হরিহর বাবা মুস্তাফার পাকা চুল আর দাড়ি-গোঁফ সাজঘর থেকে লুকিয়ে সঙ্গে এনেছিল। নিজের বাড়িতে এসে সেইগুলো সে পরে নিলে, কারণ এবারে তাকে পাশের বাড়িতে যেতে হবে, সেখানে সবাই তাকে চেনে!
হরিহর নিজের বাড়ির ছাদ থেকে পাশের বাড়িতে গেল। সে জানত, সুরেন আজ বিয়েবাড়িতে থাকবে। প্রথমে সে সুরেনের শূন্য ঘরে ঢুকে জুতো চুরি করলে। তারপর অন্য ঘরে গিয়ে হরেনকে আক্রমণ করলে। হরেন তাকে বাধা দিতে গেল, পারলে না, কেবল হরিহরের মাথায় একগোছা পরচুলা রইল তার হাতের মুঠোয়!
ধস্তাধস্তির সময়ে ঘরের টেবিলের ওপর থেকে ঘড়িটা যে মাটিতে পড়ে ঠিক রাত বারোটায় বন্ধ হয়ে গেল, এটাও সে জানতে পারলে না। জানলে নিশ্চয়ই সাবধান হত।
খুনের পর হরিহর সুরেনের জুতো পরে রক্তের ওপরে পায়ে হেঁটে চলে বেড়াল। তারপর সরে পড়বার আগে জুতোজোড়া যথাস্থানে রেখে দিয়ে গেল।
হরিহর বুঝলে, ভ্রাতৃহত্যার অপরাধে ধরা পড়ে সুরেনের ফাসি হবেই। তখন লাখ টাকা ভোগ করবে সে একলা। এক ঢিলে মরবে দুই পাখি।
ঘণ্টা-দেড়েকের মধ্যেই হরিহর থিয়েটারে ফিরে ওপরের ঘরে ঢুকলে। কিন্তু থিয়েটারে পালিয়ে আসবার সময়ে সে যে তাড়াতাড়িতে নিজের ছদ্মবেশ খুলে ফেলতে ভুলে গিয়েছিল, পাহারাওয়ালা চন্দর সিংহের মুখে আগেই আমরা সেটা জানতে পেরেছি।…ওদিকে থিয়েটারে আলিবাবার সময়েও তাকে স্টেজে না দেখে ড্রেসার ওপরে এসে হরিহরের কপট নিদ্রা ভঙ্গ করলে। সে যে থিয়েটারেই শুয়েছিল, তারও একজন সাক্ষী রইল।
হরিহর বাবা মুস্তাফার পরচুলা পরে সে রাত্রে যখন যখন অভিনয় করতে নামল, তখন দুটি সত্য জানতে পারেনি। প্রথমটি হচ্ছে, মৃত হরেনের মুঠোর চুলের সঙ্গে মুস্তাফার মাথার ছেড়া পরচুলা মেলানো সম্ভবপর হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বাবা মুস্তাফার দাড়ির এক অংশে হরেনের রক্ত লেগে আছে।
সে নির্ভাবনায় পরচুলা সাজঘরেই রেখে গেল। এই হচ্ছে সেই পরচুলা। হরিহর নিজেই একবার পরীক্ষা করে দেখুক।
কিন্তু কে পরীক্ষা করে দেখবে? হরিহর তখন চেয়ারের ওপরে বসে-বসেই দারুণ আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে গেছে!
সুন্দরবাবু কিছুক্ষণ বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে থাকবার পর বললেন, হুম! আপনি কি তন্ত্রমন্ত্র শিখেছেন বিমলবাবু? এত অসম্ভব কথা জানলেন কী করে?
বিমল বললে, আপনিও যদি আমার মতো যত্ন করে হরেনের মুঠোর চুলগুলো পরীক্ষা করতেন তাহলেই বুঝতে পারতেন, ওগুলো রুক্ষ মরা চুল, অর্থাৎ পরচুলা। তাইতেই সর্বপ্রথমে আমার সন্দেহ হল, হত্যাকারী নিশ্চয়ই সকলকার পরিচিত লোক, তাই ছদ্মবেশ পরে খুন করতে যায়। তারপর যখন শুনলুম হরেন-সুরেনের অবর্তমানে লাখ টাকার মালিক হবে হরিহর, তখনই আমার কড়া নজর পড়ল তার ওপরে। সে থিয়েটারের অভিনেতা শুনে আমার সন্দেহ আরও দৃঢ় হল। কারণ কে না জানে, অভিনেতারাই পরচুলা নিয়ে নড়াচড়া করে? এই একটা ছোট্ট সূত্র আপনার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল বলেই আপনি গোলকধাঁধায় পথে-বিপথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।
সুন্দরবাবু নিজের গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন, স্বীকার করছি, আমি হচ্ছি মস্ত হাঁদা-গঙ্গারাম! কিন্তু, তারপর?
তারপর আর কী, পথ খুঁজে পেয়েই আমি থিয়েটারে ছুটলুম। জাল-পুলিশ সেজে খোঁজখবর নিতে লাগলুম। হ্যা, ইতিমধ্যে অ্যাটর্নি-বাড়িতেও গিয়ে খবর পেয়েছি, ওখানকার কেরানি সুবোধও হরিহরের সঙ্গে অভিনয় করে, আর লাখ টাকার উইলের গুপ্তকথা তার কাছে থেকেই হরিহর সব আগে জানতে পারে। থিয়েটারে গিয়ে প্রথমে আমি খোঁজ নিলুম, ঘটনার রাত্রে হরিহর কখন কোন নাটকে অভিনয় করেছিল। হিসাব করে দেখলুম, রাত এগারোটার পর প্রায় পাঁচঘণ্টা তাকে সাজতে হয়নি, আর সেই সময়টার মধ্যে কেউ খোঁজও নেয়নি যে, সত্যসত্যই সে থিয়েটারে আছে কিনা! তারপর আমার কাজ খুবই সোজা হয়ে গেল। এর ওপর সাজঘরে খানাতল্লাশ করে যখন বাবা-মুস্তাফার ছেড়া চুল আর রক্তাক্ত দাড়ি পাওয়া গেল, তখন আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। বাকি গল্পটা আমি আন্দাজে রচনা করেছি, কিন্তু তা যে মিথ্যা নয়, সেটা আপনারা সকলেই দেখছেন তো?…আচ্ছা। সুন্দরবাবু, আমার কাজ ফুরোল, এখন আমরা সরে পড়ি, কী বলেন?
সুন্দরবাবু তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে মহা-উৎসাহে বিমলের হাত চেপে ধরে বললেন, সে। কী, বিলক্ষণ! আমার ঘাড় থেকে এতবড়ো বোঝা নামিয়ে দিলেন, অন্তত কিছু মিষ্টিমুখ করে যান…ওরে, কে আছিস রে! শিগগির এক টাকার ভালো সন্দেশ-রসগোল্লা নিয়ে আয় তো!
বিপদ-নাট্যের দুটি দৃশ্য
প্রত্যেক মানুষেরই জীবনে ছোটো ছোটো এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যা বর্ণনা করলে গল্পের আসরে নিতান্ত মন্দ শোনায় না। বারকয়েক আমিও এমনি ঘটনা-বিপ্লবে পড়েছিলুম, অবশ্য ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। আজ গুটি দুয়েক ঘটনার কথা তোমরা শশানো। কিন্তু মনে রেখো, এ দুটি সত্য-সত্যই সত্য ঘটনা!
প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল বছর ষোলো আগে, দেওঘরে। সপরিবারে হাওয়া খেতে গিয়ে বাসা বেঁধেছিলুম উইলিয়ামস টাউনে। আমাদের বাসা ছিল ওদিককার শেষ বাড়িতে। তারপরই মাঠ আর বন, তারপর নন্দন পাহাড়।
পূর্ণিমা। নন্দন পাহাড়ের ওপরে একলাটি বসে বসে দেখলুম, পশ্চিমের আকাশকে রঙে ছুপিয়ে সূর্য নিলে ছুটি। তারপর কখন যে বেলাশেষের আলোর সঙ্গে ঝরঝরে চাঁদের আলো মিলে অন্ধকার আবির্ভূত হওয়ার পথ বন্ধ করে দিলে, কিছুই জানতে পারিনি। মিষ্টি জোছনায় চারদিক হয়ে উঠল স্বপ্নলোকের চিত্রশালার মতো। মনের ভেতর থেকে বাসায় ফেরবার জন্যে কোনও তাগিদ এল না।