তখন পরেশ ও ছন্দাও সেই দৃশ্যমান অদৃশ্যের ভীষণ অস্তিত্ব দেখতে পেয়েছে, বা অনুভব করেছে!
ছন্দা আঁতকে বলে উঠল, ও কে বড়দা, ও কে? ও যে এগিয়ে যাচ্ছে, কুকারের দিকে!
পরেশ সর্বপ্রথম সেই অবর্ণনীয় অলৌকিক মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বললে, আমরা সবাই কি হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়েছি? বানিয়ে বানিয়ে ভয়ের স্বপ্ন দেখছি? কই, ওখানে তো কেউ নেই! এসো আমার সঙ্গে!
পরেশ দ্রুতপদে সেইদিকে অগ্রসর হচ্ছে, আচম্বিতে দুটো ইকমিক কুকারই সশব্দে বালির ওপরে কাত হয়ে পড়ে গেল এবং চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তার ভেতরের খাবারভরা পাত্রগুলো! এবং পরমুহূর্তেই আমাদের সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন করে, বয়ে গেল একটা ঠান্ডা কনকনে দমকা বাতাসের ঝটকা! ঝটকাটা যেমন হঠাৎ এল, চলে গেল তেমনি হঠাৎ। পরেশ একবার হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে পড়েই আবার এগুবার উপক্রম করলে! নৌকোর মাঝি কিছু দেখেছিল কি না জানি না, কিন্তু সে-ও সভয়ে চেঁচিয়ে উঠল, বাবু, বু! নৌকোয় চলে আসুন।
আমি বিহুলা ছন্দার হাত ধরে টেনে পানসির দিকে ছুটতে ছুটতে বললুম, নবীন! পরেশ শিগগির নৌকোয় চলো!
০৫.
নৌকোয় চড়ে ঘণ্টাখানেক গঙ্গার বুকে ভেসে চললুম। বালুচর তখন চোখের আড়ালে।
সকলেই যে আমরা সেই চরের কথাই ভাবছি তাতে আর সন্দেহ নেই। কিন্তু সকলেই এমনি অভিভূত হয়েছি যে মুখ যেন বোবা হয়ে গিয়েছে।
পানসি যখন হাওড়ার পুলের কাছে এসে পড়েছে পরেশ তখন বললে, আমরা কি কাপুরুষ! রজ্জুতে সর্পভ্রম করে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে এলুম! মাঝি, নৌকো ফেরাও! আমরা আবার সেই চরে যাব!
মাঝি মাথা নেড়ে বললে, তা আর হয় না বাবুজি! যেতে যেতেই জোয়ার এসে পড়বে, চর ড়ুবে যাবে।
ছন্দা বললে, চরে যা দেখেছি, আমার আর সেখানে যেতে ইচ্ছেও নেই।
পরেশ উত্তেজিতভাবে বললে, চরে কী দেখেছি আমরা? কিছুই না—একটা ছায়া পর্যন্ত না! খানিকটা বাষ্প উড়ে গেলেও বুঝতুম; আমরা তাও দেখিনি! বোকা নবীনটা বাজে কী ধুয়ো তুললে, আর আমরাও সবাই হাউমাউ করে পালিয়ে এলুম! ছি ছি, কী লজ্জা!
ইকমিক কুকার দুটো কে ফেলে দিলে?
দমকা ঝোড়ো বাতাস! ঝড়ের মতো একটা বাতাসের ঝটকা তো আমাদেরও গায়ে লেগেছিল।
বালি উড়িয়ে কে ওখানে চলে বেড়াচ্ছিল?
বালি উড়ছিল ওই বাতাসেই!
আর সকালের সেই পায়ের দাগগুলো?
জানোই তো, সেগুলো পায়ের দাগই নয়, বালির ওপরে স্রোতের দাগ!
ভাবলুম মাঝির গল্পটা বলি,ওখানে পরে পরে দু-দুটো মানুষ কোথায় অদৃশ্য হয়েছে, কেউ জানে না। কিন্তু বলতে গিয়ে বললুম না; কারণ নিশ্চয়ই উত্তরে শুনব, তারা জলে ড়ুবে মারা পড়েছে!
নবীন ফোস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললে, হায়রে খিচুড়ি, হায়রে ফাউলকারি, হায়রে সন্দেশ-রসগোল্লা, আমের চাটনি! ওগো প্রিয়, তোমাদের পেয়েও হারালুম!
ছন্দা বললে, চলো, চৌরঙ্গির কোনও হোটেলে গিয়ে খাবারের শোক আর পেটের জ্বালা নিবারণ করে আসি গে!
কাচের কফিন
।।এক।। খুনের না মানুষ চুরির মামলা
—বোলো না, বোলো না, আজ আমাকে চা খেতে বোলো না! ঘরে ঢুকেই বলে উঠলেন সুন্দরবাবু।
মানিক সবিস্ময়ে শুধোলে, এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে।
–না আজ কিছুতেই আমি চা খাব না। একেবারে ধনুর্ভঙ্গ পণ?
—হুম! জয়ন্ত বললে, বেশ, চা না খান, খাবার খাবেন তত?
–কী খাবার?
—টিকিয়া খাবার।
–ও তাই নাকি।
–তারপর আছে ভেন্ডালু।
–হংস মাংস?
—হ্যাঁ, বনবাসী হংস।
সুন্দরবাবু ভাবতে লাগলেন।
–খাবেন তো?
সুন্দরবাবু ত্যাগ করলেন একটি সুদীর্ঘ নিশ্বাস। তারপর মাথা নেড়ে করুণ স্বরে বললেন, উহুঁম! আজ আ ক হংস-মাংস ধ্বংস করতে বোলো না।
মানিক বললে, হালে আর পানি পাচ্ছি না। হংস-মাংসেও অরুচি! সুন্দরবাবু এইবারে বোধ হয় পরমহংস হয়ে বৈরাগ্যব্রত গ্রহণ করবেন।
—মোটেই নয়, মোটই নয়।
—তবে গেরস্তের ছেলে হয়েও এ-খাব না ও-খাব না বলছেন কেন?
—আজ আমার উদর দেশের বড়োই দুরবস্থা।
–অমন হৃষ্টপুষ্ট উদর, তবুও
—আমার উদরাময় হয়েছে।
—তাই বলুন। তবে ওষুধ খান। আমি হোমিওপ্যাথি জানি! এক ডোজ মার্কসল ওযুধ দেব নাকি?
–থো করো তোমার হোমাপাথির কথা। আমি খাবার কি ওষুধ খেতে আসিনি। আমি এসেছি জরুরি কাজে।
—অসুস্থ দেহ, তবু কাজ থেকে ছুটি নেননি? কী টনটনে কর্তব্যজ্ঞান।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই। স্বর্গবাসী টেকি ধান ভাঙে। পুলিশের আবার ছুটি কী হে?
জয়ন্ত শুধোলে, নতুন মামলা বুঝি?
—তা ছাড়া আর কী?
–কীসের মামলা?
—বলা শক্ত। খুনের মামলা কি মানুষ চুরির মামলা, ঠিক ধরতে পারছি না।
একটু একটু করে জাগ্রত হচ্ছিল জয়ন্তের আগ্রহ। সে সামনের চেয়ারের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললে, সুন্দরবাবু ওই চেয়ারে বসুন। ব্যাপারটা খুলে বলুন।
আসন গ্রহণ করে সুন্দরবাবু বললেন, এটাকে আজব মামলা বলাও চলে। রহস্যময় হলেও অনেকটা অর্থহীন। নাটকের পাত্র-পাত্রী হচ্ছেন তিনজন। একজন নারী আর দুজন
পুরুষ। ওঁদের মধ্যে একজন পুরুষ হচ্ছেন আসামি। কিন্তু তিনজনেই অদৃশ্য হয়েছে।
—অদৃশ্য হবার কারণ?
–শোনো! বছর দেড়েক আগে সুরেন্দ্রমোহন চৌধুরি নামে এক ভদ্রলোক থানায় এসে অভিযোগ করেন, তাঁর পিতামহী সুশীলাসুন্দর দেবীর কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাপারটা সংক্ষেপে এই। সুশীলা দেবী বিধবা। তিনি তার স্বামীর বিপুল সম্পত্তির একমাত্র অধিকারিণী। তাঁর বয়স পঁচাত্তর বছর। স্বাস্থ্যভঙ্গ হওয়ার দরুন ডাক্তার মনোহর মিত্রের চিকিৎসাধীন ছিলেন। সুশীলা দেবী হঠাৎ একদিন একখানা ট্যাক্সি ডাকিয়ে এনে মনোহর মিত্রের সঙ্গে বাড়ির বাইরে চলে যান, তারপর ফিরে আসেননি। খোঁজাখুঁজির পর প্রকাশ পায়, অদৃশ্য হবার দুদিন আগে সুশীলা দেবী ব্যাংক থেকে নগদ পনেরো লক্ষ টাকা তুলে আনিয়েছিলেন। সে টাকাও উধাও হয়েছে।