জয়ন্ত বললে, চোর ওই গরাদ খুলে ঘরের ভিতরে ঢুকেছে।
হরিহর উঠে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। খোলা গরাদটা হাতে করে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করতে বললেন, এর মধ্যে বিশেষ দ্রষ্টব্য কিছুই নেই।
–না। কিন্তু জানালার বাইরে কর্দমাক্ত জমির উপরে চোরের পায়ের ছাপ আছে। -বটে, বটে! সেগুলো তো দেখতে হয়!
—গরাদ-খোলা জানালার ফাক দিয়ে গলে বাইরে গিয়ে ছাপগুলো আমি দেখে এসেছি। কিন্তু আপনি কি তা পারবেন?
প্রবল মস্তকান্দোলন করে হরিহর বললেন, মোটেই নয়, মোটেই নয়। ওইটুকু ফাক দিয়ে কিছুতেই আমার গতর গলবে না। আমার দেহ গলবার জন্যে দরকার একটা গোটা দরজার ফক। তিনকড়িবাবু, ওই জমিতে যাবার অন্য পথ আছে তো?
আছে। আসুন। এই বলে তিনকড়ি অগ্রবর্তী হলেন।
যদুবাবু চুপিচুপি বললেন, জয়ন্তবাবু, একটা আরজি জানাতে পারি?
জয়ন্ত বললে, নিশ্চয় পারেন।
—আমি গোয়েন্দার গল্প পড়তে ভারী ভালোবাসি। কিন্তু সত্যিকার গোয়েন্দারা কেমন করে কাজ করেন তা কখনও দেখিনি। শুনেছি, পায়ের ছাপ দেখে গোয়েন্দারা অনেক কথাই বলতে পারেন। আপনাদের কাজ দেখবার জন্যে আমার বড়ো আগ্রহ হচ্ছে।
বেশ তো, আসুন না। মাধববাবু বললেন, আমাদেরও আগ্রহ কম নয়। আমরাও যেতে পারি কি? জয়ন্ত বললে, আপনারা সবাই আসুন।
।।ছয় ।।
ছোটো একফালি জমি—লম্বায় পঁচিশ হাত, চওড়ায় আট হাত। দক্ষিণ দিকে বাঁশের বেড়া, তারপর রাজপথ।
হরিহরের আগেই জয়ন্ত সেই জমির উপরে গিয়ে দাঁড়াল—তার পিছনে পিছনে যদুবাবু এবং আর সবাই।
জমির সব জায়গাই তখনও ভিজে রয়েছে। জয়ন্ত বললে, যদুবাবু, আমার পাশে পাশে আসুন। মাটির উপরে সাবধানে পা ফেলুন, চোরের পায়ের ছাপ মাড়িয়ে ফেললে হরিহরবাবু মহা খাপ্পা হয়ে উঠবেন।
তারা তিনকড়িবাবুর বৈঠকখানার গরাদে খোলা জানালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে জয়ন্ত বললে, মাটির উপরে ওই দেখুন চোরের পায়ের ছাপ। বেশ বোঝা যায়, সে বাঁশের বেড়া টপকে যেদিক থেকে এসেছে, আবার চলে গিয়েছে সেই দিকেই।
যদুবাবু বললেন, চোরটা কী বোকা! এতবড় একটা সূত্র পিছনে রেখে গিয়েছে।
জয়ন্ত হেসে বললে, চোরটা হচ্ছে কাঁচা, নইলে সে সাবধান হত।
এমন সময়ে তিনকড়ি প্রভৃতিকে নিয়ে হরিহর এসে পড়লেন। তিনি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পায়ের ছাপগুলোর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
তিনকড়ি বললেন, জুতো-পরা পায়ের ছাপ। হরিহরবাবু, আমার বামুন আর চাকর জুতো পরে না।
হরিহর বললেন, হয়তো বাইরের চোরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে। রুলের গুঁতো খেলেই পেটের কথা বেরিয়ে পড়বে।
জয়ন্ত বললে, হরিহরবাবু, পায়ের ছাপগুলো দেখে কী বুঝলেন?
—যা বোঝবার তা বুঝেছি। আপনাকে বলব কেন?
জয়ন্ত হাস্যমুখে বললে, বেশ আপনি কী বুঝেছেন জানতে চাই না। কিন্তু আমি যা বুঝেছি, বলব কি?
হরিহর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, বলতে ইচ্ছা করেন, বলতে পারেন। আমার শোনবার আগ্রহ নেই।
জয়ন্ত বললে, প্রত্যেক পায়ের দাগের মাঝখানকার ব্যবধানটা লক্ষ করুন। এটা আপনাকে মনে করিয়ে দেওয়া বাহুল্য যে, ঢ্যাঙা লোক পা ফেলে বেশি তফাতে তফাতে আর খাটো লোক পা ফেলে কম তফাতে তফাতে। এখানে পায়ের দাগের ব্যবধান দেখে কী মনে হয়?
হরিহর মাটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, এগুলো নিশ্চয় কোনও ছোটো ছেলে—অর্থাৎ বালকের পায়ের ছাপ।
—ধরলুম তাই। এইবারে তিনকড়িবাবুর বৈঠকখানার দৃশ্যের কথা ভেবে দেখুন। তার নোটগুলো ছিল আলমারির উপর তাকে। মাথায় ছোটো চোরের হাত উঁচুতে পৌছয়নি। তাই সে টেবিলের সামনে থেকে, চেয়ারখানা আলমারির সামনে টেনে নিয়ে গিয়ে তার উপরে উঠে দাঁড়িয়ে নোটগুলো হস্তগত করে। তারপর তাড়াতাড়ি পালাবার সময়ে তার গায়ের ধাক্কা লেগে চেয়ারখানা উলটে পড়ে যায়। এ ব্যাপারটা গোড়াতেই আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলুম। এদিকে আপনারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলুম। কিন্তু অধীনের কথা আপনি গ্রাহের মধ্যেও আনতে রাজি হননি।
অপ্রতিভ ভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন হরিহর।
তিনকড়ি বললেন, বালক চোর? কী আশ্চর্য।
যদুবাবু দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে বললেন, একটা পুঁচকে ছোকরা বিশ হাজার টাকা হাতিয়ে লম্বা দিয়েছে! আজব কাণ্ড!
মাধববাবু বললেন, কালে কালে হল কী?
।। সাত ।।
জয়ন্ত বললে, হরিহরবাবু, এই জুতো পরা পায়ের ছাপের আর-একটা বিশেষত্ব লক্ষ করুন। চোর যে জুতো পরে এখানে এসেছিল, তার ডান পাটির তলায় বাঁ-দিকের উপর কোণের চামড়ার খানিকটা চাকলা উঠে গিয়েছে। এই দেখুন, প্রত্যেক ডান পায়ের ছাপেই তার স্পষ্ট চিহ্ন দেখা যাচ্ছে।
হরিহরের মুখের উপর থেকে মুরুব্বিয়ানার ভাব মিলিয়ে গেল। তিনি বলে উঠলেন, তাই তো বটে, তাই তো বটে! তাকে পেলে তার বিরুদ্ধে মামলা সাজাতে আর কোনও কষ্ট হবে। না। তারপরেই একটু থেমে, মুষড়ে পড়ে তিনি আবার বললেন, কিন্তু তাকে আর পাব কি?
জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললে, চোর নিজেই আমাদের কাছে এসে ধরা দেবে। হরিহর সচমকে শুধোলেন, কী বললেন?
—চোরের খোঁজ আমি পেয়েছি।
–কোথায়, কোথায়?
—এইদিকে একটু এগিয়ে আসুন। এই পায়ের ছাপগুলো দেখে কী বুঝছেন?
—এও তো চোরেরই পায়ের ছাপ।
–কোনও তফাত নেই তো?
ভালো করে দেখে সন্দিগ্ধ স্বরে হরিহর বললেন, মনে হচ্ছে এ ছাপ যেন টাটকা।
জয়ন্ত বললে, ঠিক তাই। এগুলোর সৃষ্টি হয়েছে এইমাত্র। নির্বোধ চোর খেয়ালে আনেনি, কাল রাতের বিষম বৃষ্টির জন্যে মাটি এখনও ভিজে আছে।…আরে, আরে যদুবাবু, খরগোশের মতো দৌড়ে কোথা যান? মানিক, হুঁশিয়ার!