বিরসবদনে হারাধনবাবু বললেন, এ যেন প্রকৃতির নির্দয় পরিহাস। পরের খবর সংগ্রহ করতে করতে সারাজীবন কাটিয়ে দিলুম, আর আমার নিজের বাড়ির এত বড়ো খবরটা নিয়ে কাগজে পাঠাতে পারছি না, আমার মাথা এমন ভয়ানক গুলিয়ে গিয়েছে। বাইরের রিপোর্টারের মতন আমি যদি এখানে আসতুম, প্রত্যেক কাগজের জন্য অন্তত দু-কলম করে খবর পাঠাতে পারতুম। তা তো হলই না, উলটে এর ওর তার কাছে বারবার বলে খবর ক্রমেই বাসি করে ফেলছি। তবে আপনার কথা আলাদা জয়ন্তবাবু। আপনি যদি সব শুনে এই অদ্ভুত রহস্যের কোনও হদিস দিতে পারেন তবে আমার মস্ত লাভ হতে পারে।
জয়ন্ত চুপ করে শুনলে, কিছু বললে না।
হারাধনবাবু বললেন, মাস চারেক আগে শ্যামবাজারের লক্ষীর ভাণ্ডার থেকে আমি নেতাজির একটি প্রতিমূর্তি কিনেছিলাম। মনে হচ্ছে সেই মূর্তির জন্যেই এই অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা। বাড়ির সব উপরকার ঘরে বসে অনেক রাত পর্যন্ত আমাকে কাজ করতে হয়, কালও করছিলুম।
গভীর রাতে বাড়ির একতলায় একটা যেন শব্দ হল। খানিকক্ষণ কান পেতে রইলুম, কিন্তু আর কিছু শুনতে না পেয়ে ভাবলুম, শব্দটা এসেছে বাড়ির বাহিরে থেকেই। মিনিটপাঁচেক কাটল। তারপর বিষম এক আর্তনাদ। জয়ন্তবাবু অমন ভয়াবহ আর্তনাদ আমি জীবনে আর কখনও শুনিনি। তার স্মৃতি জীবনে আর কোনওদিন ভুলতে পারব না, ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে দু-এক মিনিট চুপ করে বসে রইলুম তারপর একগাছা লাঠি নিয়ে নীচে নেমে এলুম। বৈঠকখানায়—অর্থাৎ এই ঘরে ঢুকে দেখি, টেবিলের উপর থেকে, অদৃশ্য হয়েছে। নেতাজির প্রতিমূর্তিটা! সব ফেলে এই কম দামি জিনিসটা নিয়ে গিয়ে চোরের কী লাভ হবে, কিছুই বুঝতে পারলুম না।
এমন সময় নজর পড়ল, বৈঠকখানা থেকে রাস্তার দিকে যাবার দরজাটা রয়েছে খোলা। এই পথ দিয়েই চোর পালিয়েছে বুঝে আমিও অগ্রসর হলুম। বাইরে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার, হঠাৎ একটা দেহের উপর ঠোক্কর খেয়ে পড়ে যেতে যেতে সামলে নিলুম কোনও গতিকে। দেহটার অস্বাভাবিক স্পর্শ পেয়েই বুঝলুম, সে হচ্ছে মৃতদেহ।
দৌড়ে বাড়িতে এসে একটা লণ্ঠন নিয়ে ফিরে গিয়ে দেখি যেন রক্ত-নদীর ভিতর ভাসছে। একটা মানুষের মৃতদেহ, গলার উপরে তার প্রচণ্ড অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন। চিত হয়ে সে পড়ে আছে, হাঁটুদুটো গুটানো, মুখটা বিশ্রী ভাবে হাঁ করা! মশাই, এবার থেকে রোজ সে বোধ হয় স্বপ্নে আমাকে দেখা দেবে। পুলিশ, পুলিশ! বলে বারকয়েক চিৎকার করে আমি তখনই অজ্ঞান হয়ে গেলুম। তারপর কী হয়েছিল জানি না, কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান আসায় দেখলুম আমার শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে এক পাহারাওয়ালা।
সব শুনে জয়ন্ত বললে, কিন্তু মৃতদেহটা কার?
সুন্দরবাবু বললেন, হুম, সেইটেই হচ্ছে প্রশ্ন। লাশটা শবাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখানে গেলেই দেখতে পাবে। এখন পর্যন্ত আমরা কিছুই ঠিক করতে পারিনি। লোকটা বেশ ঢ্যাঙা-ঢঙা, গায়ের রং রোদে-পোড়া, দেখতে রীতিমতো জোয়ান, বয়স ত্রিশের বেশি নয়। পরনে তার গরিবের কাপড়, কিন্তু তাকে শ্রমিক বলে মনে হয় না। তার পাশে রক্তের ভিতরে পড়েছিল একখানা চাকু ছুরি—সেখানা তার নিজের না হত্যাকারীর তা জানবার উপায় নেই। তার জামার পকেটের ভিতরে পাওয়া গিয়েছে সস্তায় তোলা একখানা ফোটোগ্রাফ। এই দ্যাখো।
কর্কটের মতন একটা মূর্তির ছবি, চেহারা দেখলে কার্তিক বলে ভ্রম হয় না। মুখ যেন বেবুনের মতো। পুরু পুরু ভুরু।
ফটোখানা ভালো করে পরীক্ষা করে জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করলে নেতাজি মূর্তির খবর কী?
—তোমার আসবার একটু আগে সে খবর পেয়েছি। এখান থেকে খানিক তফাতে মনোমোহন রোডে একখানা খালি বাড়ির সামনেকার বাগানে খণ্ড-বিখণ্ড অবস্থায় মূর্তির ভগ্নাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। আমি সেখানে যাচ্ছি, তুমিও আসবে নাকি?
—নিশ্চয়! হারাধনবাবু কি তাঁর সম্পত্তির ভগ্নাবশেষ দেখতে চান? হারাধনবাবু ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, সময় নেই মশাই, সময় নেই। এই হত্যাকাণ্ডের খবর এতক্ষণে। নিশ্চয় অন্য অন্য রিপোর্টারদের হাতে গিয়ে পড়েছে, অথচ আমার বাড়িতে খুন, আর আমি কিছু লিখতে পারলুম না। হায়রে, এমনি আমার দগ্ধদৃষ্ট।
।।তিন ।। হিরালাল
যে-মহামানুষকে নিয়ে ভারতে এবং ভারতের বাইরে বিস্ময়কর আন্দোলনের সাড়া পড়ে গিয়েছিল, যাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দু ও মুসলমান পরস্পরকে সত্যিকার ভাই বলে মেনে নিয়েছিল এবং যাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবকে বাধা দিতে গিয়ে মহাত্মা গান্ধিকে পর্যন্ত প্রকাশ্যে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিল তারই খণ্ড-বিখণ্ড প্রতিমূর্তির স্বাভাবিক পরিণাম দেখে জয়ন্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ।
তারপর সে ভগ্নমূর্তির এক-একটা টুকরো একে একে কুড়িয়ে নিয়ে অত্যন্ত মনোেযোগর সঙ্গে পরীক্ষা করতে লাগল।
তার মুখ দেখেই মানিক বুঝতে পারল যে এতক্ষণ পরে জয়ন্ত একটা না একটা সূত্র খুঁজে পেয়েছে।
জয়ন্ত বললে, স্পষ্ট গন্ধ পেতে এখনও দেরি আছে কিন্তু তবু—তবু তবু—হ্যাঁ, একটু আলোর আভাস পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে যেন। অদ্ভুত অপরাধটি এই মামলার সঙ্গে জড়িত, তার কাছে এই যৎসামান্য পুতুলের মূল্য যে-কোনও মানুষের প্রাণের চেয়েও বেশি! অথচ পুতুলটা হস্তগত করেই সে ভেঙে ফেলে!
–পাগলের পাগলামি আর কাকে বলে?
-না, তা নয় সুন্দরবাবু। একটা মস্ত কথা ভেবে দেখুন। মূর্তিটা সে হারাধনবাবুর বাড়ির ভিতরেও ভাঙেনি, বাইরেও ভাঙেনি, ভেঙেছে এত দূরে এসে—অথচ তার উদ্দেশ্য ছিল মূর্তিটা হাতে পেলে ভেঙে ফেলা।