–মশাই, আমি মস্ত ধনী নয় বটে, কিন্তু ঠক-জুয়াচোরও নই। আগে থাকতেই আপনাকে জানিয়ে রাখতে চাই, মূর্তিটির দাম দশ টাকা মাত্র।
-শ্যামাপ্রসাদবাবু, আপনার সততা দেখে খুশিও হচ্ছি, বিস্ময়ে হতবাকও হচ্ছি। মূর্তিটির আসল দাম যাই হোক, আমি তিনশো টাকা দিয়েই ওটি আপনার কাছ থেকে কিনতে চাই।
শ্যামাপ্রসাদ কাগজের মোড়ক খুলে মূর্তিটি টেবিলের উপরে রাখলেন।
পকেট থেকে তিনখানা একশো টাকার নোট বার করে জয়ন্ত বললে, শ্যামাপ্রসাদবাবু, টেবিলের উপরে কাগজ কলম আছে। এই দুইজন সাক্ষীর সামনে আপনি অনুগ্রহ করে লিখে দিন যে তিনশো টাকার বিনিময়ে মূর্তিটি আমার কাছে বিক্রয় করলেন, ওর উপরে ভবিষ্যতে আপনার কোনও দাবিদাওয়াই রহিল না।
জয়ন্তর কথামতো কাজ করে তিন শত টাকা নিয়ে প্রস্থান করলেন শ্যামাপ্রসাদবাবু।
সুন্দরবাবু সবিস্ময়ে বললেন, হুম, জয়ন্তর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, জেনে-শুনেও ঠকলে, আরে ছ্যাঃ।
জয়ন্ত মুখ টিপে, একটু হেসে উঠে দাঁড়াল। একখানা নূতন টেবিলক্লথ বিছিয়ে নেতাজির মূর্তিটা তার মাঝখানে স্থাপন করে বললে, সুন্দরবাবু এইবার আমি একটি অপকর্ম করব— মহা অপকর্ম।
–দশ টাকার মাল তিনশো টাকায় কিনেই তো অপকর্ম করেছ। তারও উপরে আবার কী অপকর্ম আছে?
একটা হাতুড়ি নিয়ে জয়ন্ত বললে, আজ আমিও বরেণ্য নেতাজির ওই প্রতিমূর্তিকে চূর্ণবিচূর্ণ করব।
—তুমি যে হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়েছ, সে-বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই। মানিক, তোমার বন্ধুটিকে সামলাও, সে যেন আমার মাথায় হাতুড়ির এক ঘা না দেয়।
জয়ন্ত মূর্তির উপরে হাতুড়ির দ্বারা আঘাত করলে এবং মূর্তিটি সশব্দে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
জয়ন্ত সাগ্রহে টেবিলের উপরে হেঁট হয়ে পড়ল এবং একটা ভাঙা টুকরো তুলে সানন্দে। বলে উঠল, দেখুন সুন্দরবাবু! দ্যাখো মানিক! আমার হাতে রয়েছে মমতাজ বেগমের বিখ্যাত কালো মুক্তা!
।।সাত ।। এক ঢিলে দুই পাখি…
জয়ন্ত বলতে লাগল—মমতাজ বেগমকে সম্রাট সাজাহান যে মহামূল্যবান কালো মুক্ত উপহার দিয়েছিলেন, তার খ্যাতি পৃথিবীর দেশে দেশে।
নাদির শাহের ভারত আক্রমণের সময় এই মুক্তটি কোথায় হারিয়ে যায় কেউ তা জানে না । অনেক কাল পরে মুক্তাটি কেমন করে মধ্য ভারতের প্রতাপপুরের মহারাজার হস্তগত হয়। তারপর সেদিন পর্যন্ত বংশানুক্রমে মুক্তার মালিক হতেন প্রতাপপুরের মহারাজারাই।
তারপর বর্তমান মহারানির শয়নগৃহ থেকে আবার মুক্তাটি হয় অদৃশ্য। তাই নিয়ে চারিদিকে খুব উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, সুন্দরবাবুর সে কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। পুলিশ সেমামলার কিনারা করতে পারেনি। মহারানির এক পরিচারিকা ছিল, সে জয়পুরের মেয়ে, নাম সুমিত্রা। তারই উপরে সন্দেহ হয় বটে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সুন্দরবাবু চমকে উঠলেন যে বড়ো? আপনার মুখেই তো শুনেছি, হারাধনবাবুর বাড়ির সামনে নিহত রাধাকিষণের এক ভগ্নী আছে নাম সুমিত্রা আর সে জয়পুরের মেয়ে।
—হ্যাঁ মশাই হ্যাঁ। এই দুই সুমিত্রা একই যে ব্যক্তি তাতে আর কোনও সন্দেহ নেই! পুরাতন খবরের কাগজের ফাইল ঘেঁটে আমি আর একটি তথ্য আবিষ্কার করেছি! কাকে ছোরা মেরে হিরালাল যেদিন ধরা পড়ে, প্রতাপপুরের মহারানির শয়নগৃহ থেকে কালো মুক্তাটি অদৃশ্য হয় ঠিক তারই চারদিন আগে। কল্পনায় ঘটনাগুলো পর পর এই ভাবে সাজানো যেতে পারে!
সুমিত্রা মুক্তাটি চুরি করে ভাই রাধাকিষণের কাছে গোপনে পাঠিয়ে দিল। হিরালাল হচ্ছে রাধাকিষণের দুষ্কর্মের সহকারী। সে হয় মুক্তাটি তার বন্ধুর কাছে থেকে চুরি করলে, কিংবা নিজে পুলিশের দৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষা করবার জন্য রাধাকিষণরাই তার কাছে মুক্তাটি জিম্মা রাখল। তারপর হঠাৎ একজন লোককে ছোরা মেরে হিরালাল আগরওয়ালার কারখানায় পালিয়ে এল। তারপর সে যখন বসে বসে প্লাস্টারের মূর্তি গড়ছে সেই সময় সেখানে পুলিশের আবির্ভাব। সে বুঝলে পুলিশ তার কাপড় জামা তল্লাশি করবে। তার সামনে ছিল সবে-গড়া ভিজে প্লাস্টারের মূর্তি। সে তাড়াতাড়ি একটা মূর্তির মাথায় ছাঁদা করে মুক্তাটি ভিতরে নিক্ষেপ করে ছিদ্রটি আবার বন্ধ করে দিলে—দক্ষ কারিগরের পক্ষে এটা খুবই সহজ কাজ। তারপর সে এক বৎসর জেল খাটতে গেল। ইতিমধ্যে নেতাজির ছয়টি মূর্তি কারখানার বাইরে এখানে-ওখানে চলে গেল। তাদের কোনটির মধ্যে যে মুক্তা আছে বাহিরে থেকে দেখে কেউ তা বলতে পারে না। মূর্তি নাড়লেও মুক্তার অস্তিত্ব জানা যাবে না, কারণ কঁচা প্লাস্টার শুকিয়ে গিয়ে মুক্তাটিকে কামড়ে ধরেছে। মূর্তি ভাঙা ছাড়া মুক্তা আবিষ্কারের আর কোনও উপায় রইল না।
তারপর হিরালালের মেয়াদ ফুরুল। কিছুমাত্র হতাশ না হয়ে দস্তুরমতো মাথা খাটিয়ে ভিতরে ভিতরে খোঁজ নিয়ে সে জানতে পারলে, কোন কোন মূর্তি কোন কোন ঠিকানায় গিয়েছে। তারপর আরম্ভ হল নেতাজির মূর্তির উপরে আক্রমণ। চতুর্থ মূর্তি চুরি করতে গিয়ে হারাধনবাবুর বাড়ির সামনে হিরালালের সঙ্গে দেখা হয় রাধাকিযণের। হিরালাল জেল থেকে বেরিয়েছে শুনে রাধাকিষণ তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু এই সাক্ষাৎকারের ফল হল রাধাকিষণের পক্ষে মারাত্মক।
সুন্দরবাবু বললেন, হিরালাল যদি তার দুষ্কর্মের সহকারীই হয় তবে রাধাকিষণ, তার ফটো নিয়ে বেড়াত কেন?
–খুব সম্ভব তৃতীয় ব্যক্তির কাছে হিরালালের খোঁজ নেবার সময়ে এই ফটো তার কাজে লাগত। যাক সে কথা। আমি বেশ আন্দাজ করলুম, খুনের পরে হিরালাল আরও তাড়াতাড়ি কাজ হাসিল করবার চেষ্টা করবে; কারণ পুলিশ তাকে খুঁজছে, এখন যথাসম্ভব শীঘ্র তার কলকাতা থেকে অদৃশ্য হওয়া উচিত।