- বইয়ের নামঃ টুনটুনির বই
- লেখকের নামঃ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
- বিভাগসমূহঃ ছোট গল্প
আখের ফল
শিয়াল পণ্ডিত আখ খেতে বড় ভালবাসে, তাই সে রোজ আখ ক্ষেতে যায়। একদিন সে আখের ক্ষেতে ঢুকে একটি ভিমরুলের চাক দেখতে পেল। ভিমরুলের চাক সে আগে কখনো দেখেনি, সে মনে করল ওটা বুঝি আখের ফল।
শিয়াল কিনা পণ্ডিত মানুষ, তাই সে আখকে বলে ‘ইক্ষু’, ক্ষেতকে বলে ‘ক্ষেত্র’, লাঠিকে বলে ‘দণ্ড’,।
ভিমরুলের চাক দেখে সে বললে, ‘আহা ইক্ষুর কি চমৎকার ফল! খেতে না জানি কতই মিষ্টি হবে?’ এই মনে করে যেই সে ভিমরুলের চাক খেতে গিয়েছে, অমনি সব ভিমরুল বেরিয়ে কি-মজাটাই তাকে দেখাতে লাগল! শিয়াল তো প্রাণের ভয়ে খালি ছোটে, আর বলে, ‘ইক্ষুর ক্ষেত্রে আর যাব না!’
খানিক বাদে ভিমরুলগুলো তাকে ছেড়ে গেল। তখন সে ভাবলে, ‘ক্ষেত্রে তো রোজই যাই, তাতে কিছু হয় না। ফল খেতে গিয়েই আমার বিপদ হল। তবে আর ক্ষেত্রে যাব না কেন? ফল না খেলেই হল।’ এই ভেবে সে বলতে লাগল, ‘যদি ইক্ষুর ক্ষেত্রে যাব, ইক্ষুর ফল আর না খাব!’ দুদিন সে খালি এ কথাই বলে।
তারপর যখন বেদনা একটু কমে এল, তখন সে ভাবলে, ‘ঐ ফলটার ভিতর পোকা ছিল, তারাই আমাকে কামড়েছে। আগে যদি ফলটাতে নাড়া দিতুম তবে পোকাগুলি বেরিয়ে যেত। তারপর ফল খেতে কোনো কষ্ট হত না! আহা, সে ফল খেতে না জানি কতই মিষ্টি। তবে আর ফল খাব না কেন? খাবার আগে পোকা তাড়িয়ে দিলেই হবে।’ এই ভেবে সে বলতে লাগল, ‘যদি ইক্ষুর ফল খাব, আগে দণ্ড দিয়ে নাড়া দিব!’ বলতে-বলতে আখের ক্ষেতে গিয়ে সে তো লাঠি দিয়ে নাড়া দিয়েছে। অমনি আর যাবে কোথায়! ভিমরুলের দল এসে তাকে কামড়িয়ে আধমরা করে তবে ছাড়ল। সেই থেকে সে আর ইক্ষুর ফল খেত না।
উকুনে বুড়ির কথা
এক যে ছিল উকুনে-বুড়ি, তার মাথায় বড্ড ভয়ানক উকুন ছিল। সে যখন তার বুড়োকে ভাত খেতে দিতে যেন তখন ঝরঝর করে সেই উকুন বুড়োর পাতে পড়ত। তাইতে সে একদিন রেগে গিয়ে, ঠাঁই করে বুড়িকে এক ঠেঙার বাড়ি মারলে। তখন বুড়ি ভাতের হাঁড়ি আছড়ে গুঁড়ো করে রাগের ভয়ে সেই যে নদীর ধার দিয়ে চলে গেল, আর তাকে বুড়ো ডেকে ফিরাতে পারলে না।
নদীর ধারে এক বক বসে ছিল, সে উকুনে-বুড়িকে দেখে বললে, ‘উকুনে-বুড়ি, কোথা যাস?’
উকুনে-বুড়ি বললে,
স্বামী মারলে, রাগে তাই
ঘর-গেরস্তী ফেলে যাই।
বক বললে, ‘তোর স্বামী মারলে কেন? কি হয়েছে?
উকুনে-বুড়ি বললে, ‘আমার মাথা থেকে তার পাতে উকুন পড়েছিল।’
বক বললে, ‘কেন, উকুন তো বেশ লাগে! তার জন্যে মারলে কেন? তুই আমার বাড়ি চল। শুনেছি তুই খুব ভালো বাঁধিস।’ তাইতে উকুনে-বুড়ি বকের বাড়িতে রাঁধুনি হল। তার রান্না বকের বেশ ভালো লাগত, আর পাতে উকুন পড়লে তো সে খুব খুশিই হত।
তখন, একদিন হয়েছে কি-বক এনেছে একটা মস্ত শোল মাছ। এনে সে উকুনে বুড়িকে বললে, ‘উকুনে-বুড়ি, মাছটা বেশ করে রাঁধ।’
বলে সে আবার নদীর ধারে চলে গেল। উকুনে-বুড়ি মাছ রাঁধতে লাগল। রাঁধতে রাঁধতে বেচারা মাথা ঘুরে কখন কড়ার মধ্যে পড়ে গিয়েছে কেউ জানতে পারেনি।
বক এসে দেখলে, উকুন-বুড়ি পুড়ে মরে আছে। দেখে তার এমনি দুঃখ হল যে, সে নদীর ধারে গিয়ে মুখ ভার করে বসে রইল, সাতদিন কিছু খেল না।
নদী বললে, ‘ভালোরে ভালো, সাতদিন ধরে এমন করে বক বসে আছে, খায় দায়নি! এর হল কি? হ্যাঁ ভাই বক, তোর হয়েছে কি ভাই?’
বক বললে, ‘আরে ভাই, সে কথা বলে কি হবে? আমার যা হবার তা হয়েছে।’
নদী বললে, ‘ভাই, আমাকে বলতে হবে।’
বক বললে, ‘যদি বলি, তবে কিন্তু তোর সব জল ফেনা হয়ে যাবে।’
নদী বললে, ‘হয় হবে, তুই বল।’
তখন বক বললে-
উকুনে-বুড়ি পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন উপোস রইল।
অমনি ফ্যান-ফ্যান করে দেখতে-দেখতে নদীর চল ফেনিয়ে সাদা হয়ে গেল।
সেই নদীতে এক হাতি রোজ জল খেতে আসে। সেদিন সে জল খেতে এসে দেখে, একি কাণ্ড হয়ে আছে!
হাতি বললে, ‘নদী, তোর কি হল? তোর জল কি করে ফেনা হয়ে গেল?’
নদী বললে, ‘তা যদি বলি, তবে কিন্তু তোর লেজটি খসে পড়ে যাবে।’
হাতি বললে, ‘যায় যাবে, তুই বল।’
উকুনে-বুড়ি পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন উপোস রইল,
নদীর জল ফেনিয়ে গেল।
অমনি ধপাস করে হাতির লেজটা খসে পড়ে গেল!
তারপর হাতি গাছতলা দিয়ে যাচ্ছে, গাছ তাকে দেখে বললে, ‘বাঃ রে, তোর একি হল? লেজ কোথায় গেল?’
হাতি বললে, ‘তা যদি বলি, তবে কিন্তু তোর পাতাগুলি সব এক্ষুনি ঝড়ে পড়বে।’
গাছ বলল, ‘পড়ে পড়ুক, তুই বল্।’
তখন হাতি বললে-
উকুনে-বুড়ি পুড়ে, মোলো,
বক সাতদিন উপোস রইল,
নদীর জল ফেনিয়ে গেল,
হাতির লেজ খসে পড়ল।
অমনি ঝর-ঝর করে গাছের সব পাতাগুলি ঝড়ে পড়ে গেল। সেই গাছে এক ঘুঘুর বাসা ছিল। সে তখন খাবার খুঁজতে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখে, ওমা একি হয়েছে! ঘুঘু বললে, ‘গাছ, তোর একি হল? তোর পাতা সব কোথায় গেল?’
গাছ বললে, ‘তা যদি বলি, তবে কিন্তু তোর চোখ কানা হয়ে যাবে।’
ঘুঘু বললে, ‘যায় যাবে, তুই বল্।’
তখন গাছ বললে-
উকুনে-বুড়ি পুড়ে মোলো,
বক সাতদিন উপোস রইল,
নদীর জল ফেনিয়ে গেল,
হাতির লেজ খসে পড়ল,
গাছের পাতা ঝড়ে পড়ল।
অমনি টস্ করে ঘুঘুর একটা চোখ কানা হয়ে গেল।