–তারপর?
—পরশু সন্ধ্যার সময়ে আমি এই ঘরে বসে আছি, এমন সময়ে বিনোদবাবু এসে তার ঋণ পরিশোধ করে গেলেন। পাঁচখানি হাজার টাকার নোট। (তখনও বাজারে হাজার টাকার নোট অপ্রচলিত হয়নি।) ঠিক তারই মিনিট পাঁচেক পরে ফোনে একটা অত্যন্ত জরুরি ডাক এল। বসন্তপুরের মহারাজা বাহাদুর ব্লাডপ্রেসারের দরুন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন, আমাকে সেই মুহূর্তেই যেতে হবে। তখনই যাত্রা করলুম। তাড়াতাড়িতে যাবার সময়ে নোট পাঁচখানা ব্লটিংয়ের প্যাডের তলায় ঢুকিয়ে রেখে গেলুম। রাজবাড়ি থেকে যখন ফিরে এলুম রাত তখন সাড়ে নটা। এসে এই ঘরে ঢুকে দেখি, প্যাডের উপর লাল কালির দোয়াতটা উলটে পড়ে রয়েছে আর প্যাডের তলা থেকে অদৃশ্য হয়েছে হাজার টাকার নোট পাঁচখানা।
আমি বললুম, নিশ্চয় প্যাডের তলা থেকে যখন নোটগুলি টেনে নিচ্ছিল, সেই সময়ে দৈবগতিকে তার হাত লেগে লাল কালির দোয়াতটা উলটে পড়ে গিয়েছিল।
—খুব সম্ভব তাই।
–কারুর উপরে আপনার সন্দেহ হয়?
—বিশেষ কারুর উপর নয়। পুলিশকে খবর দিয়েছেন?
–না।
–কেন?
–কেলেঙ্কারির ভয়ে। আমি বেশ জানি পুলিশ এসে আমার বাড়ির লোকদেরই টানাটানি করবে। আমার পক্ষে সেটা অসহনীয়। কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাড়ির কোনও লোকের দ্বারা এ কাজ হয়নি—হতে পারে না। অন্দরমহলে থাকেন আমার বৃদ্ধা মাতা, পত্নী, আমার দুই বালিকা কন্যা আর শিশুপুত্র। তাদের কারুরই এ ঘরে আসবার কথা নয়। বাড়ির প্রত্যেক দাসদাসী পুরাতন আর বিশ্বস্ত। নোটগুলো যখন প্যাডের তলায় রাখি, তখন তাদের কেউ যে এ অঞ্চলে ছিল না, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত। সুতরাং তাদের কেউ প্যাড তুলে দেখতে যাবে কেন?
—বাইরের কোনও জায়গা থেকে কেউ কি আপনার কার্যকলাপের উপরে দৃষ্টি রাখতে পারে না?
—মানিকবাবু, পরশু দিন সন্ধ্যার আগেই এই দুর্দান্ত শীতেও হঠাৎ বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল, মনে আছে কি? দেখুন, এই ঘরের উত্তর দিকে আছে চারটে জানলা আর পূর্ব দিকে আছে দুটো জানলা আর দুটো দরজা। দক্ষিণ আর পশ্চিম দিক একেবারে বন্ধ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে উত্তরের জানলাগুলোর ভিতর দিয়ে এই দরজা দেখা যায় বটে, কিন্তু বৃষ্টির ছাট আসছিল বলে উত্তর দিকের সব জানলাই বন্ধ ছিল। খোলা ছিল খালি পূর্ব দিকের জানলা-দরজা। ওদিকে আছে আমার বাড়ির উঠান, তারপর বারো ফুট উঁচু পাঁচিল, তারপর মোহনতোষবাবুর বাড়ি। আমার বাড়ির উঠানে আলো জুলছিল, আমি সেখানে জনপ্রাণীকেও দেখতে পাইনি। বৃষ্টি আর শীতের জন্যে মোহনতোষবাবুর বাড়ির জানলাগুলো নিশ্চয়ই বন্ধ ছিল, নইলে ও বাড়ির ঘরের আলোগুলো আমার চোখে পড়ত। সেদিন আমি কী করছি না করছি, কেউ তা দেখতে পায়নি।
—আপনি রাজবাড়িতে গেলে পর সেদিন অন্য কোনও রোগীর বাড়ি থেকে আর কেউ কি আপনাকে ডাকতে আসেনি?
–এসেছিল বই কি! হরিচরণের মুখে শুনেছি, পাঁচজন এসেছিল।
—হরিচরণ কে?
—সে বালক বয়স থেকেই এ বাড়িতে কাজ করে, এমন বিশ্বাসী আর সৎলোক আমি জীবনে আর দেখিনি। আমার সমস্ত আলমারি দেরাজ বাক্সের চাবি থাকে তার হাতে, আমার সমস্ত টাকা সেই-ই ব্যাংকে জমা দিয়ে আসে, তাকে না হলে আমার চলে না। আমার অবর্তমানে সেই-ই বাইরের লোকের সঙ্গে কথাবার্তা কয়।
—হরিচরণ কী বলে?
–সেদিন পাঁচজন লোক আমাকে ডাকতে এসেছিল। তাদের মধ্যে তিনজন লোক আমি নেই শুনেই চলে যায়, একজন লোক ঠিকানা রেখে আমাকে কল দিয়ে যায়, কেবল একজন লোক বলে, আমার জন্যে অপেক্ষা করবে। হরিচরণ তখন তাকে এই ঘরে এনে বসিয়ে নিজের অন্য কাজে চলে যায়। কিন্তু মিনিট দশেক পরে ফিরে এসে লোকটিকে সে আর দেখতে পায়নি। তবে এ জন্যে তার মনে কোনও সন্দেহ হয়নি। কারণ এখানে কোনও মূল্যবান জিনিসই থাকে না, আর বাইরের লোকের আনাগোনার জন্যে এ ঘরটা সর্বদাই খোলা পড়ে থাকে। হরিচরণের বিশ্বাস, আমার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে লোকটি আর অপেক্ষা না করে চলে গিয়েছিল।
—সে নাম-ধাম কিছু রেখে যায়নি?
–না।
—তার চেহারার বর্ণনা পেয়েছেন?
–পেয়েছি। তার দোহারা চেহারা, শ্যাম বর্ণ, দেহ দীর্ঘ। শীতের জন্যে সে মাথা থেকে প্রায় সমস্ত দেহটাই ঢেকে আলোয়ান জড়িয়ে রেখেছিল, দেখা যাচ্ছিল কেবল তার মুখখানা। তার চোখে ছিল কালো চশমা, মুখে ছিল কাঁচা-পাকা গোঁফ আর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশের কম হবে না।
–লোকটির চেহারার বর্ণনা কিছু অসাধারণ। আপনার কি তারই উপর সন্দেহ হয়?
–মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও মনে হয় যে, কোনও একজন বাইরের লোক আমার ঘরে এসে হঠাৎ টেবিলের প্যাডখানা তুলে দেখতে যাবে কেন? এ-রকম কৌতূহল অস্বাভাবিক নয় কি?
আমি নিরুত্তর হয়ে চিন্তা করতে লাগলুম। জয়ন্ত বলে, কোনও নূতন মামলা হাতে পেলে গোয়েন্দার প্রধান আর প্রথম কর্তব্য হচ্ছে, সকলকেই সন্দেহ করা। কিন্তু খানিকক্ষণ ভাবনা-চিন্তার পর আমার সন্দেহ ঘনিভূত হয়ে উঠল, দুইজন লোকের উপরে। কে ওই আলোয়ান মুড়ি দেওয়া কালো চশমাপরা, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িওয়ালা রহস্যময় আগন্তুক? নরেনবাবুর প্রস্থানের পরেই ঘটনা ক্ষেত্রে তার আবির্ভাব এবং কেমন করেই বা জানতে পারলে, প্যাডের তলায় আছে পাঁচ হাজার টাকার নোট? তার মূর্তি, তার প্রবেশ ও প্রস্থান, তার কার্যকলাপ সমস্তই এমন অদ্ভুত যে যুক্তি প্রয়োগ করেও কিছু ধরবার বা বোঝবার উপায় নাই।