তিন-চার জন লোককে দেখেছিলুম, কিন্তু কারুর ওপরে আমার সন্দেহ হয়নি!
এমন কোনও লোকই দ্যাখোনি, যার মাথায় ছিল লম্বা পাকা চুল, আর মুখে ছিল পাকা গোঁফ-দাড়ি?
চন্দর সিং অল্পক্ষণ ভেবেই বলে উঠল, হা হুজুর, দেখেছিলুম। একটা বুড়ো বাঙালিমুসলমান রাত বারোটার খানিক পরেই আমার সামনে দিয়ে হনহন করে চলে গিয়েছিল, বটে।
কী করে জানলে, সে বাঙালি মুসলমান?
তার পরনে ছিল বাঙালির মতো আলোয়ান, ধুতি আর পিরান, কিন্তু পশ্চিমা মুসলমানদের মতো তার মাথায় ছিল লম্বা পাকা চুল আর মুখে ছিল লম্বা পাকা গোঁফ-দাড়ি।
তাকে দেখে তোমার কোনও সন্দেহ হয়নি?
সন্দেহ হয়নি বটে, তবে একটা কথা মনে হয়েছিল। তার মাথার চুল আর মুখের গোঁফ-দাড়ি বেজায় বুড়োর মতন ধবধবে সাদা, কিন্তু সে হনহন করে হাঁটছিল খুব জোয়ান লোকের মতোই!
শাবাশ চন্দর সিং! এতটা তুমি লক্ষ করেছিলে? সত্যিই তুমি অসাধারণ পাহারাওয়ালা। আচ্ছা, আমার আর কিছু জানবার নেই।
সুন্দরবাবু হতভম্বের মতো বললেন, কী আশ্চর্য বিমলবাবু, এই বুড়ো বাঙালি মুসলমানটিকে আপনি আবার কোথা থেকে আবিষ্কার করলেন? আমরা পেয়েছি কেবল গাছকয়েক লম্বা পাকা চুল, কিন্তু দাড়ি-গোঁফই বা আপনি কেমন করে দেখতে পেলেন?
বিমল সহাস্যে বললে, মানস চক্ষু আর কল্পনা শক্তি ব্যবহার করলে অনেক কিছু দেখা যায় সুন্দরবাবু! আমার মত কী জানেন? হত্যাকারীকে হরেনবাবু চিনতেন, তাই সে ছদ্মবেশ পরে খুন করতে গিয়েছিল। খালি পাকা চুলে মুখ লুকোনো যায় না, গোঁফ-দাড়িরও দরকার হয়।
তাহলে আপনি বলতে চান, খুনির মাথায় পাকা চুলের তলায় ছিল কঁচা কালো চুল? আমরা যে সুরেনকে ধরেছি, তার মাথাতেও কালো চুল আছে। তবে কি সুরেনই—
বাধা দিয়ে বিমল বললে, শীঘ্রই আবার দেখা হবে, তখন সব বলব। এই বলে সে কুমারের হাত ধরে থানা থেকে বেরিয়ে গেল।
সুন্দরবাবু চেয়ারের ওপরে আড় হয়ে পড়ে মুখভঙ্গি করে বললেন, হুম! বিমলবাবু একটি আস্ত পাগল! খালি আস্ত নয়, মস্ত পাগল!
পরদিন প্রভাতে থানায় আবার বিমল ও কুমারের আবির্ভাব! তখন সুন্দরবাবুর সঙ্গে একটি যুবক অত্যন্ত উত্তেজিত ভাবে জোরে সিগারেটে দম মারতে মারতে হাত-মুখ নেড়ে কথা কইছিল। বিমল লক্ষ করলে, যুবকের মাথায় বাবরি-কাটা চুল, মুখে পাউডারের চিহ্ন, গায়ে ফুলদার পাঞ্জাবি, পরনে জরিপাড় দিশি কাপড়, পায়ে বাহারি লপেটা,হা, লোকটি রীতিমতো শৌখিন বটে!
সুন্দরবাবু বললেন, আরে, আসুন—আসুন, নমস্কার! আবার এক নতুন কাণ্ড দেখুন, জাল-পুলিশের মামলা! এখুনি আবার হন্তদন্ত হয়ে তদন্তে ছুটতে হবে! যত বদমাইশ জুটেছে কিনা আমারই এলাকায়!
বিমল বললে, জাল-পুলিশের মামলা!
হ্যাঁ এই ভদ্রলোকেরই নাম হরিহরবাবু, হরেনবাবুর খুড়তুতো ভাই। ইনি সক্কালবেলায় থানায় অভিযোগ করতে এসেছেন, কাল দুপুরে পুলিশের লোকরা নাকি ওঁদের থিয়েটারে। গিয়ে গোলমাল করে আর ওঁর সাজঘরে গিয়ে জিনিসপত্র তছনছ করে এসেছে! অথচ সত্যিকথা বলছি বিমলবাবু, আমরা এর বিন্দুবিসর্গও জানি না!
বিমল হাসিমুখে ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, নমস্কার হরিহরবাবু! আপনি নিজেই থানায় এসেছেন দেখে সুখী হলুম, কারণ, নইলে আমাদেরই এখুনি আপনার বাড়িতে ছুটতে হত!
হরিহর বিস্মিত ভাবে ফ্যালফেলে চোখে বললে, মশাইকে তো এ জন্মে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।
উহুঁ, এ জন্মেও দেখেননি, গেল-জন্মেও দৈখেননি বোধহয়। আপনি আর আমরা এক জগতে বাস করি না তো! কিন্তু আমাকে না চিনলেও আপনি এই চুল-গোঁফ-দাড়িকে চেনেন কি? বলেই বিমল একরাশ পরচুলা বার করে তুলে দেখালে।
হরিহরের মুখ হঠাৎ রক্তশূন্য হয়ে গেল। তার পরেই সামলে নিয়ে সে বললে, ওগুলো কার, আমি জানি না।
জানেন না? বেশ, বেশ, তাহলে ভালো করে বসুন, ধীরে সুস্থে একটা ছোট্ট গল্প শুনুন। এ গল্পেরও পাত্রদের নাম হরেন সুরেন দুই সহোদর, আর তাদের খুড়তুতো ভাই হরিহর। হরেন-সুরেনের নামে এক আত্মীয় এক লক্ষ টাকা দিয়ে গেলেন। কিন্তু তারা সে সৌভাগ্যের কথা টের পাওয়ার আগেই, অ্যাটনি-বাড়ির কেরানি সুবোধের মুখ থেকে হরিহর খবরটা জেনে ফেললে, কারণ তারা দুজনেই এক থিয়েটারে অভিনয় করত।
হরিহর দেখলে, রাতারাতি বড়োলোক হওয়ার এ একটা মস্ত সুযোগ! উইলের কথা এখনও কেউ জানে না, এই অবসরে হরেন আর সুরেনকে পথ থেকে সরাতে পারলেই লাখ টাকা তার হাতের মুঠোয়! হরিহর মূখ হলেও বোকা নয়, চট করে একটা শয়তানি ফন্দি এঁটে ফেললে।
সে রাত্রে তাদের থিয়েটারে বিশেষ অভিনয়, তিন-তিনটে পালা শেষ হতে রাত কাবার হয়ে যাবে। প্রথম পালা কণ্ঠহার শুরু হল সন্ধ্যার মুখে। তারপর আরম্ভ হল চন্দ্রগুপ্ত, রাত এগারোটার সময়ে। এ পালায় হরিহর সাজলে আলেকজান্ডার। মিনিট পনেরোর মধ্যে তার পার্ট শেষ হয়ে গেল। তার পরে শেষ পালা আলিবাবায় তার বাবা মুস্তাফা সাজবার কথা, অর্থাৎ মাঝে তার একটানা ঘন্টা-পাঁচেক ছুটি। হরিহর সবাইকে জানালে, নে থিয়েটারের ওপরের একটা ঘরে এই সময়টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেবে।
কিন্তু সে ঘুমোত গেল না। থিয়েটার থেকে তার বাড়ি মিনিট পনেরোর পথ। হরিহর লুকিয়ে বাড়িতে গিয়েই হাজির হল, কারণ সে জানে থিয়েটারের সবাই নিজের নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত হয়ে থাকবে, তার পার্টের সময় না হলে কেউ তাকে খুঁজবে না।