–কোথায় যেতে হবে শুনি? বড়োবাজারে?
–না, চার নম্বর রাজেন রক্ষিত লেনে। আমি অঙ্গীকার করছি সুন্দরবাবু, আমার আন্দাজ ভুল হলে কাল আমি আপনার সঙ্গে বড়বাজারের বস্তিতে ভ্রমণ করতে যাব। কী বলেন, রাজি?
–হুম।
মানিক সকৌতুকে বলল, হুম? এখানে হুম মানে কী দাদা? হুঁ!
—তাই ধরে নাও।
জয়ন্ত টেবিলের সামনে গিয়ে একখানা কাগজে তাড়াতাড়ি কী লিখে সেখানা খামের ভিতর পুরলে। তারপর খামের উপরে ঠিকানা লিখতে লিখতে চেঁচিয়ে ডাকল, মধু! ওরে অ-মধু! শ্রীমধুসূদন! পুরাতন ভৃত্য মধু এসে হাজির।–আজ্ঞে বাবু।
—যাও তো বাপু, এই চিঠিখানা নিয়ে। তুমি তো পড়তে জাননা। খামের উপরে ঠিকানা লেখা আছে, পারো তো দৌড়ে যাও–বড্ড জরুরি চিঠি!
মধুর প্রস্থান। জয়ন্তের গাত্রোত্থান। সে বললে, সুদরবাবু তাড়াতাড়ি বাড়িতে গিয়ে খেয়ে দেয়ে খানিকটা গড়িয়ে নিন। রাত সাড়ে দশটার সময়ে আবার এখানে পদার্পণ করলেই চলবে। আমরা সাড়ে এগারোটার ভিতরে যাত্রা করব।
সুন্দরবাবু প্রস্থান। জয়ন্ত বললে, মানিক, আমাকে এখন পাশের ঘরে গিয়ে পুরানো খবরের কাগজের ফাইল ঘাঁটতে হবে। আজ রাত্রে বোধ হয় অনিদ্রারই ব্যবস্থা। তুমি ইচ্ছা করলে অল্পবিস্তর বিশ্রাম করতে পারো।
রাত্রি প্রায় দশটার সময়ে পাশের ঘর থেকে জয়ন্ত বেরিয়ে এল ধূলি ধূসরিত হস্তে।
সোফার উপরে লম্বা হয়ে শুয়েছিল মানিক। বললে, কী বন্ধু তোমার খুশি মুখ যে আরও খুশি হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে!
দুই ভুরু নাচিয়ে জয়ন্ত বললে, আমি যা খুঁজছিলাম তা পেয়েছি।
।। পাঁচ ।। হিরালালও কুপোকাত
রাত সাড়ে এগারোটা। সদর দরজায় অপেক্ষা করছিল জয়ন্তর মোটর। সুন্দরবাবুও মানিকের সঙ্গে সে মোটরে গিয়ে উঠল।
–সুন্দরবাবু যে সশস্ত্র সে-বিষয়ে সন্দেহ নাস্তি। মানিক, তুমিও রিভলভার এনেছ তো? জয়ন্ত বললে।
—সে কথা আবার বলতে? মানিকের উত্তর।
গাড়ি ছুটল। এ-রাস্তা ও-রাস্তা মাড়িয়ে গাড়ি যখন একটা চৌমাথায় হাজির হল, কলকাতা শহর তখন যেন ঘুমিয়ে পড়বার চেষ্টা করছে।
জয়ন্ত চালককে ডেকে বললে, গুট্টা সিং, গাড়ি থামাও। এখানেই তুমি আমাদের জন্য অপেক্ষা করো। আমাদের এখন শ্রীচরণই ভরসা। নাম মানিক, নামুন সুন্দরবাবু! আরে মশাই আপনার নাসাযন্ত্র যে সংগীত সৃষ্টি করবার চেষ্টা করছে। বলি ঘুমোলেন নাকি?
সুন্দরবাবু ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসে প্রকাণ্ড একটি হাই তুলে বললেন, ঘুমোইনি হে, ঘুমোইনি। এই বিষম গরমে শীতল সমীরণ সেবন করে কিঞ্চিৎ তন্দ্রাতুর হয়েছিলুম আর কী? আমি এখন সম্পূর্ণরূপে জাগ্রত। কী বলবে বলো—হুম।
–এইবার গাড়ি থেকে অবতরণ করবার সময় এসেছে।
—এসেছে নাকি? এই আমি নেমে পড়লুম।
—গাড়ি নিয়ে বেশি দূর যাওয়া সঙ্গত নয়। এইবার পদব্রজে মিনিট পাঁচেক অগ্রসর হতে হবে।
হুম—যো হুকুম। আমি প্রাচীন সৈনিক, যা বললা তাতেই রাজি। এই আমি সবেগে পদচালনা করলুম।
পথে আর লোক চলাচল নেই বললেই চলে। গোটা কয়েক কুকুর শহরের মৌনব্রত ভাঙবার চেষ্টা করছে এবং রাস্তার এখানে ওখানে দুই-তিন বা ততোধিক ষাঁড় গা এলিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে নির্বিকার ভাবে করছে রোমন্থন।
চার নম্বর রাজেন রক্ষিত লেন। রেলিং ঘেরা জমির ভিতর একখানা মাঝারি আকারের বাড়ি তার গায়ে কোথাও নেই আলোর রেখা। বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই শয্যায় আশ্রয় গ্রহণ করছে। রাস্তার ইলেকট্রিক পোস্টের আলোয় সুন্দরবাবু নামটা পাঠ করলেন—প্রফেসর সুরেশচন্দ্র বসু।
জয়ন্ত বললে, রাত্রেও এ বাড়ির ফটক বন্ধ হয় না দেখছি। চলুন সুন্দরবাবু, বাগানে ওই হামুহানার ঝোপের আড়ালে গিয়ে আমরা লুকিয়ে থাকি। নয়তো অনেক রাত পর্যন্ত আমাদের মশকদংশন সহ্য করতে হবে। হয়তো সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেও আমাদের ভাগ্যে লাভ হবে প্রকাণ্ড একটি অশ্বডিম্ব! উপায় কী, যে পূজার যে মন্ত্র।
কিন্তু জয়ন্তের আশঙ্কা সফল হল না। আধ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই কোথা থেকে আচমকা দেখা দিল একটা ছোট্ট কালো মূর্তি, তিরের মতন বাগানের ভিতর ছুটে এসেই সে বাড়ির ছায়ার ভিতরে কোথায় হারিয়ে গেল। ঠিক যেন একটা বানর। কয়েক মূহুর্ত কেটে গেল নীরবে। তারপর একটা শব্দ কে যেন একটা জানালা খুলছে ধীরে ধীরে। তারপর আবার সব চুপচাপ।
জয়ন্ত বললে, এসো মানিক, আমরা জানলার নীচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। চোর বাইরে বেরুলেই গ্রেপ্তার করব।
কিন্তু তারা দুই-এক পা এগুবার আগেই বাড়ির ভিতর থেকে আবার হল সেই মূর্তিটার আবির্ভাব। তার হাতের তলায় রয়েছে সাদা মতন কী একটা জিনিস। সে চারদিকটা একবার চটপট দেখে নিলে। এখনকার নীরবতার ও নির্জনতায় বোধ হয় আশ্বস্ত হল। হাতের জিনিসটা মাটির উপরে নামিয়ে রাখলে। তারপর জেগে উঠল ফটাফট শব্দ।
জয়ন্ত সঙ্গীদের নিয়ে বেগে ছুটে এল তার দিকে। লোকটা তখন হেঁট হয়ে এমন একাগ্র মনে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে যে কিছু বুঝতে পারলে না। তার পিঠের উপরে বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ল জয়ন্ত। এবং সে কোনও বাধা দেবার আগেই মানিকের সাহায্যে সুন্দরবাবু হাতকড়া দিয়ে তার দুই হাত করলেন বন্দী। তাকে চিত করে ফেলতেই দেখা গেল তার হাড়কুৎসিত বেলুনের মুখখানা অবিকল সেই ফটোগ্রাফের প্রতিচ্ছবি।
জয়ন্ত মাটির উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল—সেখানে ইতস্তত বিকীর্ণ হয়ে আছে নেতাজির আর একটি মূর্তির ভাঙা টুকরো। সে একে একে টুকরোগুলো তুলে নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে লাগল।