এমন সময়ে খানিক তফাত থেকে ছন্দা চেঁচিয়ে ডাক দিল, বড়দা, একবার এদিকে এসে দ্যাখো তো এগুলো কীসের দাগ!
তার কাছে গিয়ে দেখি, বালির ওপরে হেট হয়ে পড়ে অত্যন্ত কৌতূহলে কীসের দিকে সে তাকিয়ে রয়েছে।
বালির ওপরে অনেকগুলো অদ্ভুত চিহ্ন!
পরেশ দেখে বললে, পায়ের দাগ। না। আমি বললুম, কিন্তু কোন জীবের পায়ের দাগ? আমরা কেউ পদচিহ্নবিশারদ না হয়েও বলতে পারি, এ দাগগুলো কোনও চতুষ্পদ জীবের পায়ের দাগ নয়! এগুলো যার পায়ের দাগ, সে দুই পায়ে হাঁটে। মানুষ দুই পায়ে হাঁটে, কিন্তু এগুলো মানুষের পায়ের দাগ নয়। পাখি দুই পায়ে হাঁটতে পারে বটে, কিন্তু কোনও পাখির পায়ের দাগই এত বড়ো বা এরকম দেখতে হয় না। এমন বড়ো যার পা, তার দেহও না জানি কত প্রকাণ্ড। দেখছ পরেশ, এর পায়ে মস্ত মস্ত নখও আছে? কী ভয়ানক! যে এমন পায়ের অধিকারী তার চেহারা দেখলে পেটের পিলে হয়তো চমকে যাবে!
নবীন চোখ পাকিয়ে বললে, দুই সার পায়ের দাগ দেখা যাচ্ছে। গঙ্গা থেকে কোনও জীব উঠে চরের ওপরে এসে আবার জলে ফিরে গিয়েছে?
আমি বললুম, কিন্তু কোনও জলচর জীবই দুই পায়ে ভর দিয়ে বেড়িয়ে বেড়াতে পারে! কুমির ডাঙায় ওঠে, তার পায়েরও অভাব নেই—কিন্তু চারখানা পা।
পরেশ এক কথায় সমস্ত উড়িয়ে দিয়ে বললে, তাহলে এগুলো পায়ের দাগের মতন দেখতে বটে, কিন্তু পায়ের দাগই নয়!
নবীনও সায় দিয়ে বললে, সেই ঠিক কথা! গঙ্গার স্রোতের তোড়ে বালির ওপরে এই অদ্ভুত দাগগুলো হয়েছে!
আমিও তা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারলুম না। এগুলো কোনও জীবের পায়ের দাগ হলে তাকে সৃষ্টিছাড়া আজগুবি জীব বলেই মানতে হয় এবং তেমন উদ্ভট জীব কলকাতার গঙ্গার চরে আসবে কেমন করে? এলেও খবরের কাগজের সর্বদর্শী রিপোর্টারদের চোখকে সে ফাঁকি দিতে পারত না, অন্তত বাগবাজারের অমৃতবাজার পত্রিকা সর্বাগ্রেই তাকে আবিষ্কার করে ফেলত!
যার আবদারে আমরা এই চিহ্নগুলি পরিদর্শন করতে এদিকে এসেছি, সেই ছন্দা কিন্তু এতক্ষণ আমাদের কাছে ছিল না, সে কখন সরে পড়ে দূরে গিয়ে চরের ওপরে বসে শিশুর মতো বালির ঘর তৈরি করতে ব্যস্ত ছিল!
কড়া রোদে ঘেমে উঠে ছন্দাকে ডেকে আমরা আবার পানসির দিকে ফিরে চালুম। ছন্দা এসে বললে, আমার ভারী ভালো লাগছে। এক্ষুনি যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আর থাকার উপায় নেই। একটু পরেই জোয়ার আসবে, চর ড়ুবে যাবে। ছন্দ। একটু ভেবে বললে, আচ্ছা, বড়দা, রাতে আবার এই দ্বীপটা জেগে উঠবে তো? হ্যা, ঘণ্টা চারেকের জন্যে। আজ তো পূর্ণিমে? সন্ধেবেলাতেই চাঁদ উঠবে? হা।
তাহলে আজ সন্ধেবেলায় এখানে সকলের নিমন্ত্রণ রইল। আমি চড়িভাতি করে তোমাদের সবাইকে খাওয়াব।
পরেশ একটু ইতস্তত করে বললে, কিন্তু সে যে অনেক তোড়জোড়ের ব্যাপার! দরকার নেই ছন্দা!
প্রস্তাবটায় নতুনত্ব আছে। আমি রাজি হয়ে গেলুম।
তোড়জোড়ের জন্যে তোমাদের কারুকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে না দাদা। আমি সব গেছি ছি করব, তোমরা খালি দয়া করে দুটো খেয়ে উপকার কোরো।
এর পরেও আপত্তি করা অভদ্রতা, এবং পরেশ সেই অভদ্রতাই করলে। বললে, তুমি যা মেয়ে, তা জানি। আবার জোয়ার না আসা পর্যন্ত এখান থেকে নড়তেই চাইবে না! অতক্ষণ এই ভিজে বালির ওপরে বসে থাকলে অসুখ করবে। অতটা কবিত্ব আমার নেই।
ছন্দা রেগে বললে, দাদা, গেল-জন্মে তুমি মাড়োয়ারি ছিলে, তোমার একটুও imagination নেই! বেশ, আমাদের জন্যে চারখানা ফোল্ডিং চেয়ারও আসবে, কারুকেই ভিজে বালিতে বসতে হবে না!.বড়দা, পানসিখানা আজ সন্ধে থেকে ভাড়া করে রেখো। প্রথমে চড়িভাতির ভোজ, তারপর চন্দ্রালোকে নৌকোয় করে গঙ্গায় ভ্রমণ,—ওঃ, ওয়ান্ডারফুল!
০৩.
ছন্দা, পরেশ ও নবীন নৌকোর ঘরের ভেতরে গিয়ে বসল, আমি গেলুম বুড়ো মাঝির কাছে।
ওহে মাঝি, আজ সন্ধের সময়ে তোমার নৌকো নিয়ে আমরা আবার এই চরে আসব। তুমি ঘাটে তৈরি থেকো।
সন্ধের সময়? ওই চরে? কতক্ষণ থাকবেন?
যতক্ষণ জোয়ার না আসে।
মাঝি চুপ করে রইল।
কী হে, কথা কও না যে?
মাঝি খুব মৃদুস্বরে বলল, সন্ধের পরে ওই চরে কেউ থাকে না। জায়গাটার বদনাম আছে।
বদনাম! কীসের বদনাম?
অল্পক্ষণ ইতস্তত করে মাঝি বললে, কীসের বদনাম জানি না বাবু। আমাদের বুদ্ধ ওখানে হারিয়ে গিয়েছিল।
কেমন করে? ওখানে তো হারিয়ে যাওয়ার উপায় নেই?
তা নেই। কিন্তু বুন্ধুকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তাহলে সে জলে ড়ুবে গিয়েছিল।
হতেও পারে, না হতেও পারে। ওই চরে আমরা নৌকো বেঁধেছিলুম। অন্ধকার রাত। আমরা খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়বার চেষ্টা করছি, হঠাৎ কী দরকার হওয়াতে বুদ্ধ চরে গিয়ে নামল। তারপরেই শুনি সে বিকট চিৎকার করে উঠল। আমরা সবাই আলো-টালো নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। কিন্তু আর বুন্ধুর সাড়া কি দেখা পাওয়া গেল না! ওই রাক্ষুসে চর যেন তাকে গিলে ফেললে!
চর নয়, মাঝি! তাকে গিলে ফেলেছিল এই গঙ্গা!
হতেও পারে, না হতেও পারে। তার কিছুকাল পরে আর এক রাতে বদরিও ওই চরে নৌকো বেঁধেছিল। সকালে উঠে দেখে, তাদের দলের একজন লোক নেই। সে যে কোথায় গেল, তা কেউ জানে না…বাবুজি, ও চরের ভারী বদনাম।
যত সব মিথ্যে ভয়। গঙ্গায় তো রোজই লোক ড়ুবছে, চরের দোষ দাও কেন?..তাহলে তোমার নৌকো পাওয়া যাবে না?
পাওয়া যাবে না কেন বাবুজি, পয়সার জন্যেই তো নৌকো চালাই। আপনি পয়সা দিচ্ছেন, আমরাও নৌকো আনব। তবে কিনা, জায়গাটার বদনাম আছে!