বিমল বললে, ও বর্শা নিশ্চয়ই তোমার বুটের চামড়া ভেদ করতে পারেনি। কারণ, তোমার পায়ের মাংস ভেদ করলে তুমি নিশ্চয়ই টের পেতে!
ওঃ, ভাগ্যে শিকারি-বুট পরেছিলুম। কিন্তু কী আশ্চর্য বিমল, এই অদৃশ্য শত্রু কোথায় লুকিয়ে আছে?
বিমল ও কুমার সাবধানে ওপরে নীচে আশেপাশে চতুর্দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগল, কিন্তু উঁচু গাছের ডালে একটা ময়ূর, একটা হিমালয়ের পায়রা, গোটাকয়েক শকুনি ছাড়া আর কোনও জীবকে সেখানে আবিষ্কার করতে পারলে না। বনের তলায় আলোআঁধারির মধ্যেও জীবনের কোনও লক্ষণ নেই—যদিও কেমন একটা অস্বাভাবিক রহস্যের ভাব সেখানকার প্রত্যেক আনাচ-কানাচ থেকে যেন অপার্থিব ও অদৃশ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। এবং সুযোগ পেলেই যে-কোনও মুহূর্তেই সে যেন ধারণাতীত মূর্তি ধারণ করে বাইরে আত্মপ্রকাশ করতে পারে!
হঠাৎ সামনের লম্বা লম্বা ঘাসগুলো সরসর করে কাঁপতে লাগল, তার ভেতর দিয়ে কী যেন ছুটে যাচ্ছে ঠিক যেন দ্রুত গতির একটা দীর্ঘ রেখা কেটে!
মাটি থেকে টপ করে একটা নুড়ি তুলে নিয়ে কুমার সেই দিকে ছুড়লে, সঙ্গে সঙ্গে ঘাসের কাঁপুনি বন্ধ হয়ে গেল!
ওটা কী জন্তু দেখতে হবে বলে কুমার যেখানে নুড়ি ছুড়েছিল সেইদিকে দৌড়ে গেল! তারপর পা দিয়ে ঘাস সরিয়ে হেঁট হয়ে দেখেই সবিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল।
কী কুমার, কী, কী?
কিন্তু কুমার আর কোনও জবাব দিতে পারলে না—সে যেন একেবারেই থ হয়ে গেছে।
বিমল তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু নীচের দিকে তাকিয়ে সে-ও যেন শিউরে উঠে বললে, কুমার, কুমার, এও কি সম্ভব?
।। পাঁচ ।।
মাটির ওপরে শুয়ে আছে, অসম্ভব এক নকল মানুষ-মূর্তি!
লম্বায় সে বড়োজোর এক বিঘত! কুমারের নুড়ির ঘায়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে!
এক বিঘত লম্বা বটে, কিন্তু তার ছোট্ট দেহের সবটাই অবিকল মানুষের মতো—মাথার চুল, মুখ, চোখ, ভুরু, নাক, চিবুক, কান, হাত, পা—মানুষের যা-যা থাকে তার সে-সবই আছে।…তার পাশে হাতের খুদে মুঠো খুলে পড়ে রয়েছে সেই রকম এক কাঠির বর্শা!
বিমল ও কুমার নিজেদের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে রাজি হল না! বিমল সেই এক বিঘতি মানুষটিকে দুই আঙুলে তুলে একবার নিজের চোখের কাছে ধরলে সেই একফোট্টা মানুষের এতটুকু বুক নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে বারবার উঠছে আর নামছে! বিমল তুলে ধরতেই তার মাথাটা কাঁধের ওপরে লুটিয়ে পড়ল! শিউরে উঠে আবার সে তাকে মাটিতে শুইয়ে দিলে!
কুমার হতভম্বের মতো বললে, বিমল, আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?
বিমল বললে, এও যদি স্বপ্ন হয়, তাহলে আমরাও স্বপ্ন!
পাহাড় থেকে নেমে এসে তাহলে এই ভয়ই বনবাসী হয়েছে?
তা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? এদের চেহারাই খালি আমাদের মতো নয়, এই পকেট সংস্করণের মানুষ আমাদেরই মতো বর্শা তৈরি করে, ইস্পাতের ফলা ব্যবহার করতে জানে, আবার বিষ তৈরি করে বর্শার ফলায় মাখিয়ে বড়ো বড়ো শত্রু মারতেও পারে! সুতরাং এর বুদ্ধিও হয়তো মানুষের মতো! জানি না, এর দলের আরও কত লোক এখানে লুকিয়ে আছে!..ওই যাঃ, কুমার-কুমার–
ইতিমধ্যে কখন যে এক বিঘতি মানুষের জ্ঞান হয়েছে, তারা কেউ তো টের পায়নি! যখন তাদের হুঁশ হল তখন সেই পুতুল-মানুষ তিরবেগে ঘাস জমির ওপর দিয়ে দৌড় দিয়েছে!
ব্যর্থ আক্রোশে বিমল নিজের বন্দুকটা তুলে নিয়ে কেন যে গুলি ছুঁড়লে তা সে নিজেই জানে না, তবে এটা ঠিক যে, সেই পুতুল-মানুষকে হত্যা করবার জন্যে নয়!
কিন্তু যেমনি গুড়ুম করে বন্দুকের শব্দ হল, অমনি তাদের এপাশে-ওপাশে, সামনে পিছনে লম্বা লম্বা ঘাসের বন যেন সচমকে জ্যান্ত হয়ে উঠল—ঘাসে ঘাসে এলোমেলো দ্রুত গতির রেখার পর রেখা, যেন শত শত জীব লুকিয়ে লুকিয়ে চারদিক দিয়ে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে।
বিমল ও কুমারও পাগলের মতো চতুর্দিকে ছুটাছুটি করতে লাগল, অন্তত আর-একটা পুতুল-মানুষকে গ্রেপ্তার করবার জন্যে!
—কিন্তু মিথ্যা চেষ্টা!
তারপরেও বিমল ও কুমার বহুবার বনের ভেতরে খুঁজতে গিয়েছিল। কিন্তু আর-কোনও পুতুল-মানুষ সে অঞ্চলে আর দেখা দেয়নি বা বিষাক্ত বর্শা ছুড়ে আমাদের মতো বড় বড় মানুষকে হত্যা করেনি। বোধহয় বন ছেড়ে তারা আবার পালিয়ে গিয়েছিল ভুটানের পাহাড় জগতে।
‘বাগানের বাঘ
মুকু, নমু, দীপু, মঞ্জু আর প্যাঁচাবাবুর সঙ্গে তোমাদের এখনও পরিচয় হয়নি বোধহয়? এরা হচ্ছে ভাই-বোন। দীপু আর প্যাঁচা হচ্ছে ভাই, মুকু, নমু আর মঞ্জু হচ্ছে বোন।
সবচেয়ে ছোটো হচ্ছে প্যাঁচা আর মঞ্জু, কিন্তু সবচেয়ে ডানপিটে হচ্ছে তারা দুজনেই। দুষ্টুমি বুদ্ধিতে দাদা-দিদিরা তাদের কাছে থই পায় না।
তাদের জ্বালায় দাদু বেচারার ঘুমিয়েও শান্তি নেই। মঞ্জু চুপি চুপি গিয়ে ঘুমন্ত দাদুর নাকের ভেতরে করবে নস্যির ডিবে খালি, আর কাঁচি নিয়ে প্যাঁচা দেবে দাদুর গোঁফজোড়া কচ করে হেঁটে। দাদুকে শাস্তি দেওয়ার এমনি নিত্য-নতুন ফন্দি আবিষ্কার করতে তাদের জুড়ি নেই।
মুকু, নমু আর দীপু অতটা দুষ্টুমি করে না বটে, কিন্তু দাদু যখন ভয়ানক হাঁচতে হাঁচতে জেগে উঠে ঠোটে হাত দিয়ে শখের গোঁফজোড়া আর খুঁজে পান না, তখন তাদের একটুও দয়া হয় না, উলটে তারা খিলখিল করে হেসেই খুন হয়। দাদু যদি রেগে ওঠেন তবে তারাও আরও জোরে হেসে ওঠে।