এতক্ষণ পরে মনোহর হঠাৎ সিধে হয়ে উঠে বসে বললেন, কাচের কফিনের কথা ছেড়ে দিন। খানি আগে জীবন্ত অবস্থায় কাকে দেখতে চান? সুশীলা দেবীকে, না গোবিন্দবাবুকে?
সুন্দরবাবু প্রথমটা থতমত খেয়ে গেলেন। তারপর বাধো বাধো গলায় বললেন, কোথায় সুশীলা দেবী? আগে তাঁকেই দেখতে চাই।
উত্তম। বলেই মনোহর গলা চড়িয়ে ডাকলেন সুশীলা! সুশীলা।
বাড়ির ভিতর থেকে গানের মতন একটি আওয়াজ শোনা গেল।
–আজ্ঞে? কী বলছেন?
–তুমি একবার এই ঘরে এে তো মা।
ঘরের ভিতরকার একটি দরজ, পর্দা ঠেলে আত্মপ্রকাশ করল যে আশ্চর্য রূপবতী ও মহিমাময়ী মূর্তি, তাকে দেখবার জন্যে কেহই প্রস্তুত ছিল না। এ মূর্তি যে মাটির পৃথিবীর, স্বচক্ষে দেখেও কেউ তা বিশ্বাস করতে পারল না।
বিপুল বিস্ময়ে জয়ন্ত বলে উঠল, ইনিই কি সুশীলা দেবী?
মনোহর বললেন, হ্যাঁ? কিন্তু এখন থেকে ইনি নতুন নামে আত্মপরিচয় দেবেন।
–নতুন নাম?
–হ্যাঁ, ললিতা দেবী।
।। ছয় ।। মাতৃভাষার দৌড়
সুন্দরবাবু দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, হুম। ইনি ললিতা দেবী বা পলিতা দেবী হতে পারেন, কিন্তু ইনি সুশীলা দেবী নন!
–কেন বলুন দেখি?
–সুশীলা দেবীর বয়স পঁচাত্তর বৎসর।
—ঠিক। এখন তাঁর বয়স পঁচাত্তর হলেও তিনি আর বৃদ্ধা নন।
—পাগলের মতন কী আবোল-তাবোল বকছেন।
—সুশীলা দেবী নবযৌবন লাভ করেছেন।
—শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার চেষ্টা করবেন না মনোহরবাবু।
–কেন প্রাচীনরা কি আবার নবীনা হতে পারে না?
—অসম্ভব! জরার পর মৃত্যু, জরার পর যৌবন নেই।
—বিজ্ঞানের মহিমায় সবই সম্ভবপর হয়। আমি ভবিষ্যৎবাণী করছি বিজ্ঞান একদিন মানুষকে অমর করবে।
—আপনার ওই নির্বোধের স্বর্গে আমাদের টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবেন না। হয় কাজের কথা বলুন, নয়—
–নয়?
–নয় থানায় চলুন।
—বেশ, তবে কাজের কথাই শুনুন। মনোহর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে ডাকলেন মা সুশীলা।
—বাবা!
সেকি মানুষের কণ্ঠস্বর, না বীণার ঝঙ্কার।
—তুমি এখন বাড়ির ভিতরে যাও। এই ভদ্রলোকদের জন্য একটু চা-টা পাঠিয়ে দাও। সুন্দরবাবু ব্যস্তভাবে সভয়ে বলে উঠলেন, না, না এখানে আমরা চা-টা খেতে আসিনি!
—ভয় নেই, আপনাদের চায়ে কেউ বিষ মিশিয়ে দেবে না।
—বিষ থাক আর না থাক এখানে চা আর টা কিছুই খাওয়া চলতে পারে না।
—আপনাদের সকলেরই কি এক মত? জয়ন্ত বললে, আমার অন্য মত। আমি চা-টা সব খাব। কী বলো মানিক?
–আমিও তোমার দলে।
–করুণাবাবু কী বলেন। পরমাসুন্দরী সুশীলা—ওঁকে কি ললিতা দেবী বলে ডাকব মনোহরবাবু?
—ওঁকেই জিজ্ঞাসা করুন।
আবার বাজল সেই অমৃয়মান কণ্ঠস্বরের মোহনীয় বীণাবেণু! বাবার কাছে আমি সুশীলা! কিন্তু আপনারা তো বৃদ্ধা সুশীলাকে দেখেননি আপনারা আমাকে ললিতা বলেই ডাকুন।
জয়ন্ত বললে, বেশ! করুণাবাবু, এই পরমাসুন্দরী ললিতা দেবী যদি তার সুন্দর হাত দিয়ে সুন্দর চা তৈরি করে দেন, তাহলে সুন্দরবাবুর মতো আপনি তা পান করবেন না?
–করব না, বলেন কী? আমি তো নির্বোধ নই।
—সুন্দরবাবু, আপনি কি এখনও মত বদলাবেন না? মনে রাখবেন চায়ের সঙ্গে আবার টা।
সুন্দরবাবু জুলজুল করে জয়ন্তের মুখের পানে তাকিয়ে বললেন—কী আর করি বলো! তোমরা সবাই যখন রাজি তখন আমারও আর একযাত্রায় পৃথক ফল হয় কেন? আমিও রাজি।
ললিতা দেবীর গোলাপ-পেলব ওষ্ঠাধরে ফুটল যে মিষ্টি হাসিটুকু তাও যেন নীরব সংগীতের মতো সুন্দর। একটি নমস্কার করে পাশের ঘরে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন জীবন্ত স্বপ্নপ্রতিমার মতো।
মনোহর গম্ভীর স্বরে বললেন, শুনুন মশাই। জরার কারণ কী মানুষ যে জানে না, এ কথা সত্য নয়। বরং এই কথাই সত্য যে জরার কারণ তার কাছে অজ্ঞাত নয়, এইটুকুই। জানে না সে।
সুন্দরবাবু মুখভঙ্গি করে বললেন, বাবা এ যে হেঁয়ালি।
—এ সব সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক ব্যাপার আপনাদের যে কেমন করে বোঝাব বুঝতে পারছি। Radioactive বস্তু কাকে বলে জানেন?
জয়ন্ত বললে, জানি। আমাকেও মাঝে মাঝে অল্পস্বল্প বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করতে হয়, যদিও তা ধর্তব্যের মধ্যেই গণ্য নয়।
–সুন্দরবাবু বললেন, বিজ্ঞানে আমি একেবারে মা! বাংলায় বুঝিয়ে দিতে পারেন?
—ইংরেজি তো পদে আছে, বাংলায় শুনলে একেবারে অজ্ঞান হয়ে যাবেন।
—তাও কখনও হয়? বাংলা আমাদের মাতৃভাষা।
—আমাদের মাতৃভাষার অভিধানে Radioactive-এর অর্থ এই ভাবে বোঝানো হয়েছে; আংশুবিকিরণ দ্বারা বিদ্যুত্সাপক প্রভৃতির উপর ক্রিয়াকরণক্ষম; (রেডিয়াম, ইউরেনিয়াম, পলনিয়াম প্রভৃতি সম্পর্কে অপারদর্শকপদার্থ ভেদকারক ও বৈদ্যুতিক ক্রিয়াজনক এবং অদৃশ্য কিরণবিকরণক্ষম।) কী বুঝলেন বলুন।
সুন্দরবাবু বললেন, ব্যাপার বুঝব কী, আরও গুলিয়ে গেল। মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরছে! এইজন্যেই কি কবি গান বেঁধেছেন—আ মরি বাংলা ভাষা?
–বাংলা ভাষার দোষ নেই সুন্দরবাবু, তবে বাংলা ভাষায় এখনও ভালো করে বিজ্ঞানকে পরিপাক করবার চেষ্টা হয়নি কারণ দেশ এতদিন স্বাধীন ছিল না, যাক ও-কথা। যতটা সংক্ষেপে পারি কিছু কিছু বোঝাবার চেষ্টা করি। অনেক পরীক্ষার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছি যে, সারাজীবন ধরে আমাদের দেহের ভিতরে যে Radioactive বস্তু জমে ওঠে, অর্থাৎ যাকে বলে ক্ৰমিক radium জরার কারণ হচ্ছে তাই। সূর্যের দ্বারা পৃথিবীর উপরে প্রতিদিনই radium নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। আমরা তা খাচ্ছি, আমরা তা পান করছি, নিশ্বাস দিয়ে বাতাস থেকে তা আকর্ষণ করছি। তারই ফলে প্রত্যেক জীব আর তরুলতাও ধীরে ধীরে জরাগ্রস্ত হয়। জরাব্যাধি নিবারণ করবার উপায় আমি আবিষ্কার করেছি।