তারপর প্যাঁচা চিমটি কেটে আর সব ভাইবোনকে জাগিয়ে দিলে। সকলে একে একে হলঘরে গিয়ে জুটল।
হলঘরের একটা জানলায় গুলতি নিয়ে প্যাঁচা, আর-একটা জানলায় বন্দুক নিয়ে দীপু, আর-একটা জানলায় মঞ্জু গিয়ে দাঁড়াল—তার সামনে রাশিকৃত ইট-পাথর, এমনকি দুটো ভাঙা বোতল পর্যন্ত। মুকু আর নমু দুজনে একসঙ্গে আর-একটা জানলায় গিয়ে আশ্রয় নিলে, তারা নিরস্ত্র কারণ শিকার করবার নয়, কেবল শিকার দেখবারই শখ তাদের আছে।
ভেজানো জানলার ফাক দেখা গেল, বাগানে আবছা চাঁদের আলো এসে চারদিক করে তুলেছে ছায়ামায়াময়। কোথাও জনপ্রাণী নেই—শব্দের মধ্যে শোনা যাচ্ছে কেবল গাছে গাছে বাতাসের কান্না আর ঝোপেঝাপে ঝিঝিদের একঘেয়ে ডাক। বাঘের দেখা বা সাড়া নেই।
কিন্তু তাদের মনের ভেতরে তখন বাসা বেঁধেছে শিকারির ধৈর্য, কাজেই অন্ধকার ঘরে সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
হলঘরের বড়ো ঘড়িতে যখন বারোটা থেকে দুটো পর্যন্ত বেজে গেল এবং বাঘের আশায় তারা যখন দিয়েছে জলাঞ্জলি এবং নমু ও মুকু যখন দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই চোখ মুদে ঘুমোবার চেষ্টা করছে, তখন প্যাঁচার মনে হল, ছায়ার মতন কী একটা বড়ো মূর্তি সাঁৎ করে এ ঝোপ থেকে ও ঝোপে গিয়ে ঢুকল। দীপুও দেখেছিল, মঞ্জুও দেখেছিল।
ঝোপ থেকে মূর্তিটা আবার যেই আত্মপ্রকাশ করলে, অমনি দীপু ছুড়লে হাওয়ার বন্দুক, প্যাঁচা ছুড়লে গুলতি এবং মঞ্জু ছুড়লে ভাঙা বোতল। সঙ্গে সঙ্গে বিকট এক আর্তনাদ বাপ রে, মা রে, মরে গেছি রে!
এ যে মানুষের গলা! ওগো, মাগো, ভূত গো! বলে চেঁচিয়েই নমুদিদি দিলে তিরবেগে সে ঘর থেকে চম্পট! দীপুদাদার শিকারের শখ উপে গেল, ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে তৎক্ষণাৎ সে বন্দুক ত্যাগ করলে। মুকুদিদির তো লেগে গেল দাঁতকপাটি। ভূতের জন্যে তারা কেউ প্রস্তুত ছিল না।
কিন্তু প্যাঁচা ভয় কাকে বলে জানে না, মঞ্জুও তাই। প্যাঁচা বললে, মঞ্জু, ছোড়, ইট, আমি ছুড়ি গুলতি। ওটা মানুষ-বাঘ, ওটাকে মেরে ওর কাছ থেকে শেকড় কেড়ে নিতে হবে! ঝোপের ওপরে ফটাফট গুলতির গুলি আর ধপাধপ ইট বৃষ্টি হতে লাগল। কিন্তু বাঘের আর সাড়াই নেই।
নমু যখন নিজেদের ঘরে ঢুকে বিছানার ওপরে ঝাপ খেয়েছে, তখন গোলমালে তার মা-বাবার ঘুম গেছে ভেঙে। বাবা বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, কী রে নমু, কী হয়েছে?
ও বাবা, বাগানে একটা ভয়ানক ভূত এসেছে—বলেই সে সোজা লেপের ভেতরে ঢুকে গেল, কারণ সে জানত লেপের ভেতরে একবার ঢুকতে পারলে আর ভূতের ভয় থাকে না। নমুর বাবা লাঠি নিয়ে তখনই বাগানে ছুটলেন।
বাগানের ঝোপের ভেতরে পাওয়া গেল একটা হতভাগ্য চোরের অচেতন দেহ। তার রগে লেগেছিল গুলতির গুলি। এর দেহও ইট আর ভাঙা বোতলের চোটে রক্তাক্ত। কী অশুভক্ষণেই সে আজ এ বাড়িতে চুরি করতে ঢুকেছিল। তার অবস্থা দেখে তাকে থানায় পাঠিয়ে হাসপাতালেই পাঠানো হল।
কিন্তু দাদুর অবিচারটা দ্যাখো! কোথায় এইসব বীর নারী ও বীর পুরুষকে অভিনন্দন দেবেন, না তিনি কিনা ফস করে বলে বসলেন, আজকেই ও সর্বনেশেদের এয়ারগান আর গুলতি কেড়ে নিয়ে নিরস্ত্র করা হোক! আমার গোঁফ ওরা কেটে নিয়েছে, এইবারে ওদের নজর পড়বে আমার টাকের ওপরে।
দাদুর সন্দেহ সত্য কি না জানি না, কিন্তু মুকু, নমু, দীপু, প্যাঁচা আর মঞ্জুকে তোমরা চিনে রাখো, কারণ ভবিষ্যতে ওদের সঙ্গে তোমাদের আবার দেখা হলেও হতে পারে।
বাবা মুস্তাফার দাড়ি
বিমল ও কুমার হচ্ছে নিছক অ্যাডভেঞ্চারের ভক্ত, সাধারণ গোয়েন্দাগিরি নিয়ে তারা কোনওদিন মাথা ঘামাত না। কিন্তু গোয়েন্দার প্রধান প্রধান গুণ, অর্থাৎ পর্যবেক্ষণশক্তি, চিন্তাশীলতা আর নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতা তাদের দুজনেরই ছিল যথেষ্ট। এইসব কারণে তারা মাঝে মাঝে খুব সহজেই এমন সব শক্ত মামলারও কিনারা করে ফেলতে পারত বড়ো বড়ো পেশাদার গোয়েন্দারাও যাদের মধ্যে তল খুঁজে পায়নি। এই রকমেরই একটি ঘটনার কথা আজ তোমাদের কাছে বলতে চাই।
ড্রাগনের দুঃস্বপ্নের গল্প যাঁরা শুনেছেন, বিমল ও কুমারের সঙ্গে কী করে ইনস্পেকটার সুন্দরবাবুর প্রথম পরিচয় হয়, এরই মধ্যে তারা নিশ্চয়ই তা ভুলে যাননি।
ওই ঘটনার কিছুদিন পরের কথা। বিমল ও কুমার একদিন সকালে বেড়াতে বেড়াতে অকারণেই সুন্দরবাবুর থানায় গিয়ে হাজির হল।
একটা টেবিলের ধারে সুন্দরবাবু চিন্তিত মুখে মাথার টাকে হাত দিয়ে বসেছিলেন। পায়ের শব্দে মুখ তুলে দেখে বললেন, এই যে হুম! একেবারে যুগলে উদয়, ব্যাপার কী?
কুমার হেসে বললে, কিছুই নয়। এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলুম, ভাবলুম আপনার সঙ্গে দুটো গল্পগুজব করে যাই।
সুন্দরবাবু হতাশভাবে বললেন, আর গল্প করব! পোড়া অদৃষ্টে কি সে সুখ আছে? একটা বিচ্ছিরি মামলা নিয়ে মহা-ঝাটে পড়া গেছে ভাই! তবু এসে যখন পড়েছেন, দুকাপ চা খেয়ে যান।
বিমল চেয়ার টেনে বসে পড়ে জিজ্ঞাসা করলে, মামলাটা কী, শুনতে পাই না?
সুন্দরবাবু বললেন, শুনে কোনোই লাভ হবে না ভায়া, এ মামলার কিনারা করা অসম্ভব।
তবু শুনতে দোষ কী?
তাহলে শুনুন …দিন কয় আগে আমারই এলাকায় এক রাত্রে হরেনবাবু নামে একটি ভদ্রলোক খুন হয়েছেন শুনে সকালে তদন্ত করতে গেলুম। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, ঘরময় বইছে রক্তের ঢেউ, আর চারদিকে ছড়ানো কতকগুলো জিনিসপত্তর। তারই মাঝখানে হরেনবাবুর দেহ পড়ে রয়েছে। তার মুখে, কাঁধে আর বুকে তিনটে গভীর ক্ষত, সেগুলো ছোরার আঘাত বলেই মনে হল। ঘরের অবস্থা দেখে ঋলুম, হত্যাকারীর সঙ্গে হরেনবাবু রীতিমতো যোজাযুঝি করেছিলেন। মেঝেতে একটা মাঝারি আকারের ঘড়ি পড়ে রয়েছে, ঘড়িটা রাত বারোটা বেজে বন্ধ হয়ে গেছে দেখে বোঝা গেল, ঠিক ওই সময়েই ঘটনাটা ঘটেছে। রক্তের মধ্যে পাওয়া গেল কতকগুলো নিখুঁত জুতোের ছাপ!