হিরালাল যে মূর্তির ভিতরে কালো মুক্তা লুকিয়ে রেখেছে তখনও পর্যন্তও সন্দেহ আমার হয়নি। কিন্তু খালি বাড়ির সামনে ঠিক আলোর নীচে হিরালাল মূর্তিটা ভেঙেছিল বলে এ সন্দেহ আমার হয়েছিল যে, ফাঁপা মূর্তিগুলোর মধ্যে এমন কোনও মূল্যবান জিনিস আছে, যার লোভে চোর এইসব কাণ্ড করে।
সন্ধান নিয়ে জানলুম, ছয়টার মধ্যে শেষ দুটো মূর্তি আছে যথাক্রমে প্রফেসর সুরেশচন্দ্র বসু আর শ্যামাপ্রসাদ সেনের কাছে। একজন থাকে শহরেই, আর একজন শ্রীরামপুরে। আন্দাজ করলুম শহরের মূর্তিটাকে চুরি না করে কলকাতার বাইরে যাওয়া হিরালালের পক্ষে স্বাভাবিক নয়। আমার আন্দাজ ভুল হয়নি, তারপর সুরেশবাবুর বাড়িতে স্বচক্ষে দেখলুম হিরালাল কী যেন খুঁজছে মূর্তির ভাঙা টুকরোগুলোর মধ্যে। কিন্তু তখন পুরনো খবরের কাগজের ফাইল থেকে বিখ্যাত কালো মুক্তোর ইতিহাস আমি উদ্ধার করেছি আর রাধাকিষণের সঙ্গে এই মুক্তোর চুরির যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতে পারে, এমন সন্দেহও আমার মনে ঠাঁই পেয়েছে। এও জেনেছি যে রাধাকিষণ আর হিরালাল পরস্পরের পরিচিত আর একই দেশের লোক। মনে খটকা লাগল হিরালাল কি ফাঁপা মূর্তির ভিতর খুঁজছে কালো মুক্তাকেই?
কিন্তু এখনও পর্যন্ত হিরালালের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়নি। আমার মন বললে তাহলে মুক্তা আছে ওই শেষ বা ষষ্ঠ মূর্তির মধ্যেই। সুন্দরবাবু কপাল ঠুকে আপনার সামনেই তিনশো টাকা দিয়ে আমি ওই ষষ্ঠ মূর্তিটাকে কিনে ফেললুম দেখলেন তো?
সুন্দরবাবু তারিফ করে বললেন, ধন্যি ভায়া ধন্যি! একটি মাত্র ইষ্টক খণ্ড দিয়ে আজ একজোড়া পক্ষী বধ করেছ! একসঙ্গে দু-দুটো মামলার কিনারা করে ফেললে হে—ওদিকে মুক্তা চুরির আর এদিকে মূর্তি চুরির মামলা। হুম, হুম।
মানিক বললে, নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জীবন হচ্ছে বিচিত্র অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ। তাঁর প্রতিমূর্তিও বড়ো কম অ্যাডভেঞ্চারের সৃষ্টি করলে না—নেতাজির সব কিছুর সঙ্গেই আছে অসাধারণতার সম্পর্ক! জয় হিন্দ।
বনের ভেতরে নতুন ভয়
।। এক ।।
কুচবিহার থেকে মোটর ছুটেছে—আলিপুর গেল, কুমারগ্রাম পিছনে পড়ে রইল, এখন জয়ন্তীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
বিমল ও কুমার শিকারে বেরিয়েছে। কুমারের মেলোমহাশয় কুচবিহারে বড়ো চাকরি করেন, তাঁরই নিমন্ত্রণে কুমার ও তাঁর বন্ধু বিমল কুচবিহারে এসে আজ কিছুদিন ধরে বাস করছে। তাদের শিকারের তোড়জোড় করে দিয়েছেন তিনিই।
জয়ন্তীতে কুচবিহারের মহারাজার শিকারের একটি ঘাঁটি বা আস্তানা আছে। স্থির হয়েছে, বিমল ও কুমার দিন দুই-তিন সেখানে থাকবে এবং শিকারের সন্ধান করবে। জয়ন্তীর অবস্থান হচ্ছে কুচবিহার ও ভুটানের সীমান্তে। এখানকার নিবিড় বনে বাঘ ও অন্যান্য হিংস্র জন্তুর অভাব নেই।
শীতের বিকাল। রোদের আঁচ কমে আসার সঙ্গে-সঙ্গেই পাহাড়ে শীতের আমেজ একটু একটু করে বেড়ে উঠছে। ধুলোয় ধূসরিত আঁকা-বাঁকা পথের দুই পাশে চাঁদের গ্রামগুলো গাছপালার ছায়ায় গা এলিয়ে দিয়েছে। এপাশে-ওপাশে বুনো কুলগাছের ঝোপের পর ঝোপ। মাঠে মাঠে যে গোরুগুলো চরছে, তাদের কোনও-কোনওটা মোটর দেখে নতুন কোনও দুষ্ট জন্তু ভেবে ল্যাজ তুলে তেড়ে আসছে এবং দেশি কুকুরগুলোও গাড়ির শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়াতে খাপ্পা হয়ে ঘেউ ঘেউ করে ধমকের পর ধমক দিচ্ছে।
এইসব দেখতে দেখতে ও শুনতে শুনতে সন্ধ্যার ছায়া ঘন হয়ে উঠল এবং গাড়িও জয়ন্তীর ঘাঁটিতে গিয়ে পৌঁছল।
একতলা সমান উঁচু শালকাঠের খুঁটির ওপরে শিকারের এই ঘাঁটি বা কাঠের বাংলো। একজন কুচবিহারী রক্ষী এখানে থাকে। আগেই তাকে খবর দেওয়া হয়েছিল, সে এসে গাড়ি থেকে মোটমাট নামিয়ে নিতে লাগল।
একটি কাঠের সিঁড়ি দিয়ে বিমল ও কুমার বাংলোর ওপরে গিয়ে উঠল। সেখান থেকে চারদিকের দৃশ্য টার্নারের আঁকা একখানি ছবির মতো।
একদিকে ভুটানের পাহাড় আকাশের দিকে মটুক পরা মাথা তুলে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। এবং তার নীচের দিকটা গভীর জঙ্গলে ড়ুব দিয়ে অদৃশ্য। অস্তগত সূর্যের ফেলে যাওয়া। খানিকটা রাঙা রং তখনও আকাশকে উজ্জ্বল করে রাখার জন্যে ব্যর্থ চেষ্টা করছিল। পাতলা অন্ধকারে চারদিক ঝাপসা হয়ে গেছে। পৃথিবীর সমস্ত শব্দ ক্রমেই যেন ঝিমিয়ে পড়ছে এবং বহুদূর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে দুই-একটা গোরুর হাম্বা রব।
বিমল পাহাড় ও অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বললে, কুমার, ও জঙ্গলে কেবল বাঘ নয়, হাতিও থাকতে পারে।
কুমার বললে, ভালোই তো, কলকাতায় অনেকদিন ধরে লক্ষ্মীছেলের মতো হাত গুটিয়ে বসে আছি, একটুখানি নতুন উত্তেজনা আমাদের দরকার হয়েছে।
।। দুই ।।
কিন্তু সে-বারে উত্তেজনা এল সম্পূর্ণ নতুন রূপ ধরে, অপ্রত্যাশিতভাবে।
কুচবিহারি শীত ভুটানের সীমান্তে দার্জিলিঙের প্রায় কাছাকাছি যায়। সন্ধ্যার অন্ধকার সঙ্গে করে যে শীত নিয়ে এল, তিনটে পুরু গরম জামার ওপরে মোটা আলোয়ান চাপিয়েও তার আক্রমণ ঠেকানো যায় না।
রক্ষী ঘরের ভেতরে এসে জিনিসপত্তর গুছোচ্ছে, বিমল তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, ওহে, তোমার নামটি কী শুনি?
আজ্ঞে, শ্রীনিধিরাম দাস।
আচ্ছা নিধিরাম, তুমি এখানে কতদিন আছ?
আজ্ঞে, অনেকদিন!
কাল ভোরে আমরা যদি বেরুই, কাছাকাছি কোথাও কোনও শিকার পাওয়া যাবে?
আজ্ঞে, ওই জঙ্গলে বরা (বরাহ) তো পাওয়া যাবেই, বাঘও আছে। কাল রাতেই আমি বাঘের ডাক শুনেছি। আজ সকালে উঠে দেখেছি, কাছেই একটা ঝোপে বাঘে গোরু মেরে আধখানা খেয়ে ফেলে রেখে গেছে।