—যে লোকটা খুন হয়েছে, সে হঠাৎ এসে পড়াতেই হয়তো মূর্তিটাকে ঘটনাস্থলে ভেঙে ফেলা সম্ভবপর হয়নি।
—হতে পারে। কিন্তু বাগানের ভিতরে এই বাড়ির অবস্থানের দিকে আপনি ভালো করে লক্ষ করেছেন কি?
সুন্দরবাবু চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, আরে লক্ষ করে আবার করব কী? এটা হল খালি বাড়ি, আসামি তাই বুঝেছিল যে, কেউ তার কার্যকলাপের দিকে দৃষ্টি রাখতে পারবে না।
—আপনি হয়তো দেখেননি, কিন্তু আমি দেখেছি যে হারাধনবাবুর বাড়ি থেকে এখানে আসবার আগেই পাওয়া যায় আর একখানা খালি বাড়ি! আসামি সেখানেই মূর্তিটা ভাঙেনি কেন? সে কেবল মূর্তি চুরি করেনি, একটা নরহত্যাও করেছে, যত দূর মূর্তিটা বহন করে নিয়ে আসবে তার পক্ষে ততই বেশি বিপদের সম্ভাবনা। তবু কেন সে গ্রহণ করেনি মূর্তি ভাঙবার প্রথম সুযোগ?
সুন্দরবাবু হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, তোমার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই।
মাথার উপরকার আলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে জয়ন্ত বললে, আগেকার খালি বাড়িতে আলো ছিল না, কিন্তু এখানে আলো আছে। আসামি অন্ধের মতো মূর্তি ভাঙতে রাজি নয়, মূর্তির ভাঙা টুকরোগুলো ভালো করে স্বচক্ষে দেখতে চায়।
—এত্থেকে কী বুঝব?
—আপাতত কিছুই বোঝবার দরকার নেই। পরে হয়তো এটা একটা বড়ো সূত্র বলে গণ্য হবে। যাক। এখন আপনি কী করতে চান সুন্দরবাবু?
—আমি। আমি আগে দেখব মৃতদেহটা কেউ শনাক্ত করতে পারে কি না। সে কে আর তার বন্ধুবান্ধবই বা কারা, এটা জানতে পারলে মামলাটার কিনারা করা কিছুই কঠিন হবে না। তাই নয় কি?
—খুব সম্ভব তাই। আমি কিন্তু অন্যভাবে মামলাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চাই।
–কী রকম?
—আপাতত আমার মত আপনার ঘাড়ে চাপাতে আমি রাজি নই। আমরা স্বাধীন ভাবে কাজ করি আসুন। খানিকটা অগ্রসর হবার পর আবার দুজনে মিলে পরামর্শ করা যাবে, কী বলেন?
—বহুৎ আচ্ছা।
মৃতের পকেট থেকে যে-ফটোখানা পাওয়া গেছে সেখানা আমায় দিতে পারেন?
—এই নাও, কিন্তু ছবিখানা কালকেই ফিরিয়ে দিয়ে।
—উত্তম! এখন বিদায় হলুম! খানিক দূরে এসে জয়ন্ত ডাকলে, মানিক।
–উঃ।
–হারাধনবাবু নেতাজির মূর্তিটি কিনেছিলেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে। চলো, সেখানে যাই।
শ্যামবাজারের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে গিয়ে শোনা গেল, দোকানের মালিক অনুপস্থিত। বৈকালের আগে ফিরবেন না।
জয়ন্ত বললে, আপাতত লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে আমাদের ঠাঁই হল না। অতঃপর হাঁড়ির অন্য ভাত টিপে দেখতে হবে। চলো মানিক চিৎপুর রোডের শিল্পশালায়।
শিল্পশালার মালিক অনিলবাবু জয়ন্তের প্রশ্ন শুনে বললেন, হ্মা মশাই। ওই কাউন্টারের উপরেই ছিল নেতাজির মূর্তিটা। যদি কোনও বদমাইশ যখন খুশি যেখানে-সেখানে ঢুকে যা ইচ্ছে তাই করে লম্বা দিতে পারে, তাহলে মিথ্যে আমরা টেক্সো দিয়ে মরি কেন?
—ডাক্তার চারু চক্রবর্তীও তো আপনার কাছ থেকে নেতাজির আর-দুটো মূর্তি কিনেছিলেন?
—আজ্ঞে হ্যাঁ কিন্তু সেখানেও তো শুনছি এই কাণ্ড হয়েছে। এ সব আর কিছু নয়, কমিউনিস্টদের কীর্তি।
—আপনার এখানে নেতাজির আর কোনও মূর্তি আছে?
–না মশাই আর নাই।
—ওই মূর্তি তিনটি আপনি কোথা থেকে কিনেছিলেন?
–বড়োবাজারে আগরওয়ালা অ্যান্ড সন্স থেকে। ওঁদের অনেক দিনের মস্তকড়ো কারবার।
–এই ফটোখানা কার বলতে পারেন?
—উহুঁ। না, না, চিনেছি? হিরালাল!
—হিরালাল কে?
—পাথরের কারিগর। অল্পস্বল্প মূর্তি গড়তে আর ছবির ফ্রেম গিলটি করতে পারে। গেল হপ্তাতেও সে এখানে কাজ করে গেছে। তার ঠিকানা আমি জানি না। সে চলে যাবার ঠিক দুদিন পরেই আমার দোকানের নেতাজির মূর্তিটা ভেঙে দিয়ে পালিয়ে যায়।
শিল্পশালার বাইরে এসে মানিক বললে, তুমি কোন তালে আছ কিছুই বুঝছি না জয়ন্ত। এইবারে কোন দিকে যাত্রা?
–বড়োবাজারে। আগরওয়ালা অ্যান্ড সন্স কারখানায়।
বড়বাজারে–অন্ধকার ও দুর্গন্ধের মুলুক। সংকীর্ণ অলিগলির অত্যান্ত জনস্রোত ভেদ করে জয়ন্ত ও মানিক যথাস্থানে এসে হাজির হল। ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে একটা দ্বারপথ দিয়ে তারা দেখতে পেলে, উঠানে বসে কারিগরদের কেউ পাথর কাটছে, কেউ ছাঁচ থেকে মূর্তি গড়ছে।
ম্যানেজার মাড়োয়ারি। জয়ন্তের জিজ্ঞাসার জবাবে পুরাতন খাতা খুলে দেখে বললেন, আমরা নেতাজির অনেক মূর্তি গড়েছি। বছরখানেক আগে একই ছাঁচ থেকে নেতাজির যে মূর্তি গড়া হয় তার মধ্যে তিনটে গিয়েছে শিল্পশালায় আর বাকি তিনটি পাঠানো হয়েছে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে। পরে ওই ছাঁচ থেকে আরও অনেক মূর্তি গড়া হয়েছে বটে, কিন্তু সেগুলি পাঠানো হয়েছে কলকাতার বাইরে।
—মূর্তিগুলি কেমন করে তৈরি করা হয়।
–মুখের দুই ধার থেকে নেওয়া দুটো ছাঁচ। তারপর ছাঁচ দুটো একসঙ্গে যুক্ত করে মূর্তি গড়া হয়। ভিতরটা থাকে ফাঁপা। ভিজে প্লাস্টার শুকিয়ে গেলে গুদামজাত করা হয় মূর্তিগুলো।
জয়ন্ত ফটোখানা বার করে বললে, একে চেনেন কি?
ম্যানেজারের মুখে-চোখে ফুটে উঠল ক্রোধের চিহ্ন। উত্তপ্ত ভাবে তিনি বললেন, সেই বদমাইশ হিরালাল। ওকে আবার চিনি না, খুব চিনি! ওরই জন্যে আমাদের কারখানায় হাঙ্গামা হয়।
-তাই নাকি?
—হ্যাঁ মশাই হ্যাঁ। হিরালাল জয়পুরের লোক। সে আর এক জয়পুরিয়াকে ছোরা মেরে এসে ভালোমানুষের মতো কারখানায় বসে কাজ করছিল, তারপর পুলিশ আমাদের কারখানায় ঢুকে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, আর আমাদেরও ছুটোছুটি করে মরতে হয় থানায় আর আদালতে। ওরকম বাঁদরমুখো মানুষকে কাজ দিয়ে আমরাই অন্যায় করেছিলুম। কিন্তু মশাই, সে খুব পাকা কারিগর।