দত্ত। কী পুরস্কার, বলুন।
লতিকা। কাল ভোরেই আপনার মোটরে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে পারবেন?
দত্ত। নিশ্চয়, নিশ্চয়!
নেতাজির ছয় মূর্তি
[নেতাজির ছয় মূর্তি গ্রন্থটি মমতাজ বেগমের কালো মুক্তো নামেও প্রকাশিত হয়েছে।]
।। এক ।। অসাধারণ পাগলামি
চায়ের পালা শেষ।
জয়ন্ত বললে, মানিক অতঃপর কিংকর্তব্য। এক চাল দাবাবোড়ে খেলবে নাকি?
—রাজি! মানিক উঠে দাবাবোড়ের ছক আনতে গেল।
–সুন্দরবাবু কী করবেন? খেলা দেখবেন, না থানায় ফিরবেন?
—ওই ইজিচেয়ারে আরাম করে পা ছাড়িয়ে শুয়ে আমি একটা গোটা চুরুটকে ভষ্মে পরিণত করব।
-হাতে বুঝি নতুন মামলা নেই?
—বিশেষ কিছু নাই।
—তবু শুনি না। খুঁটি সাজাতে সাজাতে বললে জয়ন্ত।
—এ একটা নিতান্ত বাজে মামলা ভাই, ল্যাজা কি মুড়ো কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। এ মামলায় গোয়েন্দা না ডেকে ডাক্তার ডাকাই উচিত।
—অর্থাৎ?
—পাগলামি আর কী? কিন্তু অদ্ভুত রকম পাগলামি। সুভাষচন্দ্র বসুকে সারা দেশ ভক্তি করে তো? কিন্তু দেশে এমন লোকও আছে, যে নেতাজির প্রতিমূর্তি দেখলেই খেপে গিয়ে আছড়ে চুরমার করে দেয়।
—ধেৎ, ও নিয়ে আমার মাথা ঘামাবার দরকার নেই। জয়ন্ত একটা বোড়ের চাল দিলে।
—হ্যাঁ, পাগলামি সারাবার জন্যে ডাক্তার ডাকা উচিত। কিন্তু কেউ যদি নেতাজির উপরে নিজের আক্রোশ মেটাবার জন্যে পরের বাড়িতে ঢুকে নেতাজির প্রতিমূর্তি চুরি করে, তাহলে পুলিশ না ডেকে উপায় থাকে না।
জয়ন্ত খেলা ভুলে সিধে হয়ে বসে বললে, মূর্তি ভাঙবার জন্যে মূর্তি চুরি? ব্যাপারটা চিত্তাকর্ষক বলে মনে হচ্ছে! বলুন তো খুলে!
—চিৎপুর রোডে শিল্পশালা বলে এক দোকান আছে, তার মালিক হচ্ছেন অনিল বসু। ওখানে বিক্রি হয় নানারকম ছবি আর মূর্তি। দোকানের এক কর্মচারী সামনের দিক ছেড়ে পেছন দিকে গিয়ে কোনও কাজে ব্যস্ত ছিল, হঠাৎ একটা লোক দোকানে ঢুকে কাউন্টারের উপর থেকে নেতাজির প্রতিমূর্তি তুলে নিয়ে মাটির উপরে আছড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলে। তারপর এত তাড়াতাড়ি সে পালিয়ে যায় যে কেউ তাকে ধরতে পারেনি। এ হচ্ছে চার দিন আগেকার কথা। দোকানের মালিক বিটের পাহারাওয়ালার কাছে অভিযোগ করেছিল বটে, কিন্তু ওই পর্যন্ত! প্লাস্টারে গড়া মূর্তি, দাম দশ টাকা মাত্র তুচ্ছ ব্যাপার!
তারপর দ্বিতীয় ঘটনা। এটা কিঞ্চিৎ গুরুতর, অদ্ভুত বটে। ঘটেছে কাল রাত্রে।
ডাক্তার চক্রবর্তীর নাম শুনেছ তো? তাঁর বাসভবন হচ্ছে সিমলায়, আর ডাক্তারখানা কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে। তিনি নেতাজির গোঁড়া ভক্ত। ওই শিল্পকলা থেকেই তিনি নেতাজির দুটি প্রতিমূর্তি কিনেছিলেন। তার একটিকে রেখেছিলেন বসত বাড়িতে আর একটিকে ডাক্তার খানায়। কাল রাত্রে বাড়িতে চোর ঢুকেছিল; কিন্তু আশ্চর্য এই যে, সে নেতাজির মূর্তি ছাড়া আর কিছুই চুরি করেনি। বাড়ির বাইরেকার বাগানে গিয়ে মূর্তিটা দেওয়ালে আছড়ে ভেঙে সে লম্বা দিয়েছে।
জয়ন্ত চমৎকৃত হয়ে বললে, আজব কাণ্ড। তিনটে মূর্তিই কি এক ছাঁচ থেকে গড়া?
-হ্যাঁ তারপর শশানো। আজ সকালে চারুবাবু ডাক্তারখানায় ঢুকে দেখেন, সেখানেও কাল রাত্রে কে এসে নেতাজির মূর্তি নিয়ে ভেঙেছে আর মেঝের উপর ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে তার ভাঙা টুকরোগুলো! এই তো ব্যাপার, জয়ন্ত! এ কীরকম মামলা ভায়া?
—কেবল অদ্ভুত নয়, সৃষ্টিছাড়া বলাও চলে। কিন্তু লোকটা যদি পাগল হয়, তাহলে তার পাগলামির ভিতর বেশ একটি পদ্ধতি আছে দেখছি।
—পদ্ধতি?
—হ্যাঁ! চারুবাবুর বাড়ি থেকে মূর্তিটা সে বাইরে নিয়ে গিয়েছিল পাছে মূর্তি ভাঙার শব্দে বাড়ির লোকের ঘুম ভেঙে যায় এই ভয়ে! ডাক্তারখানায় অন্য লোকের ভয় নেই, তাই মূর্তিটা ভাঙা হয়েছে ঘরের ভিতরেই। ঘটনাগুলো আপাতত অকিঞ্চিৎকর বলেই মনে হচ্ছে। বটে, কিন্তু জানেন তো সুন্দরবাবু গোয়েন্দার কাছে অকিঞ্চিৎকর নয় কিছুই। আমি একবার ঘটনাস্থলে একগাছা ভাঙা লাঠি পেয়ে হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করেছিলুম। যাক সে কথা। এই পাগল আবার যদি কোনও কাণ্ড করে আমাকে জানাবেন। এখন আপনি খান চুরুট, আমরা খেলি দাবা-বোড়ে।
।।দুই ।। হারাধনবাবুর দগ্ধাদৃষ্ট
নতুন ঘটনা ঘটতে দেরি লাগল না।
পরদিন প্রভাত। টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং শুনে রিসিভারটা তুলে নিয়ে জয়ন্ত শুনলে সুন্দরবাবু বলেছেন: শিগগির এসো। পনেরো নম্বর পঞ্চানন পাল স্ট্রিটে।
রিসিভারটা যথাস্থানে স্থাপন করে মানিকের দিকে ফিরে জয়ন্ত বললে, চটপট চুমুক দিয়ে চা শেষ করো। সুন্দরবাবুর আমন্ত্রণ এসেছে।
—ব্যাপারটি কী?
—ঠিক বোঝা গেল না। খুব সম্ভব সেই মূর্তি ধ্বংসকারী উন্মত্তের নতুন কীর্তি।
পঞ্চানন পাল স্ট্রিটের পনেরো নম্বর হচ্ছে একখানা সাধারণ বাড়ি, দরজার সামনে রাস্তার উপরে কৌতূহলী জনতা।
জয়ন্ত বললে, এত ভিড় কেন? নিশ্চয় যা তা ব্যাপার নয়। এই যে বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন সুন্দরবাবুর। কী মশাই খবর কী?
সুন্দরবাবু গম্ভীর মুখে বললেন বাড়ির ভিতরে এসো।
বৈঠকখানায় বসে আছেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক, তার ভাবভঙ্গি অত্যন্ত উত্তেজিত।
সুন্দরবাবু বললেন, ইনি হচ্ছেন বিখ্যাত রিপোর্টার হারাধনবাবু। তোমাদের পরিচয় আর দিতে হবে না, ইনি তোমাদের চেনেন।
–জরুরি তলব করেছেন কেন?
—হুম, আবার সেই নেতাজির মূর্তির মামলা।
—আবার নতুন কোনও মূর্তিভঙ্গ হয়েছে?
—আবার মূর্তিভঙ্গের উপর হত্যাকাণ্ড! হারাধনবাবু ব্যাপারটা খুলে বলুন তো।