকুও নেই। জ্যান্ত খাবারগুলো ঝুলছে উঁচু উঁচু গাছের মগডালে, লাফ মেরেও নাগাল পাওয়া যায় না।
খাবার খুঁজতে খুঁজতে সিংহ গেল স্টেশনমাস্টারের তাবুর কাছে এবং গিয়েই মানুষের গন্ধ পেলে। থাবা মেরে তাবুর কাপড় ছিড়ে সে ভেতরে ঢুকল। সেখানেও খাবার নেই!
কিন্তু গন্ধ আছে। আর শোনা গেল সুখে নিদ্রিত বাবুর নাক-ডাকার আওয়াজ! সিংহ এক লাফে ট্যাংকের ওপরে আরোহণ করলে। ফোকরে নাক রেখে ভেঁস করে এক নিশ্বাস টেনে মনে মনে বললে, কী তোফা মানুষের গন্ধ! প্রাণ জুড়িয়ে গেল!
ততক্ষণে বাবুর ঘুম ভেঙে গিয়েছে এবং ফোকরের দিকে কটমট করে তাকিয়ে তিনি নিদ্রাভঙ্গ হওয়ার মূর্তিমান কারণটিকে দেখতেও পেয়েছেন। এবং বুঝতে পেরেছেন, এই মজার শয়নগৃহের আসল মজাই হচ্ছে, এখান থেকে পালাবার কোনও উপায়ই নেই। বাইরে থাকলে ছুটে পালাবার পথ পাওয়া যেত, কিন্তু আজ তিনি মজার শয়নগৃহে থেকেই মজলেন।
সিংহ ফোকরের মধ্যে আঁকড়া চুলে ভরা হেঁড়ে মাথাটা গলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে, কিন্তু গলল না। তখন লম্বা লম্বা নখগুলো বার করে একখানা থাবা ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে সে ঘন ঘন নাড়তে লাগল-পরমান্নের কড়ায় হাত দিয়ে লোকে যেমন করে নাড়ে!
বাবু আড়ষ্ট ও চিত হয়ে ট্যাংকের তলার সঙ্গে মিশিয়ে পড়ে রইলেন—নট নড়নচড়ন। নট কিছু! এবং তাঁরই দেহের কয়েক ইঞ্চি ওপরে ক্রমাগত বোঁ বোঁ করে ঘুরছে আর ঘুরছে। আর ঘুরছে পশুরাজের বিপুল থাবা! থাবা যদি আর এতটুকু নীচে নামে, তাহলেই বঁড়শিতে গাঁথা মাছের মতো বাবুর দেহ টপ করে উঠে পড়বে ট্যাংকের ওপরে! এমন দৃশ্য কেউ কল্পনা করতে পারেন?
প্রতি মিনিটেই সেই ভয়াবহ থাবা ট্যাংকের ভেতরে নতুন নতুন দিকে ঘুরতে থাকে, আর বাবুর চোখদুটো ছানাবড়ার মতো হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে পড়তে চায় ও দাঁতে দাঁত লেগে ঠকাঠক করে আওয়াজ হয়! এই ব্যাপার চলল ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে!
তারপর পশুরাজ থাবা তুলে নিয়ে ট্যাংকের ওপরে বসে আক্রমণের নতুন ফন্দি ঠিক করতে লাগল। বাবু অল্প একটু হাঁপ ছেড়ে স্বগত বোধহয় বললেন, হে মা সিংহবাহিনী, তোমার সিংহকে সুবুদ্ধি দাও মা, তাকে অন্য কোথাও যেতে বলো!
কিন্তু সিংহের সুবুদ্ধি হল না, খানিক জিরিয়ে নিয়ে অন্য কোনও উপায় না দেখে আবার সে ট্যাংকের ভেতরে বিষম থাবা নাড়া শুরু করলে। বাবু মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান হলে পর আবার চেয়ে দেখেন, সিংহের থাবা তখনও বোঁ বোঁ করে ঘুরতে ঘুরতে তাকে খুঁজছে। আবার অজ্ঞান হয়ে যান। থাবার এত কাছে এমন টাটকা খাবার দেখে ভোম্বলদাসের ভাগনের উৎসাহ কিছুতেই কমতে চায় না। সিংহ বা মানুষ, কেউ কখনও এমন মুশকিলে ঠেকেনি।
তাঁবুর বাইরে গন্ডার, হিপোপটেমাস, হায়েনা ও অন্যান্য সিংহদের কোরাস ক্রমে ক্রমে ক্ষীণ হয়ে একেবারে থেমে গেল। অরণ্যের অন্ধকার সরিয়ে অল্পে অল্পে ঊষার আলো ফুটতে লাগল। ভোরের পাখিদের গলায় জাগল নতুন প্রভাতের আশার গান।
তখন সিংহের মনে পড়ল, আর বাসায় না ফিরলে চলবে না। বিরক্ত মনে মুখের খাবার ফেলে সে ট্যাংক থেকে নেমে পড়ে সুড় সুড় করে আবার বনের ভেতরে গিয়ে ঢুকল।
কুলিরা তখন বৃক্ষশয্যা ত্যাগ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে মহা হইচই লাগিয়ে দিয়েছে। বাবু কই? বাবু কই? এখনও বাবুর দেখা নেই, তিনিও সিংহের ফলার হলেন নাকি?
একজন ভেবেচিন্তে বললে, মজার শয়নগৃহে শুয়ে বাবু এখনও মজায় নিদ্রা দিচ্ছেন। চল, তাকে জাগিয়ে দিই গে!
মজার শয়নগৃহে উঁকি মেরে দেখা গেল, বাবু একেবারে অচেতন! এবং তাঁবুর ভেতরে পশুরাজের পদচিহ্ন! তখন আসল ব্যাপারটা আন্দাজ করতে বিলম্ব হল না। তারপর বহু কষ্টে বাবুর মৃতবৎ দেহকে টেনে বার করে আনা হল। সেই এক রাত্রেই অসম্ভব আতঙ্কে বাবুর মাথার কালো চুল পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে।