সরল। মি. দত্ত, মি. দত্ত! আপনার বাবুর্চি যদি পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হয়, তাহলেও তার হাতের রান্না খাওয়ার জন্যে আমার আর একটুও লোভ নেই। হা ভগবান, নিয়তিঃ কেন বাধ্যতে!
অমিয়। তাই তো সরল, এ আমরা কোথায় এসে পড়লুম! আবার ফিরে গিয়ে ভাঙা গাড়িতেই বসে থাকব নাকি?
সরল। বাপ, সেটা হবে আরও ভয়ানক! যে মুল্লুকে ঘরের ভেতরই এমন কাণ্ড, রাত্রে সেখানে বাইরে থাকলে কি আর রক্ষা আছে?
দত্ত। আমার সঙ্গে মিলিটারি পুলিশ আছে, আর আপনাদেরও হাতে বন্দুক আছে। দেখছি। সুতরাং অতটা ভয় পাওয়ার কারণ নেই।
সরল। না স্যার, বিলক্ষণ ভয় পাওয়ার কারণ আছে। আমাদের দেহই যদি বাতাসে মিলিয়ে যায়, বন্দুক নিয়ে করব কী?
অমিয়। সন্ধ্যার অন্ধকারে চারদিক ঢেকে গেল। বনের ভেতরে ফেউ ডাকছে, নিশ্চয়ই বাঘ বেরিয়েছে। কপালে যা আছে তাই হবে, কিন্তু এখন আমাদের আর বাইরে থাকা উচিত নয়।
দত্ত। হ্যাঁ, এইবারে ভেতরে চলুন। কিন্তু দেখবেন, মিসেস সেন যেন ঘুণাক্ষরেও কোনও কথা না শশানেন! সরলবাবু আজ আমার সঙ্গেই শোবেন, অমিয়বাবুর ঘরের চারদিকেই পাহারার ব্যবস্থা থাকবে। এ কদিন যখন কিছুই হয়নি, তখন আজকের রাতটাও হয়তো ভালোয় ভালোয় কেটে যাবে।
সরল। মি. দত্তের কথাই যেন সত্য হয়! আজ যদি অদৃশ্য না হই, তাহলে কাল অমিয়ের গাড়ি তৈরি না হলেও আমি পদব্রজেই বেগে পলায়ন করব।
দত্ত। ভেতরে চলুন।
বাংলোর একখানি ঘর। লতিকা জানলার ধারে চেয়ারে বসে আছে।
অমিয়ের প্রবেশ।
অমিয়। খোলা জানলার ধারে বসে কী করছ?
লতিকা। পাহাড়ের মাথায় চাঁদের সোনার মুকুট। আলো-ঝলমল বনে গাছের পাতায় জ্যোৎস্নার জয়গান, আর হিরে-মানিক ছড়াতে ছড়াতে ঝরনা গাইছে পরিললাকের গান। এইসব দেখছি আর শুনছি।
অমিয়। দেখছ, এখানকার জানলায় গরাদে নেই?
লতিকা। গরাদে-দেওয়া জানলা আমার ভালো লাগে না। মনে হয় যেন, জেলখানায় বসে আছি।
অমিয়। লতিকা, কবিত্ব সবসময়ে নিরাপদ নয়। মনে রেখো আমরা গহন বনের মধ্যে আছি, এ হচ্ছে হিংস্র পশুদের রাজ্য। জানলাগুলো বন্ধ করে দেওয়াই উচিত।
লতিকা। দ্যাখো, তুমি যখন সাবধান করে দিলে, তখন একটা কথা বলব? অমিয়। কী কথা? লতিকা। আমার কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। অমিয়। অস্বস্তি?
লতিকা। হ্যাঁ, অস্বস্তি আর ভয়। তুমি হেসো না, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, সামনের পাহাড়ের ওই ঝোপটার ভেতর থেকে ভয়ংকর দুটো চোখ মেলে কে যেন আমার পানে তাকিয়ে আর তাকিয়েই আছে…ওকী, ওকী, তোমার মুখ অমন সাদা হয়ে গেল কেন? ভয় নেই, এটা শুধু আমার মনেরই ভ্রম!
অমিয়। (ভিতু ব্যস্ত কণ্ঠে) কোন ঝোপের ভেতর থেকে লতিকা, কোন ঝোপের ভেতর থেকে?
লতিকা। কী আশ্চর্য, তুমি এতটা ব্যস্ত হচ্ছ কেন? বলছি তো, আমার মনের ভ্রম! দ্যাখো না, ওখানে কেউ নেই!
অমিয়। (সামলে নিয়ে) ওখানে কোনও বন্য জন্তু থাকাও অসম্ভব নয়! জানলাগুলো আমি বন্ধ করে দি। (একটা জানলা বন্ধ করে) দ্যাখো লতিকা, ওই ঝোপটা সত্যি-সত্যিই কেমন নড়ে উঠল!
লতিকা। জোরে বাতাস বইছে, ঝোপ তো নড়তেই পারে।
অমিয়। বাতাসে ঝোপ একদিকেই নুয়ে পড়ে। কিন্তু যেদিক থেকে বাতাস আসছে, ওঝোপটা সেদিকেও নুয়ে নুয়ে পড়ল। এসব ভালো লক্ষণ নয়। আমি আগে জানলাগুলো বন্ধ করে দি। (জানলাগুলো একে একে বন্ধ করতে লাগল)
লতিকা। এমন চাঁদের আলো তুমি কি নষ্ট করে দিতে চাও?
অমিয়। (জানলা সশব্দে বন্ধ করতে করতে) হ্যাঁ, চাই। প্রাণ থাকলে অমন ঢের চাঁদের আলো দেখবার সময় পাব!
লতিকা। তোমার আজ কী হল বলো দেখি? ভয়ে তোমার সারা দেহ কেঁপে কেঁপে উঠছে! তোমার এরকম ভয়ের কারণ কী?
অমিয়। আমি ভয় পাইনি লতিকা, আমি খালি সাবধান হতে চাই।
লতিকা। ডিনার খেতে বসে দেখলুম, তোমরা সবাই যেন কেমন একরকম হয়ে গেছ। কারুর মুখেই হাসি নেই, কেউ ভালো করে কথা কয় না, আমাদের পেটুক কবিমশাইও আজ খিদে নেই বলে ছুরি-কাটা ফেলে উঠে পড়লেন, তোমাদের ওই পুলিশসাহেবও থেকে থেকে উঠে গিয়ে তোকজনদের চুপিচুপি কীসব হুকুম দিয়ে আসেন, চারদিকে বন্দুক-ঘাড়ে সেপাইদের পাহারা, এ সমস্তই আমি লক্ষ করেছি! আসল ব্যাপারটা কী বলো তো?
অমিয়। যা লক্ষ করেছ, সবই তোমার মনের ভুল! রাত হল, এখন শুয়ে পড়ো।
লতিকা। ও কী, তুমি যে বন্দুকটা পাশে নিয়েই শুয়ে পড়লে! বন্দুকের আজ এত আদর কেন?
অমিয়। এটা হচ্ছে ভীষণ জঙ্গল। আত্মরক্ষার উপায় করে রাখলুম।
লতিকা। ঘরের জানলা-দরজা সব বন্ধ, কার কাছ থেকে তুমি আত্মরক্ষা করতে চাও?
অমিয়। তোমার অর্থহীন প্রশ্নের পর প্রশ্নের জ্বালায় যে অস্থির হয়ে উঠলুম লতিকা! নাও, শুয়ে পড়ো!
লতিকা। হুকুম তামিল করলুম, প্রভু! কিন্তু সরলবাবু কোথায় শুলেন?
অমিয়। মি. দত্তের সঙ্গে। তুমি না থাকলে আমিও সেইখানেই আস্তানা পাততুম।
লতিকা। তাই নাকি? মি. দত্তের সঙ্গ কি এতই লোভনীয়?
অমিয়। জঙ্গল হচ্ছে বিপজ্জনক জায়গা। এখানে নারীর আবির্ভাব হচ্ছে আবার বিপদের ওপরে বিপদের মতো! দয়া করে আর প্রশ্ন না করে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো।
(কিছুক্ষণের স্তব্ধতা)
লতিকা। ওগো?
অমিয়। কী?
লতিকা। শুনছ?
অমিয়। কী শুনব?
লতিকা। কেমন একরকম শব্দ?
অমিয়। (খানিকক্ষণ কান পেতে শুনে) বাইরে জেগে রয়েছে খালি বনের কান্না, আর মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ার উচ্ছাস। আর-কোনও শব্দ শুনতে পাচ্ছি না তো!