এমন সময় বাড়ির ভিতরে জ্বলে উঠলো আলো এবং দরজা খুলে বেরিয়ে বাগানের উপর এসে দাঁড়াল আর এক মূর্তি।
জয়ন্ত মুখ তুলে শুধোলে, আপনিই বোধ হয় প্রফেসর সুরেশচন্দ্র বসু।
—আজ্ঞে হ্যাঁ আর আপনি নিশ্চয়ই জয়ন্তবাবু? আপনার পত্র আমি যথাসময়েই পেয়েছি আর কাজ করেছি, আপনার উপদেশ মতোই। যাক বদমাইশটা ধরা পড়েছে দেখে খুশি হলুম। আসুন, একটু চা-টা খেয়ে যান।
সুন্দরবাবু বললেন, এই কি চা খাবার সময় মশাই? এই পরমসুন্দর মানুষটিকে লকআপে পুরতে না পারলে আমি ঘুমোবারও সময় পাব না। দেখি সোনার চাদ, তোমার পকেটে কী সম্পত্তি আছে।
বন্দি কোনও কথা কইলে না। কিন্তু সুন্দরবাবু তার দিকে হাত বাড়াতেই সে দাঁত-মুখ খিচিয়ে খাঁক করে তাঁর হাতে কামড়ে দিতে এল।
সুন্দরবাবু চট করে নিজের হাতখানা সরিয়ে নিয়ে বলে উঠলেন, ওরে বাবা হয়েছিল আর কী? তুই বেটা মানুষের ছদ্মবেশে বুনো জন্তু নাকি? হুম, এর মুণ্ডুটা দুই হাতে আচ্ছা করে চেপে ধরো তো মানিক! সাবধান যেন কামড়ে না দেয়? এর পকেটগুলো হাতড়ে না দেখলে চলবে না।
আসামির পকেট হাতড়ে পাওয়া কেবল তিন টাকা দশ পয়সা আর একখানা ছোরা।
জয়ন্ত ছোরাখানা আলত পরীক্ষা করে বললে, হু এর হাতলে এখনও রক্তের দাগ লেগে রয়েছে দেখছি। নিশ্চয়ই গুণ্ডা রাধাকিষণের রক্ত।
সুন্দরবাবু বললেন, ওহে রূপবান পুরুষ, কোন নাম ধরে তোমাকে সম্বোধন করব বাপু?
বন্দি নিরুত্তর।
–নাম বললে না? জীতা রহো বেটা! কিন্তু তুমি তো জানো না ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অবনীবাবুর কাছে গেছে তোমার নাম-ধাম আর যাবতীয় গুণাবলী কিছুই আর ধামাচাপা থাকবে না।
জয়ন্ত বললে, রাত বাড়ছে সুন্দরবাবু।
–হ্যাঁ , আমরাও এইবার গা তুলব। কিন্তু ভাই জয়, তুমি যে কেমন করে জানতে পারলে এই খুনেটা আজ আসবে, কিছুই আমি বুঝতে পারছি না।
—আপাতত বুঝে কাজ নেই, কারণ আমার কাছেও এখনও সব রহস্য পরিষ্কার হয়নি। এ লোকটা নেতাজির মূর্তি ভাঙে কেন?
—আরে থো করো ও কথা! এটা হচ্ছে খুনের মামলা, খুনি গ্রেপ্তার হয়েছে, এখনও তুমি নেতাজির মূর্তি নিয়ে মস্তক ঘর্মাক্ত করছ কেন?
–না, সুন্দরবাবু, এটা খুনের মামলা নয়, এটা হচ্ছে নেতাজির মূর্তির মামলা। আমার ধারণা খুনোখুনির কারণই হচ্ছে নেতাজির মূর্তি, সে কারণ আবিষ্কার করতে না পারলে আদালতে আপনার খুনের মামলা ফেঁসে যাবে।
—অত বাক্যব্যয় কেন, কারণটা ব্যক্তই করো না বাপু!
কারণ অনুমান করেছি বটে, কিন্তু সে অনুমান সত্য বলে প্রমাণ করবার উপায় আমার হাতে নেই। তবে আসছে পরশুদিন বৈকালে আপনি যদি আমার বাড়িতে শুভাগমন করেন, তাহলে মেঘ সরিয়ে আপনাকে সূর্যালোক দেখাবার আশা করলেও করতে পারি।
।। ছয় ।। মমতাজ বেগমের কালো মুক্তা
নির্দিষ্ট দিনে যথাসময়ে সুন্দরবাবু দেখা দিলেন জয়ন্তের বৈঠকখানায়।
জয়ন্ত বললে, খবর শুভ তো?
সুন্দরবাবু গর্বিত ভাবে বললেন, তোমার আগেই আমি সূর্যালোক দেখতে পেরেছি। জয়ন্ত।
—আপনি ভাগ্যবান।
–না, ঠাট্টা নয়। অবনীবাবু খোঁজখবর নিয়ে এর মধ্যেই আসামির সব গুপ্তকথা জানতে পেরেছেন। তার নাম হিরালাল, বাড়ি জয়পুরে। আগে তার স্বভাব ভালোই ছিল, সৎপথে থেকে মূর্তি গড়ে বেশ দু-পয়সা রোজগার করত। তারপর কুসংসর্গে মিশে সে গোল্লায় যায়। দু-বার জেল খাটে একবার চুরি করে, আর একবার ছোরা মেরে। নেতাজির মূর্তিগুলো কেন যে ভাঙল এখনও তা জানা যায়নি; কারণ হিরালাল ও সম্বন্ধে কোনও কথাই বলতে নারাজ। কিন্তু আমরা সন্ধান নিয়ে এইটুকু জানতে পেরেছি যে, মূর্তিগুলো তার নিজের হাতেই গড়া; সুন্দরবাবু নিজের মনের কথা বলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু জয়ন্ত বোধ হয় মন দিয়ে তার কথা শুনছিল না, থেকে থেকে সে যেন কান পেতে কী শোনে, মাঝে মাঝে উঠে জানলার ধারে যায় তারপর আবার আনে এসে বসে পড়ে।
সুন্দরবাবু শুধোলেন, তোমার আজ কী হয়েছে জয়ন্ত? তুমি এমন অন্যমনস্ক কেন?
–বোধ হয় আমার হিসেবে ভুল হয়েছে। এখন আপনার কাছে কেমন করে মুখ রক্ষা করব জানি না।
—এ আবার কী কথা?
—আজ এখানে আসবার জন্যে গেল কাল একজনকে টেলিগ্রাম করেছিলুম। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় উতরে গেল, তিনি এলেন না।
–কে তিনি?
শ্যামাপ্রসাদ সেন, থাকেন শ্রীরামপুরে। তাকে কী দরকার?
–খুনি কেন যে নেতাজির মূর্তিগুলো ভাঙত, হয়তো এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে তার কাছেই।
–প্রশ্নের উৎপত্তি কলকাতায়, আর উত্তর আসবে শ্রীরামপুরে থেকে, অবাক!
জয়ন্ত সচমকে বললে, মানিক দরজার একখানা গাড়ি এসে থামল না? একবার দেখে এসো তো।
মানিক ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এল একটি প্রাচীন ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে। তার ডান হাতে খবরের কাগজ দিয়ে মোড়া একটা জিনিস।
জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করলে, আপনিই কি শ্রীরামপুরের শ্যামাপ্রসাদবাবু?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু ঠিক সময়ে আসতে পারিনি বলে মাপ করবেন। আজকাল ট্রেনের ধরন-ধারণ জানেন তো?
-বসুন। নেতাজির মূর্তিটি এনেছেন তো?
–হ্যাঁ, এই যে আমার হাতে।
–উত্তম। তাহলে কাজের কথা হোক।
–জয়ন্তবাবু, আপনি কি সত্য-সত্যই মূর্তিটি তিনশো টাকা দিয়ে কিনতে চান?
–নিশ্চয়ই।
-কেমন করে জানলেন ওই মূর্তিটি আমার কাছে আছে?
–লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ম্যানেজার আমাকে বলেছেন।
-তাহলে একথাও শুনেছেন তো মূর্তিটি আমি কিনেছি কত টাকা দিয়ে?
–না।