মনোহর এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন একখানা খাটের পাশে। সেখানে শয্যার উপরে যে শায়িত মূর্তিটি ছিল তাকে দেখেই সকলের চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে উঠল পরম বিস্ময়ে।
একটি তরুণ, অব সুন্দর মূর্তি বালক বললেও চলে। সুগঠিত শুভ্র নগ্ন দেহ—যেন গ্রীক-ভাস্করের হাতে গড়া! কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, সর্বাঙ্গ তার কাচ দিয়ে মোড়া এবং সেই কাচ তা কেউ গলিয়ে এমন ভাবে মূর্তির উপরে ঠেলে দিয়েছে যে সারা দেহের সঙ্গে তা অচ্ছেদ্য ভাবে সংযুক্ত হয়ে আছে।
মনোহর বললেন, সুন্দরবাবু এই আপনার কাচের কফিন।
—হুম, কিন্তু কাচের কফিনের ভিতর ওটা কী রয়েছে? রঙিন মোমের পুতুল? না মৃতদেহ?
—আরও কাছে গিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন।
–না, ওটা মোমের পুতুল নয়, মৃতদেহও নয়। ও যে জীবন্ত ওর সর্বাঙ্গে যে জীবনের রং জীবনের আভাস এমনকি দুই মুদিত চোখের পাতাও থেকে থেকে কেঁপে উঠছে।
মনোহর বললেন ও এখনও ঘুমোচ্ছ, কিন্তু ওর ঘুম ভাঙতে আর বেশি দেরি নেই।
জয়ন্ত শুধোলে, আসল ব্যাপারটা কী মনোহরবাবু?
—আমি নিজেই জানি না। ওই কাচের আবরণী আমার সৃষ্ট নয়। পর্যাক্রমে calcium পথ্য দিয়ে, আবার তা বন্ধ করে বেশ কিছুকাল চিকিৎসা চালাবার পর রোগী হঠাৎ দীর্ঘকালব্যাপী নিদ্রাঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, আর তার সর্বাঙ্গব্যাপী দেখা দেয় ওই কাচের আবরণ। কিছুকাল পরে রোগীর ঘুম ভাঙে, কাচের আবরণ ফেটে যায়, তারপর উঠে বসে তার জাগ্রত মূর্তি! এর অর্থ আমিও জানি না।
সুন্দরবাবু হতভম্বের মতো বললেন, বাবা এ যে মানুষ গুটিপোকা!
মানিক শুধোলে, ও মূর্তিটি কার?
–গোবিন্দবাবুর।
–তাঁর বয়স তো সত্তর বৎসর?
সকলে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল।
সুশীলার প্রবেশ। সেই সুমধুর কণ্ঠে সে বললে, বাবা ও ঘরে খাবার দেওয়া হয়েছে।
মনোহর এতক্ষণ পরে একটু হেসে বললেন, চলুন! এই বিজন বনে আপনারা খাবারের মধ্যে কোনও বিশেষত্ব পাবেন না।
সুশীলা বললে, বাড়িতে যা ছিল তাই দিতে পেরেছি। স্যান্ডউইচ শিককাবাব, রুটি মাখন, চা আর মিষ্টান্ন।
মানিক বললে, ললিতা দেবী, চায়ের বৈঠক যে ভূরিভোজনের আসরে পরিণত হল। এই বিজন বনে শিককাবাব বানালেন কী দিয়ে? বাঘের মাংস দিয়ে নয় বোধ হয়।
–খেলেই বুঝতে পারবেন।
—আসুন সুন্দরবাবু।
–ভায়া আজ যা দেখলুম, আর শুনলুম, আমার পিলে অত্যন্ত চমকে গিয়েছে। খাওয়ার চিন্তা মোটেই জাগছে না!
—আপনার পিলে নির্বোধ নয়। একখানা স্যান্ডউইচ উদরসাৎ করলেই সে আবার অত্যন্ত শান্ত হয়ে পড়বে! আপনার ধাত জানতে আমার বাকি নেই? চলুন, মধুরেণ সমাপয়েৎ করে আসি।
কালো বিদ্যুৎ
[ রহস্য নাট্য ]
পার্বত্য দেশ। অরণ্য। গাছেদের অশ্রান্ত মর্মর ধ্বনি, নিঝরের ঝরঝর জলতান এবং মাঝে মাঝে দু-তিন রকম পাখির সাড়া ভেসে আসছে।
একখানি ডাকবাংলো দেখা যাচ্ছে।
অমিয় সেন, তাঁর স্ত্রী লতিকা সেন ও তাদের বন্ধু কবি সরল রায় ধীরে ধীরে ডাকবাংলোর দিকে অগ্রসর হচ্ছেন।
সূর্য অস্তগত, একটু পরেই সন্ধ্যা হবে।
সরল। অমিয়, এতক্ষণ পরে বোধহয় দুর্ভাগ্যের ধাক্কা সামলাবার একটা উপায় হল। এই দ্যাখো, আমরা ডাকবাংলোর কাছে এসে পড়েছি!
লতিকা। (উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে) আহা, জায়গাটি কী চমত্তার!
অমিয়। হ্যাঁ লতিকা, যিনি এখানে বাংলোর জন্যে স্থান নির্বাচন করেছেন, তিনি আর আমাদের সরল নিশ্চয়ই একজাতের মনুষ্য।
সরল। অর্থাৎ?
অমিয়। অর্থাৎ তিনিও তোমার মতোই কবি।
লতিকা। ওদিকে পাহাড়ের-পর-পাহাড়ের স্থির তরঙ্গমালা, তাদের কোলে কোলে দুলছে। ঘন বনের স্নিগ্ধ শ্যামলতা, আর ওই সবুজের ওপরে ঝকমকে জরির পাড়ের মতন দেখাচ্ছে। ছোট্ট ঝরনাটিকে! আমার আর এখন এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না!
অমিয়। ওটা বলা বাহুল্য। কারণ, ইচ্ছা করলেও আজ তুমি এখান থেকে যেতে পারবে। বনের পথে আমাদের ভগ্নচক্র মোটর হয়েছে নিশ্চেষ্ট, কাজেই আজ রাত্রে ওই বাংলোর জঠরে প্রবেশ করা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায়ই নেই।
লতিকা। তা জানি গো, জানি। কিন্তু মোটরখানা ভেঙেছে বলে এখন আর আমার কোনও দুঃখই হচ্ছে না।
অমিয়। তার মানে?
লতিকা। তোমার মোটর অচল না হলে তো আজ এমন অপূর্ব শোভার হাটে রাত্রিবাস করতে পারতুম না!
অমিয়। লতিকা, তোমার কাব্য-ব্যাধি দেখছি সরলেরও চেয়ে মারাত্মক!
সরল। অমিয়, তুমি অকারণেই বারবার আমাকে নিয়ে টানাটানি করছ। কারণ আমি লতিকা দেবীর মত সমর্থন করি না। আমার কাব্য-রাজ্য হচ্ছে সম্পূর্ণ নিরাপদ। পেট ভরে খেয়ে আরামে সোফায় বসে বা বিছানায় শুয়ে কবিতায় প্রকৃতি বর্ণনা পাঠ করা যায় নিশ্চিন্ত প্রাণে। কিন্তু এই ভয়াবহ বিজন জঙ্গলে শূন্যউদরে রাত কাটাতে হবে শুনে আমার মনে একটুও আনন্দ হচ্ছে না।
লতিকা। আপনার কথাগুলো অকবির মতন হল সরলবাবু! একটু পরেই চাঁদ উঠবে, তখন তার রুপোলি রূপের স্বপ্নে এক রাতের উপবাসকে তুচ্ছ বলে মনে হবে।
সরল। উপবাসকে তুচ্ছ ভাবব, এত বড়ো নির্বোধ কবি আমি নই।
লতিকা। কবিমশাই, এত সহজে হাল ছাড়ছেন কেন? এটা যখন ডাকবাংলো, তখন কোনও আয়োজনই কি এখানে হতে পারে না?
সরল। নির্জন বনের এরকম সব ডাকবাংলোর ব্যবস্থা আমি জানি। আগে থাকতে খবর না দিলে এখানে যা ভক্ষণ করতে হয় তার নাম হচ্ছে বিশুদ্ধ বায়ু।
অমিয়। দ্যাখো সরল, বাংলোর বারান্দা থেকে একটি লোক আমাদের লক্ষ করছে।
সরল। হু, লোকটিকে সরকারি কর্মচারী বলেই মনে হচ্ছে। অমিয়। আরে, আরে, ওঁকে যে আমি চিনি। মি. দত্ত, সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশ।