হরেনবাবুর সঙ্গে ওই বাড়িতেই তার ছোটোভাই সুরেন বাস করে। হরেনবাবু বিপত্নীক আর নিঃসন্তান। সুরেন এখনও বিবাহ করেনি। বাড়িতে ওরা দুজন ছাড়া আর একজন প্রায় কালা বুড়ো চাকর থাকে, ঘটনার সময়ে সে একতলার ঘরে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। তার কানে কোনও গোলমালই ঢােকেনি। বাড়ির সদর দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ ছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, হত্যাকারী কোনও জিনিসই চুরি করেনি।
বাড়ি খানাতল্লাশ করতে করতে সুরেনের ঘরে পাওয়া গেল একজোড়া রক্তমাখা জুতো। সে জুতো তারই, আর সেই জুতোর সঙ্গে হত্যাকারীর পদচিহ্ন অবিকল মিলে গেল। খুব সহজেই মামলার কিনারা হল ভেবে আমি তখুনি সুরেনকে গ্রেপ্তার করলুম। কিন্তু সুরেনকে বোধহয় আবার ছেড়ে দিতে বাধ্য হব।
বিমল বিস্মিত স্বরে বললে, কেন?
সুরেন বলে ঘটনার রাত্রে সে তার এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে গিয়েছিল। অনেক রাত পর্যন্ত খেটেখুটে সে সেইখানেই শুয়ে পড়ে। তার পরদিন সকালে বাড়িতে ফিরে সেই-ই প্রথমে হত্যাকাণ্ড আবিষ্কার করে। সুরেনের এই বন্ধুর বাপ হচ্ছেন কলকাতা পুলিশেরই আর এক ইনস্পেকটর, তার নাম অবনীবাবু। বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘড়িটা দেখে আমরা জেনেছি, হত্যাকাণ্ড হয়েছে রাত বারোটার সময়ে। শবব্যবচ্ছেদ করে ডাক্তারও সেই মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইনস্পেক্টার অবনীবাবু বলেন, সুরেন সে রাত্রে তার বাড়ি ছেড়ে এক মিনিটের জন্যেও বাইরে যায়নি। কেবল অবনীবাবু নন, বিবাহ সভায় যারা উপস্থিত ছিল, তারা সকলেই একবাক্যে এই সাক্ষ্য দিয়েছে। তারপরেও আর সুরেনকে ধরে রাখি কী করে? বিশেষ, তার সপক্ষে আর একটা মস্ত প্রমাণ রয়েছে।
কী প্রমাণ?
মৃত হরেনবাবুর হাতের মুঠোর মধ্যে গাছকয় পাকা চুল পাওয়া গিয়েছে। চুলগুলো নিশ্চয়ই হত্যাকারীর, ধস্তাধস্তি করবার সময়ে হরেনবাবু যে হত্যাকারীর চুল চেপে ধরেছিলেন, তাতে আর সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু সুরেনের মাথায় একগাছাও পাকা চুল নেই।
বিমল বললে, চুলগুলো একবার আমাকে দেখাবেন?
কেন দেখাব না? এই নিন বলে সুন্দরবাবু ছোট্ট একটি কাগজের মোড়ক এগিয়ে দিলেন।
মোড়কটা খুলে বিমল বললে, একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিতে পারেন?
তা যেন দিচ্ছি, কিন্তু অতটা খুঁটিয়ে দেখবার কিছুই নেই। ওগুলো পাকাচুল, আর সুরেনের মাথার চুল সব কালো। আপাতত এইটুকুই যথেষ্ট।
বিমল ম্যাগনিফাইং গ্লাসের সাহায্যে চুলগুলো পরীক্ষা করে বলল,-এই চুলগুলো কী প্রমাণ দিচ্ছে জানেন? হত্যাকারীকে মৃত হরেনবাবু চিনতেন, আর খালি তার মাথার লম্বা পাকাচুল নয়, মুখেও দাড়ি গোঁফ ছিল।
সুন্দরবাবু ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বললেন, কী করে জানলেন আপনি?
পরে তা বলব। আপনি আর নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারেননি?
না। তবে হরেনবাবুর মৃত্যুর দিন দশেক পরে প্রকাশ পেয়েছে, তার এক আত্মীয় মরবার সময়ে উইল করে তাদের দুই ভাইকে এক লক্ষ টাকা দান করে গিয়েছেন। কিন্তু এই উইলের খবর তারা কেউ জানতেন না, কারণ হরেনবাবুর মৃত্যুর মোটে চার দিন আগে ওই আত্মীয়টি মারা পড়েন। এখন অ্যাটর্নি বাড়ি থেকে এই খবর সবে প্রকাশ পেয়েছে।
বিমল অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, হরেনবাবুর অবর্তমানে এখন সুরেনই সব কর মালিক হবে তো?
হ্যাঁ! কিন্তু সুরেনও যদি ফাঁসিকাঠে ঝোলে, তাহলে তাদের সব সম্পত্তি যাবে হরিহরের হাতে।
হরিহর আবার কে?
হরেন আর সুরেনের খুড়তুতো ভাই। ঠিক পাশেই তার বাড়ি।
সেখানে কিছু খোঁজ নিয়েছেন?
তা আবার নিইনি, আমি কি তেমনি কাচা ছেলে হে? কিন্তু হরিহর সমস্ত সন্দেহের বাইরে। কারণ প্রথমত, খুনের সময়ে সে উইলের ব্যাপার জানত না, আর জানলেও সুরেন থাকতে তার সম্পত্তি লাভের কোনও সম্ভাবনাই নেই। দ্বিতীয়ত, তার পায়ের জুতো হত্যাকারীর জুতোর দাগের চেয়ে আধ ইঞ্চি ঘোট। তৃতীয়ত, তায়ও মাথায় পাকাচুল নেই। চতুর্থত, সে পাবলিক থিয়েটারের অভিনেতা। ঘটনার দিনে থিয়েটারে এক বিশেষ অভিনয় ছিল, অর্থাৎ সারারাত্রিব্যাপী অভিনয়। তিন-তিন খানা নাটকে তার পার্ট ছিল। আমি থিয়েটারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে, হরিহর ঘটনার পরদিন ভোর সাড়ে ছটায় বাড়িতে ফিরেছে। বিমলবাবু, আপনাদের সঙ্গে গল্প করব কী, আমি এখন অকূল পাথারে ভাসছি,-হুম, গল্প করতে আমার একটুও ভালো লাগছে না!
বিমল উঠে দাঁড়িয়ে বললে, আপনার দুরবস্থা দেখে আমার ভারী দুঃখ হচ্ছে! আচ্ছা, আজ
আর বেশিক্ষণ আপনার সময় নষ্ট করব না, কেবল একটি কথা জিজ্ঞাসা করে বিদায় হব।
কী কথা?
ঘটনাস্থলের কাছে, মাঝরাতে সেদিন যে পাহারাওয়ালা রাস্তায় পাহারায় ছিল, তাকে একবার ডেকে দিন।
পাহারাওয়ালা এল।
বিমল শুধোলে, তোমার নাম কী?
চন্দর সিং।
আচ্ছা চন্দর সিং, যে বাড়িতে খুন হয় তার কাছ থেকে কত তফাতে তুমি পাহারায় ছিলে?
পাঁচ-ছ খানা বাড়ির পরেই।
খুন হয়েছে রাত বারোটার সময়ে। তখন তুমি ঘুমিয়ে পড়োনি তো?
চন্দর সিং আহত কণ্ঠে বললে, পাহারা দিতে দিতে কোনওদিন আমি ঘুমোইনি, হজুর!
বেশ, বেশ, তুমি দেখছি অসাধারণ পাহারাওয়ালা! তাহলে রাত বারোটার সময় তুমি কি কোনও আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলে?
না হুজুর!
এখন শীতকালের রাত। বারোটার সময়ে পথে খুব কম লোক চলে। ঘটনাস্থলের কাছে রাত বারোটার সময়ে তুমি কি এমন কোনও লোক দেখেছিলে, যাকে দেখলে সন্দেহ হয়?