সকলে বিপুল বিস্ময়ে দেখলে, যদুবাবুর বামনাবতারের মতো অতিখর্ব দেহখানি দৌড় মেরেছে তীব্র বেগে বাঁশের বেড়ার দিকে। কিন্তু বেড়া টপকাবার আগেই মানিক তাকে ছুটে গিয়ে গ্রেপ্তার করে ফেললে।
তিনকড়ি বিস্মিত স্বরে বললেন, যদু, তুমি কার ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলে?
জয়ন্ত বললে, পুলিশের ভয়ে। এখনই ওঁর বাড়ি খানাতল্লাশ করলে আপনার বিশ হাজার টাকার সন্ধান পাওয়া যাবে।
তিনকড়ি এ কথা যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না, ফ্যালফ্যাল করে যদুবাবুর মুখের পানে তাকিয়ে রইলেন।
জয়ন্ত বললে, যখন চেয়ারের রহস্য আন্দাজ করলুম, পায়ের ছাপগুলো পরীক্ষা করলুম, আর স্বচক্ষে যদুবাবুর বালকের মতো খাটো মূর্তিখানি দর্শন করলুম, তখনই জেগে উঠেছিল আমার সন্দেহ। ওঁর আর তিনকড়িবাবুর সামনাসামনি বাড়ি। তিনকড়িবাবু যে বাড়িতে বিশ হাজার টাকা এনে রেখেছেন, ওঁর পক্ষে একথা জানা খুবই স্বাভাবিক। ওঁর বন্ধু যখন মাঝে মাঝে আলমারির ভিতর থেকে নোটগুলো বার করতেন, তখন সে দৃশ্য তিনি যে নিজের বাড়ি থেকেই দেখতে পেতেন, এইটুকুও অনুমান করা যায় খুবই সহজেই। বৈঠকখানায় ছিল তার নিয়মিত আসা-যাওয়া। আলমারির কলের ছাঁচ তোলবার অবসর পেতে পারেন উনিই। সুতরাং অধিক বলা বাহুল্য। তবে এ কথা ঠিক যে, নিম্নশ্রেণির নির্বোধের মতো আজ যেচে ভিজে মাটি মাড়িয়ে উনি যদি আমার ফাঁদে পা না দিতেন, তাহলে এত তাড়াতাড়ি ওঁকে হরিহরবাবুর কবলে আত্মসমর্পণ করতে হত না।
হ্যাঁ, ভালো কথা। যদুবাবুর ডানপাটির জুতোর তলাটা একবার পরীক্ষা করে দেখলে ভালো হয়।
পরীক্ষার ফল হল সন্তোষজনক। জুতোর তলায় যথাস্থানে ছিড়ে গিয়েছে খানিকটা চামড়া।
জয়ত্ত বললে, মানিক, এখন শেষকৃত্যের ভার পুলিশের হাতে সমর্পণ করে চলো আমরা এখান থেকে প্রস্থান করি। কিন্তু যাবার আগে একটি জিজ্ঞাস্য আছে। হরিহরবাবু, শখের গোয়েন্দারা কি একেবারেই ঘৃণ্য জীব?
হরিহর অনুতপ্ত স্বরে বললেন, আমাকে ক্ষমা করবেন। আজ আমার চোখ ফুটল।
কলকাতার বিজন দ্বীপে
০১.
অনেকেই কলকাতায় অনেককাল থেকেও শহরের অনেক খবরই রাখেন না। ধরুন, এই গঙ্গা নদীর কথা। গঙ্গা যে খালি কলকাতার তেষ্টা মেটায়, তা নয়; বাণিজ্যে কলকাতার লক্ষ্মীলাভের আসল কারণই ওই গঙ্গা! স্নান করতে গিয়ে, বেড়াতে গিয়ে বা পারাপার হতে গিয়ে গঙ্গাকে দেখেনি কলকাতায় এমন লোক নেই। তবু জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে, কলকাতার গঙ্গার বুকেও যে বৎসরের নির্দিষ্ট সময়ে দিব্যি একটি ছোট্ট দ্বীপের মতন বালুচর জেগে ওঠে, এ দৃশ্য অনেকেই দেখেননি।
আমার আজকের বন্ধুরা ছিলেন ওই দলে। গঙ্গার ধারেই আমার বাড়ি। সকালে এসেছিলেন তারা আমার বাড়িতে বেড়াতে। গঙ্গার ধারের বারান্দায় বসে চা পান করতে করতে হঠাৎ ওই বালুচর দেখে তারা যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
বাগবাজারের কাছ থেকে বালুচরটি সমান চলে গিয়েছে বালি ব্রিজের দিকে। চওড়ায় তা বেশি নয় বটে, কিন্তু লম্বায় হবে অন্তত মাইল খানেক। বেশি হতেও পারে।
পরেশের বোন ছন্দা, বেথুনে থার্ড ইয়ারে পড়ে। পয়লা নম্বরের শহুরে মেয়ে, জন্মে কখনও পল্লীগ্রাম বা ধানের খেত দেখেনি। সবচেয়ে বিস্মিত হল সে। বললে, কলকাতা শহরে দ্বীপ! এ কী অদ্ভুত দৃশ্য।
আমি বললুম, কিছুই অদ্ভুত নয়! গঙ্গায় এ সময়ে রোজই দিনে আর রাতে ভাটার সময়ে চড়া পড়ে, আবার জোয়ার এলেই ড়ুবে যায়!
পরেশ বললে, এ খবর তো জানা ছিল না!
নবীন বললে, আমরা বালিগঞ্জবাসী জীব, পাশের বাড়ির খবর রাখি না, বাগবাজারের গঙ্গা তো আমাদের পক্ষে দস্তুরমতো বিদেশি নদী, ম্যাপ দেখে তার অস্তিত্বের খবর পাই।
ছন্দা বিপুল পুলকে নেচে উঠে বলল, ওখানে যাওয়া যায় না বড়দা?—সে আমাকে বড়দা বলে ডাকত।
বললুম, খুব সহজেই। একখানা মাত্র পানসির দরকার!
পরেশ সোৎসাহে বললে, ডাকো, তাহলে একখানা পানসি! আমরা ভারতের প্রধান নগর কলকাতার মাঝখানেই দ্বীপভ্রমণ করব!
নবীন বললে, তারপর ভ্রমণকাহিনি লিখে মাসিকপত্রে প্রকাশ করব! আমি বললুম, সাধু! ঠাট্টা করে বললুম বটে, কিন্তু তখন পর্যন্ত ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারিনি যে, আমাদের এই ভ্রমণটা সত্য-সত্যই একটি চমকপ্রদ অসাধারণ কাহিনি হয়ে দাঁড়াবে।
০২.
গঙ্গার চড়ায় গিয়ে লাগল আমাদের পানসি। চরের এক জায়গায় খানকয় বড়ো বড়ো নৌকা বাঁধা। অনেকগুলো কুলি চর থেকে ঝুড়ি করে বালি তুলে নৌকোয় গিয়ে বোঝাই করে আসছে। গঙ্গার একপারে কলকাতার অগণ্য বাড়ির থাক সাজানো রয়েছে এবং আর একপারে গাছের সার, চিমনিওয়ালা কলকারখানা ও মন্দির প্রভৃতি। উত্তর দিকে বালির রাঙা সাঁকো এবং তারই একমুখে দক্ষিণেশ্বরের কালিমন্দির ও আর একমুখে বেলুড়ের নতুন মঠের গম্বুজ।
চরের যে-দিকটা নির্জন আমরা সেইদিকে গিয়ে নামলুম।
বাতাসে কালো চুল ও বেগুনি শাড়ির আঁচল উড়িয়ে ছন্দা মহা আনন্দে ভিজে বালির ওপরে ছুটোছুটি শুরু করে দিল।
নবীন এদিকে-ওদিকে দৃষ্টিপাত করে বললে, চরটাকে ডাঙা থেকেই ভালো দেখাচ্ছিল। এখানে তে ভ্রমণকাহিনি লেখবার কোনও রঙিন মালমশলাই চোখে পড়ছে না! ওখানে বালি বোঝাই নৌকো, চরের চারপাশে গঙ্গার ঘোলা জল আর জেলেডিঙি, মাথায় ওপরে উড়ছে কতকগুলো গাংচিল—ধেৎ, এই নিয়ে কি ভ্রমণকাহিনি রচনা করা যায়?
পরেশ বললে, রাখো তোমার ভ্রমণকাহিনি! জীবনে যা দেখিনি, আজ সশরীরে সেই দ্বীপে আরোহণ করলুম, এইটেই সবচেয়ে বড়ো কথা! এ ঠাঁইটিকে আমরা যদি ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সুমাত্রা কি সিংহলের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলে মনে করি, তাহলে কার সাধ্য প্রতিবাদ করে?