এই বলে শিয়াল শিয়ালিনীকে নিয়ে তাদের পুরনো গর্ত ছেড়ে চলে গেল।
এর খানিক বাদেই কুমির এসেছে। সে এসে ‘শিয়াল পণ্ডিত, ‘শিয়াল পণ্ডিত, বলে কত ডাকল, কেউ তার কথার উত্তর দিল না! তখন সে গর্তের ভিতর-বার খুঁজে দেখল-শিয়ালও নেই, শিয়ালিনীও নেই! খালি তার ছানাদের হাড়গুলো পড়ে আছে।
তখন তার খুব রাগ হলো, আর সে চারদিকে ছুটোছুটি করে শিয়ালকে খুঁজতে লাগল। খুঁজতে-খুঁজতে নদীর ধারে গিয়ে দেখল, ঐ! শিয়াল আর শিয়ালিনী সাঁতরে নদী পার হচ্ছে।
অমনি ‘দাঁড়া হতভাগা!’ বলে সে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। জলের নীচে ছুটতে কুমিরের মত কেউ পারে না, দেখতে-দেখতে সে গিয়ে শিয়ালের পিছনের একটা পা কামড়ে ধরল!
শিয়াল সবে তার সামনের দু-পা ডাঙ্গায় তুলেছিল, শিয়ালিনী তার আগেই উঠে গিয়েছিল। কুমির এসে শিয়ালের পা ধরতেই সে শিয়ালিনীকে ডেকে বললে, ‘শিয়ালিনী, শিয়ালিনী, আমার লাঠিগাছা ধরে কে টানাটানি করছে! লাঠিটা বা নিয়েই যায়!’
একথা শুনে কুমির ভাবলে, ‘তাই তো, পা ধরতে গিয়ে লাঠি ধরে ফেলেছি! শিগগির লাঠি ছেড়ে পা ধরি।’
এই ভেবে যেই সে শিয়ালের পা ছেড়ে দিয়েছে, অমনি শিয়াল একলাফে ডাঙ্গায় উঠে গিয়েছে। উঠেই বোঁ করে দে ছুট। তারপর বনের ভিতরে ঢুকে পড়লে আর কার সাধ্য তাকে ধরে।
তারপর থেকে কুমির কেবলই শিয়ালকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্ত শিয়াল বড্ড চালাক, তাই তাকে ধরতে পারে না। তখন সে অনেক ভেবে এক ফন্দি করল।
কুমির একদিন চড়ায় গিয়ে হাত পা ছাড়িয়ে মরার মতো পড়ে রইল। তারপর শিয়াল আর শিয়ালিনী কচ্ছপ খেতে এসে দেখল, কুমির কেমন হয়ে পড়ে আছে! তখন শিয়ালিনী বললে, ‘মরে গেছে! চল খাইগে! শিয়াল বললে, ‘রোস একটু দেখে নিই।’ এই বলে সে কুমিরের আর একটু কাছে গিয়ে বলতে লাগল, ‘না! এটা দেখছি বড্ড বেশী মরে গেছে! অত বেশী মরাটা আমরা খাই না। যেগুলো একটু-আধটু নড়ে-চড়ে, আমরা সেগুলো খাই।’
তা শুনে কুমির ভাবলে, ‘একটু নড়ি-চড়ি, নইলে খেতে আসবে না।’ এই মনে করে কুমির তার লেজের আগাটুকু নাড়তে লাগল। তা দেখে শিয়াল হেসে বললে, ‘ঐ দেখ, লেজ নাড়ছে! তুমি তো বলেছিলে, মরে গেছে!’ তারপর আর কি তারা সেখানে দাঁড়ায়! তখন কুমির বললে, ‘বড্ড ফাঁকি দিলে তো! আচ্ছা এবারে দেখাব!’
একটা জায়গায় শিয়াল রোজ জল খেতে আসত! কুমির তা দেখতে পেয়ে সেখানে গিয়ে লুকিয়ে রইল। ভাবল, শিয়াল জল খেতে এলেই ধরে খাবে। সেদিন শিয়াল এসে দেখল, সেখানে একটাও মাছ নেই। অন্য দিন ঢের মাছ চলা-ফেরা করে। শিয়াল ভাবলে, ‘ভালো রে ভালো, আজ সব মাছ গেল কোথায়? বুঝেছি, এখানে কুমির আছে!’ তখন সে বললে, ‘এখানকার জলটা বেজায় পরিস্কার। একটু ঘোলা না হলে কি খাওয়া যায়? চল শিয়ালিনী, আর -এক জায়গায় যাই।’ এ কথা শুনেই কুমির তাড়াতাড়ি সেখানকার জল ঘোলা করতে আরম্ভ করলে। তা দেকে শিয়াল হাসতে হাসতে ছুটে পালিয়েছে!
আর একদিন শিয়াল এসেছে কাঁকড়া খেতে। কুমির তার আগেই সেখানে চুপ করে বসে আছে। শিয়াল তা টের পেয়ে বলল, ‘এখানে কাঁকড়া নেই, থাকলে দু-একটা ভাসত।’
অমনি কুমির তার লেজের আগাটুকু ভাসিয়ে দিল। কাজেই শিয়াল আর জলে নামল না।
অমনি করে বারবার শিয়ালের কাছে ঠকে গিয়ে, শেষে কুমিরের ভারি লজ্জা হল। তখন সে আর কি করে মুখ দেখাবে। কাজেই সে তার ঘরের ভিতরে গিয়ে বসে রইল।
সাক্ষী শিয়াল
একজন সওদাগর একটি ঘোড়া নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছিল। যেতে যেতে তার বড্ড ঘুম পেল। তখন সে ঘোড়াটিকে এক গাছে বেঁধে, সে গাছের তলায় ঘুমিয়ে রইল।
এমন সময় এক চোর এসে সওদাগরের ঘোড়াটিকে নিয়ে চলে যাচ্ছে।
সওদাগর ঘোড়ার পায়ের শব্দে জেগে উঠে বললে, ‘কি ভাই, তুমি আমার ঘোড়াটিকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?’
চোর তাতে ভারী রাগ করে বললে, ‘তোমার ঘোড়া আবার কোনটা হল?’
শুনে সওদাগর আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘সেকি কথা! তুমি আমার ঘোড়া নিয়ে চলে যাচ্ছ, আবার বলছ কোন্টা আমার ঘোড়া?’
দুষ্টু চোর তখন মুখ ভার করে বললে, ‘খবরদার তুমি আমার ঘোড়াকে তোমার ঘোড়া বলবে না!’
সওদাগর বললে, ‘কি? আমি আমার ঘর থেকে ঘোড়াটাকে নিয়ে এলুম, আর তুমি বলছ সেটা তোমার?’
চোর বললে, ‘বটে! এটা তো তোমার ঐ গাছের ছানা। এক্ষুনি হল। তুমি বুঝে শুনে কথা কও, নইলে বড় মুশকিল হবে।’
তখন সওদাগর গিয়ে রাজার কাছে নালিশ করল, ‘মহারাজ, আমি গাছে আমার ঘোড়াট বেঁধে ঘুমুচ্ছিলুম, আর ঐ বেটা এসে তাকে নিয়ে যাচ্ছে।’
রাজামশাই চোরকে ডেকে জিগগেস করলেন, ‘কি হে, তুমি ওর ঘোড়া নিয়ে যাচ্ছ কেন?’
চোর হাত জোড় করে বললে, ‘দোহাই মহারাজ! এটি কখনই ওর ঘোড়া নয়। এটি আমার গাছের ছানা। ছানাটি হতেই আমি তাকে নিয়ে যাচ্ছিলুম, আর ঐ বেটা উঠে বলছে কিনা, ওটা ওর ঘোড়া! সব মিথ্যা কথা!’
তখন রাজামশাই বললেন, ‘এ তো ভারি অন্যায়। গাছের ছানা হল, আর তুমি বলছ সেটা তোমার ঘোড়া। তুমি দেখছি বড় দুষ্টু লোক। পালাও এখান থেকে!’ বলে তিনি ঘোড়াটা চোরকেই দিয়ে দিলেন।
সওদাগর বেচারা তখন মনের দুঃখে কাঁদতে-কাঁদতে বাড়ি ফিরে চলল। খানিক দূরে গিয়ে এক শিয়ালের সাথে তার দেখা হল।
শিয়াল তাকে কাঁদতে দেখে বললে, ‘কি ভাই? তোমার মুখ এমন ভার দেখছি যে! কি হয়েছে?’
সওদাগর বললে, ‘আর ভাই, সে কথা বলে কি হবে? আমার ঘোড়াটি চোরে নিয়ে গেছে। রাজার কাছে নালিশ করতে গেলুম, সেখানে চোর বললে কিনা, ওটা তার গাছের ছানা! রাজামশাই তাই শুনে ঘোড়াটি চোরকেই দিয়ে দিয়েছেন।’