–বিচারে তার শাস্তি হয়?
হ্যাঁ। যাকে ছোরা মেরেছিল সে মরেনি বলে হিরালাল সে যাত্রা বেঁচে যায়। মাত্র এক বছর জেল খেটে এখন সে বোধ হয় মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু সে আর এমুখো হবার ভরসা করবে না। তার এক সম্পৰ্কীয় ভাই এখানে কাজ করে, তারও সঙ্গে কথা কইবেন নাকি?
জয়ন্ত ব্যস্তভাবে বলে উঠল, না না, তাকে ডাকবার দরকার নেই। অনুগ্রহ করে তাকে আমাদের কোনও কথাই জানাবেন না।
–ব্যাপারটা কি গোপনীয়?
—হ্যাঁ, অত্যন্ত। তারপর আর একটি জিজ্ঞাস্য আছে। পাকা খাতা দেখে আপনি তো বললেন যে নেতাজির ওই ছয়টি মূর্তি গেল বছরের ৩রা জুন তারিখে এখান থেকে বাইরে গিয়েছে। আচ্ছা, হিরালাল গ্রেপ্তার হয় কোন তারিখে বলতে পারেন?
—ঠিক তারিখ মনে নেই। তবে সে কোন তারিখে শেষ মাইনে নিয়েছে খাতা দেখে তা বলতে পারি।
–বেশ, তাহলেই আমার চলবে।
খাতার পাতা উলটে ম্যানেজার বললেন, হিরালাল শেষ মাইনে নিয়েছে গেল বছরের ১০ই মে তারিখে। সে প্রায় ওই সময়েই গ্রেপ্তার হয়।
–ধন্যবাদ। আর আপনাকে জ্বালাতন করব না। এসো মানিক।
বৈকালবেলায় জয়ন্ত ও মানিকের আবির্ভাব হল শ্যামবাজারের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে। মস্ত বড় দোকান—অনেকগুলো বিভাগ। তারা একেবারে ম্যানেজারের সঙ্গে গিয়ে দেখা করলে।
তাদের পরিচয় পেয়ে ম্যানেজার বললেন, হ্যাঁ মশাই, হারাধনবাবুর বাড়ির খবর আমরা পেয়েছি। তিনি আমাদের পুরানো খরিদ্দার। নেতাজির মূর্তিটি আমাদের এখান থেকেই কিনেছিলেন বটে।
জয়ন্ত শুধোলে, আপনাদের এখানে আরও দুটি নেতাজির মূর্তি আছে?
–না মশাই নেই। বিক্রি হয়ে গিয়েছে। যারা কিনেছেন তারাও আমাদের চেনা খরিদ্দার। খাতায় তাদের নাম আর ঠিকানা আছে।
–তাই আমি চাই।
–খাতা দেখে ম্যানেজার বললেন, একজনের নাম প্রফেসার সুরেশচন্দ্র বসু, ঠিকানা–চার নম্বর রাজেন রক্ষিত লেন, কলকাতা। আর-একজন শ্যামাপ্রসাদ সেন। ঠিকানা-সাত নম্বর চন্দ্রকান্ত রোড, শ্রীরামপুর।
—আপনাদের কর্মচারীরা ইচ্ছা করলেই এ খাতার উপরে চোখ বুলোতে পারে তো?
—তা পারবে না কেন! এ খাতা তত গোপনীয় নয়।
–ফটোর এই লোকটাকে কখনও দেখেছেন?
—জীবনে নয়! অমন বাঁদুরে চেহারা একবার দেখলে ভোলা অসম্ভব!
—হ্যাঁ, আর একটা প্রশ্ন। আপনার এখানে জয়পুরের কোনও লোক কাজ করে?
–করে বইকি! একজন নয়, তিনজন।
—আচ্ছা মশাই, নমস্কার।
।। চার ।। খুশি মুখ আরও খুশি
সান্ধ্য চায়ের বৈঠক।
মানিক বললে, তোমার মুখ যে আজ ভারী খুশি খুশি দেখাচ্ছে জয়ন্ত।
–বুঝতে পেরেছ?
—তোমাকে দেখে আমি বুঝতে পারব না? তোমার মুখ যে আমার কাছে দশবার-পড়া কেতাবের মতো পুরানো।
–উপমায় তুমি দেখছি কালিদাস।
—খুশি হবার কারণটা কী বলো দেখি?
—সবুর করো, সবুরে মেওয়া ফলে। আমি এখন সুন্দরবাবুর জন্যে অপেক্ষা করছি। না না আর অপেক্ষা করতে হবে না। সিঁড়ির উপরে যে ওই তাঁর পায়ের শব্দ।
মানিক চেঁচিয়ে বললে, ইংরেজিতে প্রবাদ আছে যে স্মরণ করলেই শয়তান দেখা যায়। তুমি সুন্দরবাবুকে স্মরণ করেছ, সুতরাং–
ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে সুন্দরবাবু বললেন, তোমার কথা আমি শুনতে পেয়েছি মানিক। আমাকে কার সঙ্গে তুলনা করছ?
—তুলনা নয়, আমি একটা প্রবাদের কথা বলছিলুম।
—চুলোয় যাক তোমার প্রবাদ। ওসব ছেড়া কথায় কান দেবার সময় আমার নেই। তাঁ হে জয়ন্ত, তোমার খবর কী?
–ভালো। নেতাজির মূর্তি নিয়ে আজ যথেষ্ট গবেষণা করা গিয়েছে।
–নেতাজির মূর্তির পিছনে এখনও তুমি লেগে আছ? বেশ, বেশ—যার যা পদ্ধতি, আমি আপত্তি করব না। আমি কিন্তু এবারে তোমাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে এসেছি।
—আঁ, তাই নাকি?
—যে লোকটা খুন হয়েছে তাকে শনাক্ত করতে পেরেছি।
–বলেন কী!
—খুনের কারণও আবিষ্কার করে ফেলেছি!
—সাধু সাধু!
—অবনীবাবুকে জানো তো? ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের, যত মেড়য়াবাদীর নাম-ধামচেহারা তাঁর নখদর্পণে। লাশটা দেখেই তিনি চিনে ফেলেছেন। যার লাশ তার নাম হচ্ছে রাধাকিষণ, দেশ জয়পুরে। লোকটা নাকি পয়লা নম্বরের গুন্ডা, একটা মস্ত দলের সর্দার। অথচ সে হচ্ছে ভদ্র বংশের ছেলে। দেশে সুমিত্রা নামে তার এক ভগ্নী আছে, সে-ও একবার একটা চুরির মামলায় জড়িয়ে পড়ে কিন্তু প্রমাণ অভাবে খালাস পায়। তাহলেই ব্যাপারখানা কতটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে, বুঝেই দ্যাখো। আমার কী আন্দাজ জানো? যে তাকে খুন করেছে সেও তার দলের লোক। যে-কোনও কারণে রাধাকিযণ তাকে পথ থেকে সরাতে চেয়েছিল। ঘটনার রাতে হঠাৎ তাকে হারাধনবাবুর বাড়িতে ঢুকতে দেখে সে তার অপেক্ষায় পথের উপরে দাঁড়িয়েছিল। তারপর সে বেরিয়ে এলে তাকে আক্রমণ করতে গিয়ে রাধাকিষণ নিজেই পটল তুলতে বাধ্য হয়। কী বলো জয়ন্ত, আমার আন্দাজ কি ভুল?
জয়ন্ত হাততালি দিয়ে বলে উঠল, খাসা সুন্দরবাবু! কিন্তু একফোটা চোনা রয়ে গেল নাকি?
–কেন?
—খুনি নেতাজির মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলে কেন?
—আরে রেখে দাও নেতাজির মূর্তি। ও কথা কি কিছুতেই ভুলতে পারবে না। তুচ্ছ পুতুল চুরি, বড়োজোর ছয় মাস জেল। কিন্তু আসলে এটা খুনের মামলা আর সেইটাই হচ্ছে কর্তব্য।
–এরপর আপনার কী কর্তব্য হবে?
—খুব সোজা। অবনীবাবুকে নিয়ে যাব বড়োবাজারের বস্তিতে, খুব সম্ভব ফটোর লোকটাকে তাহলে আজকেই গ্রেপ্তার করতে পারব। তুমি কি আমাদের সঙ্গে আসবে?
–উঁহু। আমার বিশ্বাস আরও সহজে আসামির দেখা পেতে পারি। অবশ্য আমি জোর করে কিছুই বলতে চাই না। আপনি যদি আজ রাত্রে আমাদের সঙ্গে আসেন, আর দৈব যদি সহায় হয়, তাহলে হত্যাকারী নিজেই আপনার হাতের মুঠোর ভিতরে এসে পড়বে।