এ কথা শুনে শিয়াল বললে, ‘আচ্ছা, এক কাজ করতে পার?’
সওদাগর বললে, ‘কি কাজ?’
শিয়াল বললে, ‘তুমি রাজামশায়ের কাছে গিয়ে বল, মহারাজ, আমার একজন সাক্ষী আছে। আপনার বাড়িতে যদি কুকুর না থাকে, তবে সেই সাক্ষীটিকে নিয়ে আসতে পারি।’
তখন সওদাগর আবার রাজার কাছে গিয়ে বললে, ‘মহারাজ, আমার একটি সাক্ষী আছে, কিন্ত আপনার বাড়ির কুকুরদের ভয়ে সে আসতে পারছে না। অনুগ্রহ করে যদি কুকুর তাড়িয়ে দেবার হুকুম দেন, তবে আমার সাক্ষীটিকে নিয়ে আসতে পারি।’
তা শুনে রাজামশাই তখুনি সব কুকুর তাড়িয়ে দেবার হুকুম দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, এখন তোমার সাক্ষী আসুক।’
এসব কথা সওদাগর শিয়ালকে এসে বলতেই শিয়াল চোখ বুজে টলতে-টলতে রাজার সভায় এল। সেখানে এসেই সে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঝিমুতে লাগল। রাজামশাই তা দেখে হাসতে-হাসতে বললেন, ‘কি শিয়াল পণ্ডিত? ঘুমুচ্ছে যে?’
শিয়াল আধ চোখে মিট-মিট করে তাকিয়ে বললে, ‘মহারাজ, কাল সারা রাত জেগে মাছ খেয়েছিলুম, তাই আজ বড্ড ঘুম পাচ্ছে।’
রাজা বললেন, ‘এত মাছ কোথায় পেলে?’
শিয়াল বললে, ‘কাল নদীর জলে আগুন লেগে সব মাছ এসে ডাঙ্গায় উঠল। আমরা সকলে মিলে সারা রাত খেলুম, খেয়ে কি শেষ করতে পারি!’ এ কথা শুনে রাজামশাই এমনি ভয়ানক হাসলেন যে, আর একটু হলেই তিনি ফেটে যেতেন। শেষে অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, ‘এমন কথা তো কখনো শুনিনি! জলে আগুন লাগে, এও কি কখনো হয়? এ সব পাগলের কথা!’
তখন শিয়াল বললে, ‘মহারাজ, ‘ঘোড়া গাছের ছানা হয়, এমন কথাও কি কখনো শুনেছেন? সে কথা যদি পাগলের না হয়, তবে আমার এই কথাটার কি দোষ হল?’
শিয়ালের কথায় রাজামশাই ভারি ভাবনায় পড়লেন।
ভেবে-চিন্তে শেষে তিনি বললেন, ‘তাই তো! ঠিক বলেছ! গাছের আবার কি করে ছানা হবে? সে বেটা নিশ্চয় তবে নিশ্চয় চোর।
তখনই হুকুম হল, ‘আন তো রে সেই চোর বেটাকে বেঁধে!’
অমনি দশ পেয়াদা গিয়ে চোরকে বেঁধে আনলে। আনতেই রাজামশাই বললেন, ‘মার বেটাকে পঞ্চাশ জুতো!’
বলতেই বলতেই পেয়াদারা তাদের নাগরা জুতো খুলে চটাশ-চটাশ চোরের পিঠে মারতে লাগাল। সে বেটা পঁচিশ জুতো খেয়ে চেঁচিয়ে বললে, ‘গেলুম গেলুম! আমি ঘোড়া এনে দিচ্ছি। আর এমন কাজ কখনো করব না!’ কিন্ত তার কথা আর তখন কে শোনে! পঞ্চাশ জুতো মারা হলে রাজা বললেন, ‘শিগগির ঘোড়া এনে দে, নইলে আরো পঞ্চাশ জুতো!’
চোর তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ঘোড়া এনে দিল। তারপর তার নিজ হাতে নাক-কান মলিয়ে মাথা চেঁছে, তাতে ঘোল ঢেলে হতভাগাকে দেশ থেকে দূর করে দেওয়া হল। সওদাগর তার ঘোড়া পেয়ে শিয়ালকে আশীর্বাদ করতে লাগল।
হাতির ভিতরে শিয়াল
রাজার যে হাতিটা তাঁর আর সকল হাতির চেয়ে ভালো আর বড় দেখতে সুন্দর, সেইটে তাঁর ‘পাটহস্তী’।
সেই হাতিতে চড়ে রাজামশাই চলাফেরা করেন, আর তাকে খুব ভালবাসেন।
একদিন রাজার পাটহস্তী মরে গেল। রাজা অনেকক্ষণ ভারি দুঃখ করলেন, শেষে বললেন, ‘ওটাকে ফেলে দিয়ে এস।’
তখন সেই হাতির পায়ে বড়-বড় দড়ি বেঁধে পাঁচশো লোক টেনে তাকে মাঠে ফেলে দিয়ে এল।
সেই মাঠের কাছে এক শিয়াল থাকত। সে অনেক দিন পেট ভরে খেতে পায়নি। মাঠে মরা হাতি দেখতে পেয়ে, সে খুব খুশি হয়ে এসে, তাকে খেতে আরম্ভ করল। তার এতই খিদে হয়েছিল যে, খেতে-খেতে সে হাতির পেটের ভিতরে ঢুকে গেল, তবুও তার খাওয়া শেষ হল না। এমনি করে দুদিনে চলে গেল, তখনো সে হাতির পেটের ভিতরে বসে কেবল খাচ্ছেই। ততদিন রোদ লেগে চামড়া শুকিয়ে, হাতির পেটের ফুটো ছোট হয়ে গেছে, আর শিয়ালও অনেক খেয়ে মোটা হয়ে গেছে। তখন তো তার ভারি মুশকিল হল। সে অনেক চেষ্টা করেও হাতির পেটের ভিতর থেকে বেরোতে পারল না। এখন উপায় কি হবে?
এমন সময় তিনজন চাষী সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের দেখতে পেয়েই শিয়ালের মাথায় এক ফন্দি জোগাল। সে হাতির পেটের ভিতর থেকে তাদের ডেকে বললে, ‘ওহে ভাই সকল, তোমরা রাজার কাছে একটা খবর দিতে পারবে? আমার পেটে যদি পঞ্চাশ কলসী ঘি মাখানো হয়, তবে আমি উঠে দাঁড়াব।’
চাষীরা তাতে ভারি আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘শোন-শোন, হাতি কি বলছে! চল রাজামশাইকে খবর দিইগে।’ তারা তখুনি রাজার কাছে ছুটে গিয়ে বললে, ‘রাজামশাই, আপনার সেই মরা হাতি বলছে যে তার পেটে পঞ্চাশ কলসী ঘি মাখালে সে আবার উঠে দাঁড়াবে। শিগগির পঞ্চাশ কলসী ঘি পাঠিয়ে দিন।’
এ কথায় রাজামশাই যে কি খুশি হলেন, কি আর বলব! তিনি বললেন, ‘আমার হাতি যদি বাঁচে, পঞ্চাশ কলসী ঘি আর কত বড় একটা কথা! হাজার কলসী ঘি নিয়ে তার পেটে মাখাও।’ তখুনি হাজার মুটে হাজার কলসী ঘি নিয়ে মাঠে উপস্থিত করল। দুহাজার লোক মিলে সেই ঘি হাতির পেটে মাখাতে লাগল। সাতদিন খালি ‘আনো ঘি’, ‘ঢাল ঘি’ ছাড়া সেখানে আর কোনো কথাই শোনা গেল না।
সাতদিনের পরে শিয়াল দেখলে যে, হাতির চামড়াও ঢের নরম হয়েছে, পেটের ফুটোও ঢের বড় হয়েছে, এখন সে ইচছা করলেই বেরিয়ে আসতে পারে। তখন সে সকলকে ডেকে বলল, ‘ভাই সকল, এইবার আমি উঠব। তোমরা একটু সরে দাঁড়াও, নইলে যদি আমি মাথা ঘুরে তোমাদের উপরে পড়ে টড়ে যাই!’
তখন ভারি একটা গোলমাল হল। যে যাকে সামনে পাচ্ছে, তাকেই ধাক্কা মেরে বলছে, ‘আরে বেটা, শিগগির সর! হাতি উঠছে, ঘাড়ে পড়বে।’