নৌকোর তরে আসতে ছন্দা বললে, বড়দা, মাঝির সঙ্গে অত কীসের কথা হচ্ছিল?
বাজে কথা!
মিথ্যা তার মনে ভয় জাগানো উচিত নয়। আমার কাছে মাঝির গল্প হাস্যকর বলে মনে হচ্ছিল! তবে একটা ভয় আছে। চরে চোরাবালি নেই তো?
০৪.
গঙ্গা তখন চাঁদের আলোর সঙ্গে খালি খেলাই করছিল না, গল্পও করছিল কুলুকুলু স্বরে। সেই গল্প যারা বুঝতে পারে তারাই হয় কবি। আমরা কবি নই, আমাদের মন চড়িভাতির কথা ভেবেই সরস হয়ে উঠছে।
তা ছন্দা উদর-তৃপ্তির আয়োজন বড়ো কম করেনি। মাংস হবে, খিচুড়ি হবে, আরও কী কী হবে! ভীম নাগের সন্দেশ, নবীন ময়রার রসগোল্লা, আমের চাটনিও এসেছে এক বোতল। একে চড়িভাতি না বলে রীতিমতো ভোজের আয়োজন বলাই উচিত।
ছন্দা দুটো পেট্রলের লণ্ঠন জ্বাললে, যদিও আজকের পূর্ণিমায় তাদের দরকার ছিল না। তারপর দুটো ইকমিক কুকারে রান্না চড়িয়ে দিয়ে বললে, চলো, এইবারে দ্বীপে খানিকটা ভ্রমণ করে আমরা খিদে বাড়িয়ে আসি!
নবীন গম্ভীর হয়ে বললে, খিদে দ্বিগুণ বাড়লে অতিরিক্ত খাবারের জোগান দেবে কেমন। করে? মনে রেখো ছন্দা এখানে কলকাতার খাবারের দোকান নেই, আমরা বাস করছি এক অচেনা বিজন দ্বীপে!
পরেশ বললে, রবিনসন ক্রুসোর দ্বীপের চেয়েও এ দ্বীপ ভয়ানক। এখানে ফ্রাইডের মতো বিশ্বস্ত ভৃত্যও মিলবে না যে খাবার কিনতে পাঠাব!
ছন্দা হাত নেড়ে বললে, ওগো ক্ষুধার্ত ভদ্রলোকরা, থামো! তোমাদের ভুঁড়ির বহর জানা আছে।…চলো বড়দা!
আমরা চর ধরে হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছি, দেখে নৌকো থেকে মাঝি সাবধান করে দিলে, বেশিদূর যাবেন না বাবু, এটা বেড়াবার জায়গা নয়!
মাঝির কথার মানে বুঝে আমার হাসির পেলে। এখানে কীসের ভয়? আকাশ ভরে জাগছে চাঁদের মৌন সংগীত, কানে আর প্রাণে জাগছে ঠান্ডা বাতাসের গুঞ্জন এবং বালুচরের কূলে কূলে জাগছে গঙ্গার রচিত কবিতার ছন্দ! এপারে-ওপারে আলোর মালায় মালায় দেখছি যেন দীপাবলির উৎসব!
ছন্দা খিলখিল করে হেসে উঠে বললে, মাঝিবুড়োর কথা শোনো! এটা বেড়াবার জায়গা নয় তো ঘুমোবার জায়গা নাকি?
পরেশ বললে, আমার কীরকম ঘুম আসছে ছন্দা! ওই কুলুকুলু শব্দ, এই ঝিরঝিরে বাতাস আর এমন ঝিলমিলে জ্যোৎস্না! সবই কেমন স্বপ্নময়!
আমি বললুম, সবই যখন স্বপ্নময় আর সংগীতময়, তখন ছন্দার গলাও আর চুপ করে থাকে কেন? ছন্দা, চলতে চলতে তুমিও রবি ঠাকুরের একটি গান ধরে ফ্যালো।
ডান হাত দিয়ে নিজের বাঁ হাতের ওপরে সজোরে ও সশব্দে এক তালি বসিয়ে দিয়ে নবীন বলে উঠল, ঠিক বলেছ, লাখ টাকার এক কথা! এ সময়েও যদি রবি ঠাকুরের গান
হয় তাহলে বৃথাই তিনি সংগীত রচনা করেছেন। গাও ছন্দা!
ছন্দা আপত্তি করলে না। রবীন্দ্রনাথের গান হচ্ছে প্রকৃতির নিজস্ব জিনিসের মতো, তার সঙ্গে আজকের এই জ্যোৎস্নামাখা গঙ্গার কলতান এমনি খাপ খেয়ে গেল।
আমি বললুম, চমৎকার ছন্দা, চমৎকার। এখানে মানুষের বীণা-বেণুর সঙ্গত নেই, তুমি যেন তাই গঙ্গার সুরে সুর মিলিয়েই গান ধরেছ!
ছন্দা খানিকক্ষণ নীরবে কান পেতে গঙ্গার ঢেউয়ের গান শুনলে। তারপর বললে, গঙ্গার সুর? যদি তোমরা কেউ এখানে না থাকতে, যদি এই নির্জন চরে একলা বসে বসে
আমাকে গঙ্গার এই কল্লোল শুনতে হত, তাহলে নিশ্চয়ই আমি ভয় পেতুম!
ভয় পেতে। সে কী!
চেয়ে দ্যাখো না, পূর্ণিমার চাঁদও পৃথিবীকে স্পষ্ট করতে পারেনি, আলোর সঙ্গে যেন আবছায়া মাখানো। কলকাতার বাড়িঘর এত কাছে, কিন্তু এই নির্জন নিরালা বালুচরের সঙ্গে আজ মানুষের কোনও সম্পর্কই আছে বলে সন্দেহ হচ্ছে না! আজ আমরা যেন এখানে অনধিকার প্রবেশ করেছি। মনে হচ্ছে এই চরের যেন আত্মা আছে, আর মানুযের ছোঁয়া পেয়ে সে অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছে! গঙ্গার ডাক শুনছ? ও ডাক ছুটে আসছে যেন অতল পাতালের গভীর অন্ধকার থেকে—যেখানে হাসি নেই, আলো নেই, মানুষ নেই; যেখানে পাতা আছে শুধু শীতল মৃত্যুর কঙ্কাল-শয্যা, যেখানে দয়া-মায়া-প্রেমের নাম কেউ শোনেনি! গঙ্গার ও-ডাক কি সংগীত? ও যেন প্রাণদণ্ডের বাণী, ও যেন জীবনের বিরুদ্ধে মানুষের বিরুদ্ধে আমাদের বিরুদ্ধে অভিশাপময় নিষ্ঠুর প্রতিবাদ! মানুষের পক্ষে নিঝুম রাত্রে এখানে একলা থাকা অসম্ভব!
পরেশ বিরক্ত হয়ে বললে, ছন্দা, তুই বড়ো বিনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলতে শিখেছিস! তুই, যেন আমাদের ভয় দেখাবার চেষ্টা করছিস!
নবীন কিন্তু কোনও কথাই শুনছিল না, নিষ্পলক নেত্রে একদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সে চমকে উঠল!
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলুম, খানিক তফাতেই দুটো উজ্জ্বল লণ্ঠন জ্বলছে আর কুকারে আমাদের খাবার সিদ্ধ হচ্ছে।
নবীন, কী দেখে তুমি চমকে উঠলে? ওখানে তো দেখে চমকাবার মতো কিছুই নেই। নবীন অত্যন্ত অস্বাভাবিক স্বরে বললে, ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখো!
তীক্ষ্ণ চোখে আবার সেইদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার বুক ছম ছম করতে লাগল। ওখানে কিছুই নেই, কিন্তু তবু কিছু যেন আছেও! কী ওটা? ওকে কি শূন্যতার মধ্যে শূন্যতার মূর্তি বলব? না, চাঁদের আলোর মধ্যে ঘনীভূত আলোর মূর্তি? ওকে দেখাও যায়, দেখা যায় না। যেন নিরাকারের প্রকাণ্ড আকার, কিন্তু ভয়াবহ! পূর্ণিমায় ধবধব করছে বালুচর, কিন্তু পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নার মধ্যে যেন আর একটা উজ্জ্বলতর আলোকের ছায়া ফেলে কে সেখানে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। আলোকের মধ্যে আলোকের ছায়া! আমার এই অদ্ভুত ভাষা শুনে লোকে হয়তো হাসবে, কিন্তু যা দেখলুম তা অমানুষিক বলেই মানুষী ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব! ওই অনামা ভয়ংকরের হাত-পা-দেহ বা মুখ কিছুই দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বালির ওপরে কেউ ভারী ভারী পা ফেলে চললে যেমন বালি ছিটকে ছিটকে পড়ে, ওখানেও ঠিক তেমনি হচ্ছে!