Site icon BnBoi.Com

এসো – ইমদাদুল হক মিলন

এসো - ইমদাদুল হক মিলন

এসো

এসো – ইমদাদুল হক মিলন
প্রথম প্রকাশ – বইমেলা ২০০১

০১.

বিকেলবেলার আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদছিল সুমি।

এমন নিঃশব্দ কান্নাও কাঁদে মানুষ! চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে, বুকের ভেতর চাপ ধরা কষ্ট, তবু কান্নায় কোনও শব্দ নেই। যেন সুমি কোনও রক্ত মাংসের মানুষ নয়, সুমি এক কলের পুতুল। চাবি দিলে যে পুতুল কেবল কাঁদে। চোখের জলে কেবলই বুক ভাসায়।

বাবার মৃত্যুর পর থেকে বিকেলের দিকটায় এভাবেই কাঁদে সুমি।

এসময়কার বিকেলের আকাশ কী রকম দুখজাগানিয়া। ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালে বুকের ভেতর উথলে উঠে প্রিয়জন হারানো হাহাকার।

মৃত্যুর পর কোথায় চলে যায় মানুষ!

ওই আকাশে!

সুমি যখন কঁদছে অমি তখন তার রুমে। অমির হতদরিদ্র রুমে একটাই চোখে পড়ার মতো জিনিস। কম্পিউটার। পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে অমি সেই কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। মনজুড়ে অমিরও চলছে বাবার জন্য হাহাকার। নিজের অজান্তেই যেন কম্পিউটার স্ক্রিনে অমি এক সময় লিখল, বাবা, এভাবে কেন মরে গেলে!

তারপর সেই লেখার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল অমি।

যে মানুষটার জন্য এভাবে কাঁদছে দুজন মানুষ, এ বাড়ির ড্রয়িংরুমে তাঁর একটি বাঁধানো ছবি আছে। টেন টুয়েলভ সাইজের ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ছবি। ছবিটি একাত্তর সালের। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন করে, ঢাকায় ফিরে লক্ষ্মীবাজারের কালাম স্টুডিওতে গিয়ে তুলেছিলেন ছবিটা। তখনও অস্ত্র জমা দেননি মুক্তিযোদ্ধারা। কাঁধে ছিল তাঁর স্টেনগান।

বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধার মাথায় তখন লম্বা চুল, মুখময় দাড়ি গোঁফ। গোলা বারুদের ঝাঁজে টকটকে লাল চোখ কারও কারও, যুদ্ধের ক্লান্তি শরীরময়। তারপরও অসম্ভব উজ্জ্বল মুখ একেকজনের। এই ঔজ্জ্বল্য যুদ্ধ জয়ের। স্বাধীনতার।

মাসুদ সাহেবের মুখেও আছে সেই প্রখর ঔজ্জ্বল্য। স্বাধীনতার পর ঊনত্রিশ বছর কেটে গেছে, সেই ঔজ্জ্বল্য একটুও ম্লান হয়নি। ছবির দিকে তাকালে এখনও সেদিনকার মানুষটিকে পরিষ্কার দেখা যায়। ছবিতে আছেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি আর কোথাও নেই।

আজ বিকেলে স্বামীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে এই কথাটাই মনে হলো পারুর। ছবিতেই আছেন মাসুদ সাহেব, স্মৃতিতে আছেন, বাস্তবে কোথাও নেই।

একথা ভেবে ছেলে এবং মেয়ের মতো পারুও কেঁদে ফেললেন। অদূরের ভাঙা সোফায় যে সেলিম বসে আছে সে কথা মনেই হলো না তার।

কিন্তু পারুকে চোখ মুছতে দেখে উঠে দাঁড়াল সেলিম। তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল।

সেলিমের স্বভাব হচ্ছে কথা শুরুর আগে মৃদু একটা গলা খাকারি দেয়া।

এখনও দিল। দিয়ে বলল, আপনিও যদি এভাবে কান্নাকাটি করেন তাহলে সুমি অমিকে সামলাবে কে? এভাবে ভেঙে পড়া ঠিক হচ্ছে না।

সেলিমের কথাটা যেন শুনতেই পেলেন না পারু। তবে পাশে সেলিমকে দেখে আঁচলে চোখ মুছলেন। ধরা গলায় বললেন, এই ছবিটা তাঁর খুব প্রিয় ছিল। ছবিটার দিকে কখনও কখনও মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতেন। বলতেন, আমার জীবনের সবচে বড় অহংকার, আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি।

সেলিম বিনীত গলায় বলল, এসব কথা এখন থাক।

এবারও তার কথা যেন শুনতে পেলেন না পারু। আগের মতো করেই বললেন, সারাটা জীবন তাকে যুদ্ধ করেই যেতে হলো। আজকালকার দিনে এত সৎ মানুষ হয় না। স্বাধীনতার পর ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারতেন। লাইসেন্স, পারমিট, পাকিস্তানিদের বাড়ি দখল, দোকান, জমি দখল। লক্ষ লক্ষ টাকা কামাবার সুযোগ সে সময় পেয়েছেন। কোনও সুযোগ কখনও নেননি। নিলে আমাদের চেহারা আজ অন্যরকম থাকত। এত নিঃস্ব অবস্থায় আমাদেরকে ফেলে, প্রায় বিনা চিকিৎসায় …।

কথা বলতে বলতে শেষদিকে গলা ভেঙে এল পারুর। শব্দ করে কেঁদে ফেললেন তিনি।

পারুর এই অবস্থা দেখে সেলিম একটু দিশেহারা হলো। মৃদু গলা খাকারি দিয়ে বলল, এখন এসব ভেবে আপনি যদি এমন করেন, মানে আপনাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আমার নেই, তারপরও বলি, আপনি শান্ত না হলে ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে।

পারু চোখ মুছতে মুছতে বললেন, শান্ত আমি কেমন করে হই বাবা? আমার অবস্থাটা তুমি একটু ভাব! অন্য সমস্যাগুলো না হয় বাদ দিলাম, তোমার সঙ্গে যে সুমির এনগেজম্যান্ট হয়ে আছে, বিয়ের ডেট হয়ে আছে, এই অবস্থায় মেয়েটিকে আমি বিয়ে দেব কেমন করে!

এই চিন্তাটা আরও কয়েকদিন পরে করুন। মানে আমি বলছিলাম যে সময় তো আছে।

কী এমন সময় আছে? দুআড়াই মাস। চোখের পলকে কেটে যাবে। সুমির বাবা বেঁচে থাকলে কোনও না কোনও ভাবে গরিবী হালে ব্যবস্থা একটা হতোই। তিনি যা পারতেন আমি তো তা পারব না। থাকার মধ্যে এইটুকু একটা বাড়ি। দুপয়সা সাহায্য করার কেউ নেই। তারপরও তুমি আমাকে বল আমি কিছু ভাবব না?

সেলিম মাথা নীচু করল। অবস্থাটা আমি বুঝি। তারপরও আপনাকে এইসব সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া আমারই বা কী করার আছে! পড়াশুনো শেষ করে বছর দুয়েক হলো ব্যাংকের এই চাকরিটায় ঢুকেছি। আমরাও মধ্যবিত্ত। ফ্যামিলির অবস্থা তেমন ভাল না।

সেলিমের কথায় পারু একটু লজ্জা পেলেন। না না, তোমাকে আমি কিছু করার কথা বলছি না। আমার মেয়ের সৌভাগ্য যে তোমার মতো ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে। আজকালকার দিনে এমন ছেলে পাওয়া যায় না। তোমার মতো শিক্ষিত, এম বিএ করা ছেলে, ব্যাংকে অত ভাল চাকরি কর, তোমার মতো ছেলেরা বিয়ে করার জন্য বড়লোকের মেয়ে খোঁজে। বড়লোকরাও মেয়ের জন্য তোমার মতো পাত্র খোঁজে। সেখানে তুমি আমাদের মতো একটা ফ্যামিলিতে …….।

কথা শেষ করলেন না পারু।

সেলিম বলল, টাকা পয়সা এবং সামাজিক প্রতিপত্তির মোহ সবার থাকে না। প্রথম কথা হলো আপনাদের সবাইকে আমার খুব ভাল লেগেছে। তাছাড়া আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। বিষয়টিকে আমি খুব সম্মানের মনে করেছি।

এই বাড়ির কাজের বুয়ার নাম শিরিন। বহুদিন ধরে আছে। ফলে বাড়িতে কে এলে চা বিসকুট দিতে হবে, কী করতে হবে, সব তার জানা। বলতে হয় না কিছুই।

মাত্র কদিন আগে বাড়ির কর্তা মারা গেছেন। এই অবস্থায় বাড়িতে কাউকে আপ্যায়নের কোনও ব্যাপার নেই। তারপরও সেলিম এসেছে দেখে সেলিমের জন্য চা করেছে সে, যত্ন করে চা বিসকুট এবং একগ্লাস পানি নিয়ে এসেছে ড্রয়িংরুমে। এসে দেখে সেলিম এবং পারু খুবই মন খারাপ করা ভঙ্গিতে কথা বলছে। দেখে আর দাঁড়ায়নি। ট্রেটা ভাঙাচোরা সেন্টার টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে চলে গেছে।

দুজন মানুষের কেউ শিরিনকে দেখতে পায়নি।

এই রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে শিরিন ভেবেছে কাজটা সে ঠিকই করেছে। দুদিন পর বাড়ির জামাই হবে যে, এনগেজম্যান্ট হয়েছে, অর্ধেক জামাই তো সে হয়েই আছে, বাড়ির অবস্থা যাই হোক চা বিসকুট তাকে দিয়ে পারা যাবে না। সেই গানের মতো। ঠাকুর জামাই এল বাড়িতে।

সেলিমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাই যেন চায়ের ট্রেটা চোখে পড়ল পারুর। ব্যস্ত হলেন তিনি। চা খাও বাবা, চা খাও। আহা কোন ফাঁকে দিয়ে গেছে শিরিন, বোধহয় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। দাঁড়াও, শিরিনকে ডাকি। গরম করে দিতে বলি।

সেলিম অমায়িক গলায় বলল, দরকার নেই। আপনি ব্যস্ত হবেন না। চা এখন আমি খাব না। আমি বরং সুমির সঙ্গে একটু দেখা করি।

হ্যাঁ, যাও বাবা, যাও। ওকে একটু সান্ত্বনা দাও। দিনরাত কান্নাকাটি করছে।

সেলিম তারপর সুমির রুমের দিকে চলে গেল। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তখনও কাঁদছে সুমি।

সেলিম এই রুমের দরজায় টুকটুক করে নক করল। চমকে দরজার দিকে তাকাল সুমি। তারপর চোখ মুছল।

সেলিম বলল, আসব?

সুমি আবার চোখ মুছল। তারপর মাথা নাড়ল।

সেলিম ভেতরে ঢুকল। যথারীতি গলা খাকারি দিয়ে বলল, দশ বারো দিন পার হয়ে গেছে তারপরও চোখের পানি ফুরাচ্ছে না তোমার?

সুমি ভেজা গলায় বলল, বাবার জন্য চোখের পানি আমার কোনও দিনও ফুরাবে না।

কিন্তু মৃত্যু এমন এক অমোঘ নিয়তি, মানুষের সাধ্য নেই মৃত্যুকে এড়িয়ে থাকার। কখনও না কখনও মৃত্যু আসবেই।

এসব বইয়ের কথা। সবাই জানে।

তারপরও এসব কথাই সারাজীবন ধরে বলতে হয়। মানুষকে সান্ত্বনা দেয়ার নতুন কোনও ভাষা আসলে তৈরি হয়নি। পুরনো কথাগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে হয়। তাছাড়া মৃত্যুও তো একটা পুরনো বিষয়। পৃথিবীর শুরু থেকে আছে, পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত থাকবে।

কিন্তু কী এমন বয়স হয়েছিল বাবার? মানুষ তো আশি নব্বই একশো বছরও বাঁচে!

একশো তিরিশ চল্লিশ বছর বাঁচার রেকর্ডও মানুষের আছে। আবার জন্ম মুহূর্তেও মরে যায় কোনও কোনও মানুষ। মাতৃগর্ভে মরে যায়।

একটু থামল সেলিম। সুমি, তোমার মনে হতে পারে তর্ক বিতর্ক করার জন্য কথাগুলো আমি বলছি। আসলে তা নয়। আসলে অনেক কথা বলে তোমার মন আমি অন্যদিকে ঘুরাতে চাচ্ছি। তোমরা সবাই মিলে যে রকম কান্নাকাটি করছ, এভাবে চললে তোমরা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়বে। অসুস্থ হলে বিপদ আরও বাড়বে। মন শক্ত কর, শক্ত হয়ে দাঁড়াও।

সুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমি চাই, সত্যি আমি চাই মন শক্ত করতে, শক্ত হয়ে দাঁড়াতে। পারি না। আমার শুধু কান্না পায়।

বলে আবার একটু কাঁদল সুমি। ওড়নায় চোখ মুছল।

সুমির দিকে তাকিয়ে সেলিম বলল, কিন্তু তুমি বড়। তোমার দায়িত্ব অনেক। মায়ের কথা না হয় ভাবলে না, একমাত্র ভাইটির কথা তো ভাববে! তোমরা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করলে ওইটুকু ছেলের মনের অবস্থা কী হয় ভাব তো! তাছাড়া চারমাস পর ছেলেটির ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা!

ডানহাতখানা মায়াবি ভঙ্গিতে সুমির কাঁধে রাখল সেলিম। শক্ত হও, শক্ত হও।

এই হাতের স্পর্শে সুমির কান্না আরও গম্ভীর হলো।

.

০২.

অমির জানালায় অনেকদিনের পুরনো পর্দা।

ছেঁড়াখোঁড়া কোণা ঝুলে পড়েছে। তবুও পর্দা। পুরোপুরি না হলেও আলো কিছুটা ঠেকিয়ে রাখে। সকালবেলার রোদ, রাতেরবেলা লাইটপোস্ট থেকে আসা আলো এই পর্দার ফাঁক ফোকর দিয়ে অমির রুমে ঢোকেই।

আজ রাতেও ঢুকেছে।

সেই আলোর দিকে এখন তাকিয়ে আছে অমি। রাত গম্ভীর হয়েছে। কিন্তু চোখে ঘুম নেই তার। বাবার কথা মনে পড়ছে।

বাবার কথা মনে পড়লেই কম্পিউটারটার দিকে তাকায় অমি।

এখনও তাকাল। তারপর বিছানা থেকে নামল, নেমে লাইট জ্বালল। সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল রুম। কম্পিউটারটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল।

ধীর পায়ে কম্পিউটারের সামনে এসে দাঁড়াল অমি। প্রিয়জনকে আদর করার ভঙ্গিতে কম্পিউটারের গায়ে হাত বুলাতে লাগল।

ঠিক তখুনি নিজের রুম থেকে বেরিয়েছে সুমি।

রাতেরবেলা প্রায়ই পিপাসা পায় তার। এজন্য বিছানার পাশে এক বোতল পানি রাখে। আজ রাখতে ভুলে গিয়েছিল। পিপাসায় ঘুম ভাঙার

পর পানির বোতল না পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং স্পেসে এসেছে। সে। ফ্রিজ খুলে গ্লাসে পানি ঢেলে খেয়েছে। তারপরই দেখতে পেয়েছে অমির রুমের দরজা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। সেই দরজা দিয়ে আলো আসছে।

সুমি খুব অবাক হলো।

এত রাতে অমির রুমে আলো জ্বলছে কেন? দরজাই বা খোলা কেন? নিজের রুমে না ঢুকে নিঃশব্দে অমির রুমের দরজা ঠেলল সুমি। ভেতরে ঢুকল। কিন্তু আমি তা টেরই পেল না। আগের ভঙ্গিতে কম্পিউটারের গায়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।

সুমি এসে অমির পাশে দাঁড়াল। তুই এখনও ঘুমোসনি?

অমি চমকাল। ও, আপা! না ঘুমোইনি। শুয়েছিলাম কিন্তু ঘুম আসেনি।

উঠে বাইরে গিয়েছিলি?

না।

তাহলে দরজা খোলা ছিল কেন? একথা শুনে মুখটা করুণ হয়ে গেল অমির। বন্ধ করতে মনে ছিল না।

সুমি আঁতকে উঠল। সর্বনাশ! আমাদের যে রকম বাড়ি, যে কোনও দিক দিয়ে চোর ঢুকে যাবে। এমনিতেই এত বড় বিপদ আমাদের, তার ওপর আরও বিপদ ঘটে যাবে। যদি কম্পিউটার চুরি হয়ে যায়?

আর এমন হবে না।

হ্যাঁ কিছুতেই যেন এমন না হয়। কোনও কোনও ফ্যামিলিতে মা বাবা ভাইবোন কেউ মারা যাওয়ার পর একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটে। বাদলভাইদের ঘটনাটা জানিস না?

না, কী হয়েছিল?

বাদলভাইর মা যেদিন মারা গেলেন সে রাতে শটসার্কিট হয়ে বাদলভাইর ফ্ল্যাটের সব ফার্নিচার পুড়ে গেল না?

তাই নাকি? আমি শুনিনি তো!

হ্যাঁ, বাদলভাইর ফ্ল্যাটের সব ফার্নিচার পুড়ে গেছে তো। আবার সব ফার্নিচার নতুন করে বানিয়ে তবে ফ্ল্যাটে উঠেছেন তারা।

যে রাতে শটসার্কিট হয় সে রাতে বাদলভাইরা কোথায় ছিলেন?

ফ্লা্যাটেই ছিলেন। ধোয়া এবং আগুনে যখন সবদিক ভরে গেছে তখন কোনও রকমে বাচ্চাকাচ্চা এবং ভাবীকে নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরুতে পেরেছিলেন।

ভাগ্যিস ঘুমটা ভেঙেছিল। ওমা, ওরকম ধোঁয়া আর আগুনে কারও ঘুম না ভেঙে পারে!

তারপর হঠাৎ করে বাদলভাইদের কুকুরটার কথা মনে পড়ল অমির। কবে যেন শুনেছিল ছোট্ট সুন্দর একটা কুকুর আছে বাদলভাইয়ের। বিদেশি কুকুর, ছবির মতো দেখতে। কুকুরটা নাকি খুবই প্রিয় তাদের।

সেই কুকুরটার কথা সুমিকে জিজ্ঞেস করল অমি। আপা, বাদলভাইদের কুকুরটা তখন কোথায় ছিল? কুকুরটার কোনও ক্ষতি হয়নি তো?

সুমি বলল, না। কুকুরটাকে চট করে কোলে নিয়েছিল বাদলভাইর ছোটমেয়ে অর্চি। কুকুর কোলে নিয়েই বেরিয়েছিল।

শুনে কী রকম একটা হাঁপ ছাড়ল অমি।

সুমি বলল, বাদলভাইরা বড়লোক মানুষ, ফ্ল্যাটের সবকিছু পুড়ে গেছে, তিন চারলাখ টাকার নাকি ক্ষতি হয়েছে, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমরা তো অতি গরিব এবং অসহায়, তার ওপর বাবা নেই, আমাদের সংসারে এখন যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে সবাই মিলে মারা পড়ব।

তারপরই সুমি খেয়াল করল অমি কম্পিউটার অন করেনি।

তাহলে কম্পিউটারের সামনে দাঁড়িয়ে সে কী করছিল!

প্রশ্নটা অমিকে করল সুমি। তুই তো কম্পিউটার অন করিসনি। কী করছিলি?

অমি মাথা নীচু করে বলল, কিছু না।

মানে?

কম্পিউটারে হাত বুলাচ্ছিলাম।

কেন?

মনে হচ্ছিল বাবাকে ছুঁয়ে দিচ্ছি।

গলাটা কেমন ধরা ধরা অমির, বোধহয় চোখও ছলছল করছে। কিন্তু মাথা নীচু করে রেখেছে বলে ভাইর চোখ দেখতে পেল না সুমি।

অমি বলল, তোর মনে আছে আপা, আমার কম্পিউটারের শখ দেখে বাবা কোথা থেকে টাকা পয়সা ধার করে কম্পিউটার কিনে আনল! তখন কম্পিউটারের দামও বেশি ছিল।

ভাইয়ের কথা শুনতে শুনতে কখন জলে ভরে গেছে সুমির চোখ। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখ মুছল সে। আমরা দুজন ছিলাম বাবার জান। কোনও কিছু চাইলে যেমন করে হোক বাবা তা এনে দিতেন। যত কষ্ট হতো, এনে দিতেন। এটা বোঝার পর কোনও কিছুর শখ হলেও বাবাকে আমি তা বলতাম না।

একথা শুনে অমি আরও কাতর হলো। আমার তাহলে কম্পিউটারের শখ হওয়া ঠিক হয়নি আপা। কম্পিউটারের জন্য বাবাকে নিশ্চয় অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।

খুবই মায়াবি হাতে অমির কাঁধের কাছটা ধরল সুমি। এসব ভেবে মন খারাপ করিস না। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়।

বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে সুমি, অমি ডাকল। আপা।

সুমি ঘুরে দাঁড়াল। কী?

বাবা এভাবে কেন মরে গেল?

শুনে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল সুমির। প্রায় ছুটে এসে অমির মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরল সে। ভাইবোন দুজনে মিলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

গভীর রাতের নির্জনতা ছাড়া এই কান্না কেউ টের পেল না।

.

০২.

কিছু বাজার যে করতে হয় আম্মা?

নিজের বিছানায় অসহায় মুখে বসে আছেন পারু। শিরিনের কথা শুনে তার মুখের দিকে তাকালেন।

শিরিন বলল, ঘরে কিছু নাই। ফ্রিজ খালি।

পারু আনমনা গলায় বললেন, ডিম রান্না করো।

শিরিন সঙ্গে সঙ্গে বলল, ডিমই বা পামু কই?

পারু চমকালেন। ডিমও নেই?

না। একটাও নাই।

তাহলে কয়েকটা ডিম নিয়ে এসো।

ডিমের কাম কী, টেকা দেন, বাজারই কইরা নিয়াসি। বাজার আমি চিনি। করতে পারুম।

নিজের বালিসের তলায় খুচরো খাচরা টাকা রাখার স্বভাব আছে। পারুর। শিরিনের কথা শুনে বালিস তুললেন তিনি। না, টাকা পয়সা তেমন নেই। একটা মাত্র বিশ টাকার নোট পড়ে আছে। সেই নোটটাই শিরিনের হাতে দিলেন তিনি। ডিমই নিয়ে এসো।

টাকা হাতে নিয়ে পারু বলল, আইচ্ছা।

তারপর দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। একটা কথা কইতে চাইছিলাম আম্মা।

বল।

কইতে একটু শরমও করে, আবার না কইয়াও পারি না। মরা বাড়িতে এই হগল কথা কওন ঠিক না।

পারু বুঝে গেলেন শিরিন কী বলতে চাইছে। বললেন, তোমার বেতনের কথা?

জ্বে। এই তো আপনে বুইজা গেছেন। তিনমাস ধইরা দেন না। পোলাডা গেরামে থাকে আমার মার কাছে। ইসকুলে পড়ে। তিনমাস ধইরা তার কোনও খরচা দিতে পারি নাই।

পারু কাতর গলায় বললেন, আমি সব জানি। আর কয়েকটা দিন দেরি কর।

শিরিন সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল। জ্বে আইচ্ছা, হেইডা করুমনে। আপনের অসুবিদাঁড়া আমি বুজি আম্মা। সাহেব আঁথকা মইরা গেলেন, অসুবিদা তো একটু হইবই। আপনেগ তো আর কোনও রুজি রোজগারের মানুষ নাই। তয় টেকার লগে কয়েকটা দিনের ছুট্টিও আমারে দিয়েন। পোলাডারে একটু দেইখা আসুমনে।

শিরিন আর দাঁড়াল না।

শিরিন চলে যাওয়ার পর খানিক কী ভাবল পারু তারপর সুমির রুমে এসে ঢুকল।

জানালার কাছে পুরনো বেতের চেয়ার নিয়ে বসে আছে সুমি। কোলের ওপর মলাট ঝুলে পড়া, খুবই জীর্ণ একটা অ্যালবাম। সেই অ্যালবাম ঘেঁটে বাবার সঙ্গে তার এবং অমির ছবি দেখছে। মার সঙ্গে বাবার ছবি দেখছে।

খুব বেশি ছবি নেই তাদের। তবু যা দুচারটা আছে সেইসব ছবি ঘিরে কত আনন্দ বেদনার স্মৃতি।

কোনও কোনও ছবি দেখে চোখ ছলছল করছিল সুমির।

পারু এসব খেয়াল করলেন না। অসহায় গলায় বললেন, কী করি এখন বল তো?

সুমি চোখ তুলে তাকাল। কী হয়েছে?

ঘরে টাকা পয়সা কিছু নেই। বাজার করার টাকাটা পর্যন্ত নেই।

সুমি উঠে দাঁড়াল। অ্যালবামটা বিছানার ওপর রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাবার মৃত্যুর দিনই বুঝেছিলাম, দশ পনের দিন পরই এই অবস্থা হবে আমাদের। যেখানে যা কিছু ছিল নার্সিংহোমেই তো গেছে।

তারপরও প্রায় বিনা চিকিৎসাতেই …..।

পারুর কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমি বলল, এরচে’ বেশি কিছু আমাদের করার ছিল না মা। সিভিয়ার হার্টএ্যাটাক।

তবু টাকা পয়সা থাকলে, বিদেশে নিয়ে যেতে পারলে ….।

এবারও তার কথা শেষ করতে দিল না সুমি। বলল, এসব এখন আর ভেব না। এখন ভাব অন্য সমস্যার কথা।

ভেবে কী করব বল! পাশে দাঁড়াবার মতো একজন মানুষ নেই, যে কিছুটা সাহায্য করবে, পরামর্শ দেবে।

সুমি আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সত্যি কী দুর্ভাগা আমরা। একজুন মাত্র মাঝারি ধরনের বড়লোক আত্মীয় আছে, বাদলভাই, পুরো ফ্যামিলি নিয়ে তিনি ইমিগ্রান্ট হয়ে গেছেন কানাডায়। আর যা দুচারজন আত্মীয় স্বজন আছে তাদের অবস্থা আমাদের চেয়েও খারাপ। তোমার। দিককারও, বাবার দিককারও। ওরা আমাদেরকে কী সাহায্য করবে, চিরকাল বাবার কাছেই সাহায্যের জন্য আসা যাওয়া করেছে।

এসব কথা ভাল লাগছিল না পারুর।

অধৈর্যের গলায় তিনি বললেন, কিন্তু এখন কী করব? বুয়ার তিনমাসের বেতন বাকি, মাসের প্রথম দিক এখন, কত রকমের বিল দিতে হবে। টেলিফোন বিল, ইলেকট্রিক বিল, গ্যাস, পানি। মাসের বাজার। সুমি, এইসব টেনশানে তোর বাবার কথাও আমি ভাবতে পারছি না।

মার অস্থিরতা দেখে তার একটা হাত ধরল সুমি। তুমি এত নার্ভাস হয়ো না মা। ব্যবস্থা কিছু না কিছু একটা হবেই।

কী ব্যবস্থা হবে? আমি তো কোনও পথ দেখছি না।

তারপর হঠাৎ করেই যেন মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেল তার। টেলিফোনটা বিক্রি করে দিই?

সুমি অবাক হলো। মানে?

তোর বাবার অসুখের সময় পাশের বাড়ির মিতুর মা আমাকে বলেছিল, টাকা পয়সার খুব দরকার হলে আমাদের টেলিফোনটা তারা কিনতে পারে। আমাদের ফোনটা পেলে ওদের সুবিধা হলো ট্রান্সফার করার টাকা বেঁচে যায়।

সুমি চিন্তিত হলো। কিন্তু বাড়িতে একটা ফোন থাকবে না?

ফোন দিয়ে এখন আর আমরা কী করব বল? কাকে ফোন করব, কে আমাদেরকে ফোন করবে?

বাবা অনেক কষ্ট করে ফোনটা এনেছিল। বাবার নামে ফোন।

তাতো আমি জানিই। উপায় না দেখেই ভাবছি। নয়তো ঘরের জিনিস কে বিক্রি করতে চায়, বল?

দুচারটা দিন যাক। আর একটু ভেবে …..।

সুমির কথা শেষ হওয়ার আগে মা ভেঙেপড়া গলায় বললেন, এই দুচারদিই বা চলবো কী করে? সামান্য গয়নাগাটি যা ছিল আমার, সব তো আগেই গেছে। তোদের নিয়ে এখন আমার না খেয়ে মরতে হবে।

পারু ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।

তারপর চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন।

মা বেরিয়ে যাওয়ার পর উদাস হয়ে খানিক কী ভাবল সুমি, তারপর গলার চেনটা আলতো করে ধরল।

.

০৪.

টেলিফোন বিলগুলো খুবই যত্নে একটি ক্লিপ ফাঁইলে রেখে দিয়েছেন মাসুদ সাহেব। যখনই বিল আসতো, বিল পরিশোধ করার পর কাউন্টার পার্ট রেখে দিতেন ফাঁইলে। সেই ফাঁইলটা নিয়ে আজ দুপুরের পর বসেছেন পারু। একটা একটা করে বিল চেক করছেন, কোনও মাসের বিল বাকি পড়েছে কিনা দেখছেন।

টেলিফোনটা বিক্রি করতে হলে বিল ক্লিয়ার থাকতে হবে।

এসময় বিষণ্ণমুখে অমি এসে ঢুকল এই রুমে। ফোনটা সত্যি বিক্রি করে ফেলবে মা?

মুহূর্তের জন্য ছেলের দিকে তাকালেন পারু। এছাড়া কী করব, বল?

তারচে’ না হয় আমার কম্পিউটারটা …..। মানে কম্পিউটার তো আমাদের তেমন দরকার নেই। কম্পিউটারের চেয়ে টেলিফোন বেশি। দরকারি।

ফাঁইল রেখে উঠে দাঁড়ালেন পারু। তোর অত শখের জিনিস। কত কষ্ট করে তোর বাবা কিনে দিয়েছিলেন! তাছাড়া পুরনো কম্পিউটার সেভাবে বিক্রিও করা যায় না। আর ফোনের ব্যাপারটা হলো, তোর বাবাই যখন নেই, ফোন দিয়ে আমরা আর কী করব?

অমি আমতা গলায় বলল, আর একটা কথা বলব?

বল।

তুমি রাগ করবে না তো?

না।

কম্পিউটার টাইপিংটা আমি খুব ভাল শিখেছি। বেশ ভাল স্পিড আমার। ইচ্ছে করলে যে কোনও জায়গায় কাজ পাব আমি। কোনও পত্রিকা অফিসে, কিংবা কোনও প্রেসে।

কিন্তু মাস চারেক পর তোর পরীক্ষা।

পার্টটাইম কাজ নেব। ওই কাজ করেও পরীক্ষা দেয়া যাবে। কোনও অসুবিধা হবে না। দেড় দুহাজার টাকা আমি রোজগার করতে পারব।

অমির কথা শুনতে শুনতে জলে চোখ ভরে এলো পারু। দুহাতে ছেলেকে বুকে টেনে নিলেন তিনি। মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে ভাঙাচোরা গলায় বললেন, কী কপাল আমার! এইটুকু ছেলেকে রোজগারের কথা ভাবতে হচ্ছে। না না, তুই এসব ভাবিস না বাবা। তুই এসব ভাবিস না। তুই মন দিয়ে পড়াশুনো কর। পরীক্ষা দে। আমি তো বেঁচে আছি। যা করার আমি করব।

মায়ের বুকে অমি তখন নিঃশব্দে কাঁদছে।

বাইরে থেকে ফিরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল সুমি, মায়ের রুমের দিকে চোখ পড়তেই এই দৃশ্যটা দেখতে পেল। নিজের রুমে আর গেল না সে। মায়ের রুমে এসে ঢুকল। কী হয়েছে?

পারু বললেন, কিছু না।

তারপর বুক থেকে আলগা করলেন অমিকে। যা, হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বস গিয়ে, যা।

অমি কোনওদিকে তাকাল না। চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল।

এবার সুমির দিকে তাকালেন পারু। তুই হঠাৎ কোথায় চলে গেলি? আমাকে কিছু বলেও গেলি না।

সুমি কেমন চটপটে হয়ে গেল। আমার এক বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলাম।

কেন?

ওই যে তুমি বললে ঘরে কোনও টাকা পয়সা নেই।

পারু অবাক হলেন। ধার আনতে গেলি?

সুমি আগের মতোই চটপটে গলায় বলল, না মানে ও আমাকে ফোন করল তো, কথায় কথায় বললাম, তোর কাছে কিছু টাকা হবে?

বান্ধবীর নাম কী?

ওকে তুমি চিনবে না। আমাদের বাড়িতে কখনও আসেনি।

পারু গম্ভীর গলায় বললেন, নাম কী?

টিংকু, টিংকু। কথায় কথায় বললাম তোর কাছে হাজার পাঁচেক টাকা হলে আমাকে দে। পাঁচ হাজার হয়নি। সাড়ে চার হাজার হয়েছে। তাই দিয়ে দিল।

হাতের ব্যাগ খুলে টাকাটা বের করল সুমি। পারুর হাতে দিল। বুয়ার বেতনটা দিয়ে দাও, আর বাজার টাজার….।

টাকা হাতে নিয়ে পারু বললেন, ফেরত দিতে হবে কবে?

যখন ইচ্ছে দিলেই হবে। কোনও তাড়া নেই।

টাকা হাতে আলমারির দিকে মুখ ফিরিয়েছেন পারু, হঠাৎ যেন তার মনে হলো সুমির গলাটা ফাঁকা ফাঁকা। চেনটা নেই। সঙ্গে সঙ্গে সুমির গলার দিকে তাকালেন তিনি।

সত্যি তো! চেনটা তো নেই।

বললেন, তোর চেন কোথায়?

সুমি একটু চমকাল। গলার কাছটায় হাত দিল। আছে।

পরে যাসনি?

না। মানে খুলে রেখে গেছি।

কেন?

যা ছিনতাই টিনতাই হয় রাস্তায়!

পারু গম্ভীর হলেন। কোথায় রেখেছিস চেন? যা নিয়ে আয়।

কেন?

আমি দেখব।

তুমি হঠাৎ আমার চেন নিয়ে পড়লে কেন? আছে আমার রুমে। পরে দেখাব তোমাকে।

পারুর মুখটা করুণ হলো। কেন অযথা মিথ্যে বলছিস?

মিথ্যে বলছি মানে?

যা বোঝার আমি বুঝে গেছি।

সুমি জোর গলায় বলল, কী বুঝে গেছ তুমি? কী?

চেন বিক্রি করে এই টাকাটা তুই এনেছিস।

সঙ্গে সঙ্গে উদাস হয়ে গেল সুমি। হ্যাঁ, এছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছুই করার ছিল না মা।

পারুর চোখ আবার জলে ভরে এলো।

মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁর কাঁধে হাত দিল সুমি। সুমি এত মন খারাপ করছ কেন? টাকা হলে চেন আবার কিনে নেয়া যাবে। প্রয়োজনে এই সমস্ত জিনিস সবাই বিক্রি করে।

পারু চোখ মুছে বললেন, এরপর কী বিক্রি করবি?

মায়ের কাঁধ থেতে হাত নামিয়ে সুমি চঞ্চল গলায় বলল, এখন ওসব ভেবে লাভ নেই। আমার খুব খিদে পেয়েছি। বুয়াকে বল খাবার রেডি করতে।

সুমি নিজের রুমের দিকে চলে গেল।

.

০৫.

আজ সকালে শিরিন নিজে বাজার করেছে।

শাক সবজি মাছ মশলা, মনখানেক চাল, মাসখানেক চলার মতো আটা অর্থাৎ যা যা লাগে সংসারে। এখন ব্যস্ত হাতে সেসব গুছিয়ে গুছিয়ে রাখছে। কোনওদিকে খেয়াল নেই তার। পারু এসে যে দরজার সামনে দাঁড়ালেন, তাঁর ডানহাতে যে মুঠো করে ধরা কিছু টাকা, শিরিন তা খেয়ালই করল না।

কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে শিরিনকে খানিক দেখলেন পারু, তারপর ডাকলেন, বুয়া।

চমকে দরজার দিকে তাকাল শিরিন।

মুঠো আলগা করে টাকাটা শিরিনের দিকে এগিয়ে দিলেন পারু। তোমার তিনমাসের বেতন।

টাকার দিকে ফিরেও তাকাল না শিরিন। ব্যস্ত হাতে কাজ করতে করতে বলল, এখন তো কাম করতাছি। রাখেন আপনের কাছে। পরে নিমুনে।

পারু বললেন, কাজ এখন রাখ।

ক্যান?

কথা শোন। কথা আছে।

শিরিন কাজ থামাল। বলেন।

পারু আবার টাকা এগিয়ে দিলেন। এটা রাখ।

আঁচলে হাত মুছে টাকাটা নিল শিরিন, আঁচলেই গিঁট দিয়ে রাখল। রাখতে রাখতে বলল, আইচ্ছা নিলাম। এইবার কন, কী কথা?

এ মাসের তো আর কয়েকটা দিন বাকি আছে, এখন থেকে তুমি কাজ খুঁজতে শুরু কর।

শিরিন চমকাল। জ্বে?

হ্যাঁ, যাতে পহেলা তারিখ থেকে লেগে যেতে পার।

এবার যেন কথাটা পুরো বুঝল শিরিন। বিব্রত গলায় বলল, ক্যান, আপনে কি আমারে ছাড়ায়ে দিলেন নাকি? আমি কি কাম খারাপ করি, আ আমার কোনও বদস্বভাব আছে?

আরে না। কাজ খুবই ভাল কর তুমি। তুমি মানুষও ভাল। তোমার মতো লোক আমি কোথায় পাব। এতদিন ধরে আছ, এত বিশ্বস্ত।

তাইলে আমার অসুবিদা কি?

অসুবিধা তোমার না, আমাদের। তুমি তো সবই জানো। বাড়িতে কাজেরা বুয়া রাখা এখন আর আমার পক্ষে সম্ভব না। মাসে তিনশো টাকা বেতন আমি কোত্থেকে দেব?

শিরিন নির্বিকার গলায় বলল, না দিতে পারলে দিবেন না।

পারু অবাক। তোমার তাহলে চলবে কী করে?

আল্লায় চালায় নিব। এই নয়শো টাকা মার কাছে পাড়াইয়া দিয়া কমু, আর দিতে পারুম না। যেমনে পার আমার পোলারে মানুষ কর, না পারলে এতিমখানায় দিয়া দেও।

শিরিনের কথা শুনে পারুর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। কেন আমাদের জন্য নিজের এত ক্ষতি তুমি করবে?

কিয়ের ক্ষতি? না আমার কোনও ক্ষতি হইতাছেনা তো! আপনেগো আমার ভাল লাগে এর লেইগা আমি এই বাড়ি ছাইড়া যাইতে চাই না। মানুষের ভাল লাগার একটা দাম আছে না!

কিসের ভাললাগা? আমাদের বাড়ি ভাল লাগার কি কোনও কারণ। আছে? বাড়ির খাওয়া ধাওয়া ভাল না, একদিন বাজার হবে একদিন হবে না! এরকম বাড়িতে তুমি কেন থাকবে, বল?

পারুর কাছে সামান্য এগিয়ে এসে শিরিন বলল, সাফ কথা শোনেন আম্মা। আপনেরা খাইলে আমি খামু, আপনেরা না খাইলে আমি খামু না। আর আপনে এত ভাইঙ্গা পড়ছেন ক্যান? বিপদে পড়া ভাল মানুষের জন্য আল্লাহপাকের দরবার থিকা ফেরেশতা নাইমা আসে। আইসা বিপদে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়ায়। আপনেগ পাশেও দাঁড়াইবো। ডরায়েন না। ভাল মানুষের লেইগা আল্লাহ আছে।

শিরিন যে মুহূর্তে এসব কথা বলছে ঠিক তখুনি ঢাকার জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে এসে নামল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি বিমান।

.

০৬.

নিজের রুম থেকে বেরিয়েই মার মুখোমুখি পড়ে গেল অমি।

কিচেন থেকে বেরিয়েছেন পারু। অমিকে দেখে দাঁড়ালেন। কোথায় যাচ্ছিস?

বাইরে।

বাইরে কোথায়?

অমি একপলক মায়ের মুখের দিকে তাকাল। তারপর মাথা নীচু করল। তেমন কোথাও না।

পারু অবাক হলেন। মানে?

আবার চোখ তুলে মায়ের মুখের দিকে তাকাল অমি। মা, বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন, কখনও যেন কারও সঙ্গে মিথ্যে কথা না বলি। মিথ্যে বলার অবস্থা হলে কথাটা আমি এড়িয়ে যাই।

এড়াবার দরকার নেই। সত্য কথা বল।

কম্পিউটারের কাজ নিতে চাইলাম, তুমি রাজি হলে না। এজন্য আমি টিউশনি খুঁজছি। দুটো টিউশনি পেলে বারো থেকে পনেরোশো টাকা। দু জায়গায় দুঘণ্টা পড়াব। ভালমতো খুঁজলে টিউশনি আমি পেয়ে যাব। নিজের পড়াশুনোরও কোনও অসুবিধা হবে না। আজকাল অনেকেই টিউশনি করে।

পারু নির্বিকার গলায় বললেন, তুইও করিস। তবে পরীক্ষার পর।

এখন অসুবিধা কী?

এখন টিউশনি করলে পড়াশুনোর ক্ষতি হবে। এখন যে কয়েকটা মাস আছে ঘরে বসে ভাল মতো পড়াশুনো কর যাতে রেজাল্ট খুব ভাল হয়।

অমি চুপ করে রইল।

পারু বললেন, যা ঘরে যা।

আবার মায়ের মুখের দিকে তাকাল অমি। কিন্তু মা, সংসারের এই অবস্থা …..।

অমির কথা শেষ হওয়ার আগেই পারু বললেন, ওসব তোকে ভাবতে হবে না। ভাবব আমি।

অমি আর কথা বলল না। নিজের রুমে গিয়ে ঢুকল।

তারপরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন পারু। একটা দীর্ঘশ্বাসও পড়ল তাঁর।

ঠিক এরকম একটি দীর্ঘশ্বাস মনজুরও পড়ল।

খানিক আগে ইমিগ্রেশান ইত্যাদির ঝামেলা শেষ হয়েছে। হ্যাঁন্ডব্যাগ নিয়ে লাগেজ আসার জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে মনজু।

লাগেজ আসতে শুরু করেছে বেশ খানিক আগে। কিন্তু মনজুরটা এখনও আসেনি।

একটি মাত্র সুটকেস তার। আর সঙ্গে একটা ব্যাগ। এই নিয়ে চলে এসেছে।

মনজুর পরনে জিন্স। পায়ে বুট। চুলগুলো বিদেশীদের ভঙ্গিতে ছাটা। মুখখানি খুব মায়াবি তার। এই মায়াবি মুখ প্লেন জার্নিতে ক্লান্ত। তবু ক্লান্তিটা মনজু টের পাচ্ছে না। বুকে তার অদ্ভুত এক উত্তেজনা।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে কোন হোটেলে যাবে মনজু?

মনজু যখন একথা ভাবছে ঠিক তখুনি তার সুটকেসটা বেরিয়ে এল। একটু এগিয়ে গিয়ে সুটকেসটা মনজু নামাল। তারপর একহাতে ব্যাগ, অন্যহাতে সুটকেস টানতে টানতে গ্রীন চ্যানেলের দিকে হাঁটতে লাগল। দীর্ঘশ্বাসটা তখনই পড়ল তার।

কেন?

মনজুর কি মনে হলো জীবনে প্রথম নিজের দেশে ফিরল সে কিন্তু কেউ তাকে রিসিভ করতে এল না!

ইমিগ্রেশান এরিয়ার বাইরে বড় বড় সব হোটেলের কাউন্টার। যে কোনও একটা কাউন্টারে গিয়ে যে কোনও হোটেলে রুম বুক করতে পারে মনজু। হোটেল কাউন্টার থেকে গাড়িও ব্যবস্থা করে দেবে।

কিন্তু মনজু তা করল না। ব্যাগ সুটকেস নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

বাইরে প্রচুর স্কুটার, ইয়েলোক্যাব। ড্রাইভাররা ডাকাডাকিও শুরু করল। এইসব গাড়ির সঙ্গে দালালও থাকে। দুচারজন দালালও লাগল মনজুর পেছনে। কিন্তু সে কাউকে পাত্তা দিল না, কারও দিকে ফিরে তাকাল না। একটি ইয়েলোক্যাবের সামনে তার বয়সী, ভদ্রগোছের এক যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়িটা আপনার?

জ্বী!

যাবেন?

কোথায়?

কোনও একটা হোটেলে।

কী ধরনের হোটেল? সোনারগাঁও, শেরাটন! নাকি পূবাণী?

এগুলো তো বড় হোটেল?

জী।

আমি যেতে চাইছি মাঝারি ধরনের কোনও একটা হোটেলে। আপনার চেনা তেমন কোনও হোটেল আছে?

জ্বী আছে।

কোথায়?

শান্তিনগরে।

কী নাম?

হোয়াইট হাউজ।

সুন্দর নাম।

হোটেলটাও সুন্দর।

ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধমুখে হাসল মনজু। আপনি বলছেন?

ড্রাইভারও হাসল। জ্বী স্যার।

চলুন তাহলে।

সুটকেসটা কেরিয়ারে তুলল ড্রাইভার। হ্যাঁন্ডব্যাগটা সঙ্গে রাখল মনজু। গাড়ি ছুটতে লাগল।

কিন্তু কী আশ্চর্য ব্যাপার, গাড়িতে চড়েই মনজুর খুব ইচ্ছে করল এককাপ চা খেতে। এসময় আচমকা কেন চায়ের তেষ্টা পেল তার, কে জানে!

তবে একই সঙ্গে একই ধরনের কাজ প্রায়ই ঘটে পৃথিবীতে। ইয়েলোক্যাবে বসে মনজুর যখন চায়ের তেষ্টা পাচ্ছে পারু তখন এককাপ চা নিয়ে বারান্দায় এসেছেন।

বারান্দায় উদাস হয়ে বসে আছে সুমি। চা হাতে পারু তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। নে।

সুমি খুবই অবাক হলো। হঠাৎ চা?

এ সময় মাঝে মাঝে চা খেতেন তোর বাবা। আমার হাতের চা। আজ মনে হলো ওরকম এককাপ চা আমি তোর জন্য করি।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সুমি বলল, নিজের জন্য করলেও পারতে।

তারপর চায়ে চুমুক দিল। চুমুক দিয়ে বলল, মা, ভেবে দেখলাম টেলিফোনটা বিক্রি করে ফেলাই ভাল।

পারু চুপ করে রইলেন।

সুমি আবার চায়ে চুমুক দিল। হাজার তিরিশেক টাকা পেলে কয়েকটা মাস মোটামুটি চলা যাবে।

পারু গম্ভীর গলায় বললেন, টেলিফোন আমি বিক্রি করে ফেলেছি।

সুমি চমকালো। কী?

হ্যাঁ। তিরিশ হাজারই দাম।

কার কাছে বিক্রি করলে?

ওই তো পাশের বাড়ির ওদের কাছে। তোকে বলেছিলাম না।

সুমি একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, টাকা দেবে কবে?

দিন দশেক পর। টাকা দিয়ে তারপর ফোন নেবে।

পারু আর দাঁড়ালেন না।

চায়ের কাপ হাতে সুমি তখন কী রকম স্তব্ধ হয়ে আছে।

.

০৭.

হোয়াইট হাউস হোটেলের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে মনজু বলল, প্রথমে ক্যাব থেকে, আই মিন ইয়েলোক্যাব থেকে আমার লাগেজ আনতে বলুন।

রিসেপসনিস্ট সঙ্গে সঙ্গে একজন বেয়ারাকে ডাকল। মনজুর লাগেজ আনতে বলল।

মনজু বলল, এখন রুম।

রিসেপসনিস্ট বিনীত গলায় বলল, আপনি একা, স্যার?

হ্যাঁ একা। কিন্তু রুম লাগবে ডাবল বেডের।

জ্বী?

জ্বী। তবে দুজন শোয়ার এক বিছানা নয়। সিঙ্গেল দুটো বেড। মাঝখানে স্পেস থাকতে হবে।

রিসেপসনিস্ট চোখ তুলে তাকাল।

মনজু হাসল। একা থাকব কিন্তু বিছানা দরকার দুটো।

ওকে স্যার।

আপনি কি অন্যকিছু ভাবছেন?

নো স্যার। নো।

আসলে এক বিছানায় থাকতে আমার খুব বোর লাগে। রাতের। অর্ধেকটা এক বিছানায়, বাকি অর্ধেকটা আরেক বিছানায়।

বলেই কেলানো একটা হাসি হাসল মনজু। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

রিসেপসনিস্ট হাসল। নো প্রবলেম স্যার। ওরকম রুম আমাদের আছে।

তাহলে আর দেরি কেন? দিয়ে ফেলুন একটা।

এসি রুম, না ননএসি?

অফকোর্স এসি। নিউইয়র্কের কুইন্সে থাকি। গরমের সময় বেজায় গরম, আর শীতের সময় …।

রিসেপসনিস্ট যুবকটা একটু বেশি স্মার্ট। মনজুর কথা শেষ হওয়ার আগেই তার মুখের কথা যেন কেড়ে নিল। বেজায় শীত।

মনজু বলল, নো নো। ডিরেক্ট বরফ।

ও।

শুনুন, রুমটা আমার অনেকদিনের জন্য লাগবে। অর্থাৎ বাংলাদেশে যতদিন থাকব।

তারপর আচমকা বলল, আপনি অংক কেমন জানেন?

রিসেপসনিস্ট ভড়কে গেল। জ্বী?

আড়াইমাসে কতদিন হয় বলুন তো?

রিসেপসনিস্ট ক্যালকুলেটর বের করতে যাবে, মনজু বলল, এত কষ্টের দরকার নেই। আমিই বলছি। পঁচাত্তর দিন। সেভেনটি ফাঁইভ ডেইজ। আপনাদের হোয়াইট হাউজ আমার পছন্দ হয়েছে। আমার যা পছন্দ হয়, আমি তার শেষ পর্যন্ত দেখি।

আবার সেই কেলানো হাসি হাসল মনজু। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মনজু তারপর রুমে এল। রুমে এসে টের পেল তার খুবই ক্লান্ত লাগছে এবং খুবই খিদে পেয়েছে। ক্লান্তি কাটাবার জন্য এখন হেভি একটা গোসল দরকার। গোসলের পর সম্পূর্ণ বাঙালি ভুঁড়িভোজ। তারপর ঘুম। কাল সকালে ফ্রেস মানুষ মনজু।

তাহলে মনজুর এখন কী করা উচিত? প্রথমে গোসল নাকি খাবারের অর্ডার?

খাবারের অর্ডারই আগে দেয়া উচিত। অর্ডার দিয়ে বাথরুমে ঢুকবে। বেরিয়ে আসতে আসতে খাবারও এসে যাবে।

গুড আইডিয়া।

মনজু টেলিফোন তুলল। কে ফোন ধরল না ধরল ভাবলই না। বলল, সুটকিভর্তা হবে?

যে ফোন ধরেছিল সে একটু ভড়কে গেল। জ্বী?

এত অবাক হচ্ছেন কেন? সুটকিভর্তা লোকে খায় না? লইট্টা মাছের সুটকি, ঘইনা মাছের সুটকি, চ্যাপা শুঁটকি।

ওপাশের লোকটি বলল, আপনি স্যার কোথায় ফোন করেছেন?

মনজু একটু থমকাল। এটা কি হোয়াইট হাউজ হোটেলের কিচেন?

জ্বী।

তাহলে তো ভুল জায়গায় ফোন করিনি।

কিন্তু আমি আপনার কথা স্যার বুঝতে পারিনি। কী সব চ্যাপা ফ্যাপা বলছেন। আমি তো এই ধরনের নামই কখনও শুনিনি।

কী? নাম শোনেননি? আপনি কি ভাই আজারবাইজানে থাকেন, না বাংলাদেশে?

লোকটি গম্ভীর গলায় বলল, বাংলাদেশেই থাকি।

মনজু সঙ্গে সঙ্গে বলল, আর আমার জন্য আমেরিকায়। এই প্রথম বাংলাদেশে এসেছি। তারপরও মিনিমাম তিন প্রকারের সুটকির নাম জানি।

এবার লোকটা যেন একটু লজ্জা পেল। জ্বী স্যার, জ্বী।

মনজু গম্ভীর গলায় বলল, এই হোটেলে সুটকি সার্ভ করে না?

না।

ও। এত লাটবেলাটের হোটেলে তো আমি তাহলে থাকব না। বাংলাদেশে এসেছি, বাঙালি খাবার যখন যা ইচ্ছে খাব। না পেলে অন্য জায়গায় চলে যাব। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

একটু থামল মনজু। রিসেপসনে ফোন করে বিল পাঠাতে বলুন আর সোনারগাঁও হোটেলে সিঙ্গেল দুটো বেডের একটা রুম বুক করতে বলুন। আপনাদের এখানে আমি থাকব না। এক্ষুনি চলে যাব।

ও পাশের লোকটি বলল, আপনি স্যার রাগ করবেন না।

জ্বী?

আইয়্যাম সরি স্যার।

হ্যাঁ, অত্যন্ত বিনীতভাবে বলুন, সরি স্যার। বলেছেন? ওকে। সুটকি এরেঞ্জ করুন।

বলে বেশ শব্দ করে ফোন নামিয়ে রাখল মনজু।

.

০৮.

রাতেরবেলা পারুর হঠাৎ মনে হলো বাড়ির দলিলপত্রগুলো একটু বের করা দরকার। কী জানি কখন কোন প্রয়োজন হয়! জরুরি কাগজপত্র হাতের কাছে রাখা ভাল।

অবশ্য সবকিছু হাতের কাছেই রেখেছেন মাসুদ সাহেব। এইসব ব্যাপারে তিনি খুবই গোছালো স্বভাবের ছিলেন। টেলিফোন বিলের আলাদা ফাঁইল, সিটি করপোরেশানের ট্যাক্সের আলাদা ফাঁইল। গ্যাস পানি ইলেকট্রিসিটি এসবের আলাদা আলাদা ফাঁইল। সুমি অমি পারু এবং নিজের জন্যও আলাদা ফাঁইল ছিল, ফাঁইলের ওপর নাম এবং বিষয় লেখা। যার যত প্রেসক্রিপশান আছে, রক্ত মল মূত্র ইত্যাদি যতবার পরীক্ষা করা হয়েছে, সে সবের প্রতিটি রিপোর্ট অত্যন্ত যত্নে ফাঁইল করা। এমন কি এই বাড়ি তৈরি করার সময় প্রতিদিন কোন খাতে কত খরচ হয়েছে, কী কী কেনা হয়েছে, ক্যাসমেমোসহ সব ফাঁইল করে রেখেছেন তিনি। বইয়ের দোকানের ব্যাপারেও ছিল একই ব্যবস্থা।

কিন্তু বাড়ির দলিল পরচার ফাঁইলটা পেলেন না পারু।

ফাইলগুলো রাখা আছে তাদের বেডরুমের একমাত্র আলমারিতে। একে একে সব ফাঁইল নামালেন পারু। একটা একটা করে ঘাঁটলেন কিন্তু দলিলের ফাঁইলটা নেই।

পারু একেবারে দিশেহারা হয়ে গেলেন।

কোথায় গেল ফাঁইলটা?

এই আলমারি ছাড়া অন্যকোথাও থাকার কথা নয়। সাধারণত মাসুদ সাহেবই হাতাহাতি করতেন ফাঁইলপত্র। প্রয়োজনে বের করে, কাজ সেরে আবার জায়গামতো রেখে দিতেন। এসব ফাঁইল অন্যকোথাও যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

তাহলে?

তারপর ঘরের ভেতর সম্ভাব্য যত জায়গা আছে খুঁজলেন পারু।

না নেই।

ফাইলটা কোথাও নেই।

পারু খুবই অস্থির হয়ে পড়লেন। আবার নামালেন ফাঁইলের স্থূপ, আবার ঘটতে লাগলেন।

এই বাড়িতে রাতের খাবার আটটার দিকে খাওয়ার নিয়ম। নিয়মটা মাসুদ সাহেব চালু করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরও নিয়মটা চালু আছে। আটটা বাজলেই টেবিলে খাবার এনে রাখে বুয়া। সুমি অমি এসে বসে। সবার শেষে আসতেন মাসুদ সাহেব এবং পারু। মাসুদ সাহেব নেই, এখন পারু আসেন সবার শেষে।

কিন্তু আজ প্রায় সোয়া আটটা বেজে গেল, তিনি আসছেন না।

সুমি অমি দুজনেই অবাক হলো।

অমি বলল, আমরা বসে আছি কিন্তু মা আসছে না! ব্যাপার কী? কী করছে?

ডালের পেয়ালা রাখতে রাখতে শিরিন বুয়া বলল, কী জানি খুঁজতাছে।

সুমি একটু চিন্তিত হলো। কী খুঁজছে?

তা জানি না।

অমি উঠে দাঁড়াল। আমি যাই, মাকে ডেকে আনি।

সুমিও উঠল। আমিও যাই, দেখি কী খুঁজছে।

বুয়া বলল, ভাত তরকারি তো ঠাণ্ডা হইব।

সুমি বলল, ঢেকে রাখ।

দুভাইবোন তারপর পারুর রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে দুজনেই থতমত খেয়ে গেল।

খুবই বিধ্বস্ত ভঙ্গিতে মেঝেতে বসে আছেন পারু, তার চারদিকে ছড়ানো ছিটানো ফাঁইলপত্র।

সুমি বলল, এই অবস্থা কেন? কী হয়েছে?

পারু হতাশ গলায় বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে।

অমি বলল, মানে?

বাড়ির দলিলপত্র কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না।

শুনে আঁতকে উঠল সুমি। বল কী?

হ্যাঁ।

কোথায় ছিল?

তোর বাবা নিজ হাতে সব ফাঁইল করে রেখেছিলেন। মানে একটা ফাঁইলে সব গুছানো ছিল। ফাঁইলটাই পাচ্ছি না।

অমি বলল, ভাল করে খুঁজেছ?

পারু একটু রেগে গেলেন। ভাল করে মানে? এরচে’ ভাল করে আর কী খুঁজব! কোনও জায়গা বাকি রাখিনি। তাছাড়া ফাঁইলগুলো থাকে সব এক জায়গায়। আমার আলমারিতে।

সুমি গম্ভীর গলায় বলল, লাস্ট কবে ফাঁইলটা তুমি দেখেছ?

তা বলতে পারব না। আর আমি তো কখনও ওই ফাঁইল ধরিওনি। তোর বাবা রেখেছিলেন। তবে একদিন ফাঁইল খুলে দলিলপত্র আমাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

অমি বলল, কবে?

অনেকদিন আগে।

সুমি বলল, তারপর ফাঁইলটা তুমি আর দেখনি?

না।

আছে কি নেই, বোঝনি?

না।

রুমে ঢুকে ধপ করে পারুর বিছানায় বসে পড়ল অমি। এখন কী হবে?

দলিলপত্র না পেলে খুব বিপদ হবে। কাগজপত্র ছাড়া বাড়ির কোনও দাম নেই।

সুমি বলল, কিন্তু দলিলপত্র হারালে সেগুলো জোগাড়েরও নিশ্চয় কোনও ব্যবস্থা আছে।

আছে।

তাহলে এত ঘাবড়াবার দরকার কী?

কিন্তু সে সব অনেক ছুটোছুটির ব্যাপার। অনেক টাকা পয়সা খরচের ব্যাপার। আমরা ওসব কেমন করে করব? কে আছে আমাদের? কে সাহায্য করবে?

একটু থামলেন পারু। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, সংসার কীভাবে চলবে তারই ঠিক নেই, তার ওপর এই বিপদ। আমার খুব অস্থির লাগছে।

সুমি এসে পারুর সামনে দাঁড়াল। এখন অস্থির হয়ে লাভ নেই। দলিলের ফাঁইল যাবে কোথায়? নিশ্চয় বাড়িতে আছে। বেশি অস্থির হয়ে খোজাখোজি করলে অনেক সময়ই প্রয়োজনীয় জিনিসটা পাওয়া যায় না। চল, খেতে চল। খেয়েদেয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ঘুমাবে। সকালে উঠে আবার খুঁজবে। আমি এবং অমিও তোমার সঙ্গে থাকব, দেখবে ঠিক পেয়ে যাবে।

মেয়ের কথায় ভরসা পেলেন পারু। বললেন, তুই বলছিস?

হ্যাঁ।

বলেই পারুর হাত ধরল সুমি। চল।

পারু উঠে দাঁড়ালেন।

কিন্তু পরদিন সকালেও ফাঁইলটা পাওয়া গেল না। তিনজন মানুষ তন্ন। তন্ন করে পুরো বাড়ি খুঁজল, এমন কি বুয়াও খুঁজল তাদের সঙ্গে।

না, ফাঁইলটি কোথাও নেই।

শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে নিজের বিছানায় বসলেন পারু। হাহাকারের গলায় বললেন, কোন বিপদ এলো আমার সংসারে? মানুষটা চলে গেল। সংসার অচল। এই অবস্থায় হারাল বাড়ির দলিল।

সুমি অমি দুজন দাঁড়িয়ে আছে পারুর দুপাশে। তাদের অবস্থাও পারুর মতোই।

তবু মেয়ের দিকে তাকালেন পারু। সুমি, আমি তো চোখে কোনও পথ দেখছি না মা! তুই বলেছিলি দলিল নিশ্চয় পাওয়া যাবে। তোর ভরসায় রাতে ঘুমাতেও পারলাম। কিন্তু …….।

পারুর কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমি বলল, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না মা। আমাদের বাড়ি থেকে কখনও কিছু হারায়নি। এত ইম্পরটেন্ট জিনিস কী করে হারাবে?

আমি পাগল হয়ে যাব মা। আমার খুব অস্থির লাগছে। আমি আর পারছি না।

পারুর পাশে বসে দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরল সুমি। তুমি এভাবে ভেঙে পড়ো না। বস। তোমার সঙ্গে অন্যকিছু কথা আছে আমার।

তারপর অমির দিকে তাকাল সুমি। অমি, যা তোর রুমে যা। পড়তে বোস গিয়ে। আমি আর মা দেখছি কী করা যায়।

অমি চলে যাওয়ার পর দরজার সামনে দাঁড়ানো বুয়ার দিকে তাকাল সুমি। বুয়া, তুমিও যাও।

আইচ্ছা।

বুয়া চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুমি বলল, মা, বাড়ির দলিল বাবা অন্য কোথাও নিয়ে রেখে আসেনি তো?

কথাটা শুনে পারু যেন কেঁপে উঠলেন। অন্য কোথায় রেখে আসবে?

কোনও ব্যাংকে কিংবা কারও কাছে? মানে বাড়ির দলিল রেখে বাবা কারও কাছ থেকে টাকা পয়সা আনেনি তো?

পারু দৃঢ় গলায় বললেন, না, প্রশ্নই ওঠে না। আমাকে না জানিয়ে তিনি কোনওদিন কিছু করেননি। অমন হলে অবশ্যই তিনি আমাকে বলতেন। আমি জানতাম।

কিন্তু বছরখানেক আগে বইয়ের দোকানটা যখন ছেড়ে দিলেন বাবা, বাবার কিছু লায়াবেলিটিস ছিল। কিছু ধারদেনা ছিল। তার আগে হুট করে

অমিকে কম্পিউটার কিনে দিল, তারও আগে টেলিফোন আনল!

এসবের জন্য তাকে বাড়ির দলিল রেখে টাকা আনতে হবে কেন? বইয়ের দোকানটা তো ভালই চলতো। ভালই রোজগার করতেন তিনি।

আমার মনে হয় না।

মানে?

দোকান উঠে যাওয়ার পরও প্রায়ই কোত্থেকে যেন কিছু কিছু টাকা আনতেন বাবা।

আরে ওসব তো কাজের টাকা।

কী কাজ?

মানে রোজগারের টাকা আর কী?

তখন কী রোজগার ছিল বাবার?

বাংলাবাজারের পাবলিসারদের সঙ্গে কী কী কাজ করতেন।

সেটা খুবই সামান্য কাজ। প্রুফ দেখা।

প্রুফ দেখে টাকা তো পেতেন।

অতি সামান্য টাকা। কিন্তু আমার যতদূর মনে পড়ে, বাবা টাকা আনতেন বেশ ভালই।

একটু থামল সুমি। তারপর বলল, মা, তুমি কি বাবাকে কখনও জিজ্ঞেস করেছ তার রোজগারটা কী? কোত্থেকে টাকা পয়সা পায় সে?

না।

কেন?

আমি জানতাম কোনও অসৎ কাজ তিনি কখনও করবেন না। আর পুরুষ মানুষদের রোজগার নিয়ে মহিলাদের তেমন না ভাবাই ভাল।

সুমি মাথা নাড়ল। না। কথাটা বোধহয় ঠিক না। যাই হোক, দলিল যে বাড়িতে নেই তা আমি বুঝে গেছি। কোথায় আছে, কার কাছে আছে, খুঁজে বের করতে হবে।

.

০৯.

আজকের দিনটা আমি শুধু ঢাকা শহরে ঘুরব।

মনজুর কথা শুনে হোটেল রিসেপসনিস্ট চোখ তুলে তাকালো। কালকের রিসেপসনিস্টদের একজনও এখন নেই। শিফট ভাগ করা কাজ। এখনকার শিফটে অন্য রিসেপসনিস্ট।

খানিক আগে নিজের রুম থেকে বেরিয়েছে মনজু। সকালবেলা গোসল করে ফ্রেস হয়েছে। তারপর সুন্দর একটা জিনসের প্যান্ট পরেছে, ঘিরঙের টিশার্ট পরেছে। পায়ে বুট, চোখে সানগ্লাস। মনজুকে দেখতে হলিউডের নায়কদের মতো লাগছে।

সে আজ শুধু ঢাকা শহরে ঘুরবে শুনে রিসেপসনিস্ট হাসি মুখে বলল, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ, স্যার?

প্রথমে একটাই কাজ করবেন, আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলবেন।

ওকে স্যার।

বলুন ঠিক আছে।

ঠিক আছে।

এবার আপনাদের হোটেলের একটা কার্ড দিন।

রিসেপসনিস্ট সঙ্গে সঙ্গে কার্ড দিল।

কার্ডটা কেন নিলাম জানেন?

না স্যার। যদি হারিয়ে যাই, কার্ডে লেখা এডড্রেস দেখে ফিরে আসব।

জ্বী স্যার।

আচ্ছা গেন্ডারিয়া এলাকাটা কোথায় বলুন তো?

পুরনো ঢাকায়।

তা আমি জানি। না না আজ যাব না। হয়তো কাল কিংবা পরশু যাব। যাওয়ার ব্যবস্থাটা কী বলুন তো?

রিকশা কিংবা বেবিট্যাক্সি।

বেবিট্যাক্সি মানে অটোরিকশা?

জ্বী স্যার।

ইয়েলোক্যাব যাবে না?

সাধারণত পুরনো ঢাকার দিকে যেতে চায় না। আপনি অবশ্য আর একটা কাজ করতে পারেন।

কী?

রেন্টেকার নিতে পারেন।

আপনারা ব্যবস্থা করে দেবেন?

অবশ্যই।

আর যদি হেঁটে যাই?

রিসেপসনিস্ট হাসল। দূর হবে।

কতদূর?

তা একজাক্টলি বলতে পারব না।

বিশ কিলোমিটার?

না না এত হবে না। এখান থেকে পাঁচ সাত কিলোমিটার হবে।

এ এমন কিছু না। আমার ইচ্ছে হলে আমি হেঁটে চলে যেতে পারি। আবার একটা মার্সিডিজ নিয়েও যেতে পারি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

বলে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে হাসল মনজু। শুনুন।

রিসেপসনিস্ট ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, জ্বী স্যার।

আপনাদের কিচেনে বলে রাখবেন, বাংলাদেশের নানা রকমের টুকটাক টুকটাক খাবার যখন তখন আমি চাইতে পারি। যেমন করে হোক সেগুলোর ব্যবস্থা যেন করে দেয়।

জ্বী স্যার।

আমি কিন্তু না শুনে অভ্যস্ত নই। এবং টাকা পয়সার ব্যাপারে একদমই ভাবি না।

কিন্তু কী ধরনের আইটেম আপনি চাইতে পারেন?

এক মুহূর্তও ভাবল না মনজু। বলল, এই ধরুন বইচা মাছের চচ্চড়ি।

রিসেপসনিস্ট বেশ অবাক হলো। বইচা মাছটা কী স্যার?

মনজু মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। আপনি বাংলাদেশি না?

জ্বী, অবশ্যই।

বইচা মাছ চেনেন না?

না স্যার।

চেনা উচিত ছিল।

মাছটা বোধহয় কমন নয়।

তা ঠিক। আনকমন মাছ।

দেখতে কেমন?

খলিসা মাছ চেনেন?

জ্বী তা চিনি স্যার। তবে খলিসা খুব রেয়ার হয়ে গেছে। আজকাল তেমন পাওয়া যায় না।

তাই নাকি?

জ্বী স্যার।

এটা খুবই দুঃখের কথা। এইসব মাছ বাংলার ঐতিহ্য। হারিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। যাহোক, খলিসার বাচ্চা সংস্করণ হচ্ছে বইচা। অথবা বইচা আলাদা একটা প্রজাতিও হতে পারে।

মনজু আর দাঁড়াল না। লবির দিকে পা বাড়াল।

নিজের কাজে ব্যস্ত হতে হতে রিসেপসনিস্ট আপনমনে বলল, হোটেলে কাজ করলে কত রকমের পাগল যে দেখতে হয়!

কথাটা শুনে ফেলল মনজু। সে আবার ফিরে এলো।

মনজুকে ফিরতে দেখে রিসেপসনিস্ট নার্ভাস হয়ে গেল। গোপনে সে একটা ঢোক গিলল।

মনজু নির্মল মুখ করে হাসল। পাগল নই, প্রেমিক। দেশপ্রেমিক।

স্যার!

নার্ভাস হবেন না। আমি আপনাকে কিছু বলব না। লোকের পেছনে কথা বলা বাঙালিদের একটা ত্রুটি। আমি নিজে যেহেতু একশো ভাগ। বাঙালি সেহেতু এই ত্রুটিটাকে আমি ত্রুটি মনে করছি না। বরং ত্রুটিটাকেও আমি পছন্দ করি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

মনজু আর দাঁড়াল না।

.

১০.

বারান্দার লাইটটা আজ কেন যে জ্বালেননি পারু!

অন্ধকার বারান্দায় চুপচাপ বসে আছেন। সুমি যাচ্ছিল মায়ের রুমের দিকে। বারান্দাটা অন্ধকার দেখে সুইচ টিপে লাইট জ্বাললো। জ্বেলেই চমকে উঠল। এ কি? তুমি এখানে অন্ধকারে বসে আছ কেন?

পারু উদাস গলায় বললেন, এমনি।

এই বারান্দায় দুতিনটি ভাঙাচোরা বেতের চেয়ার আছে। একটায় বসে আছেন পারু, তার পাশের চেয়ারটায় বসল সুমি। তোমার মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু ওসব নিয়ে এখন আর কথা বলে লাভ নেই। আমার এক বান্ধবীর বাবা আছেন উকিল। দলিলপত্র হারিয়ে গেলে কী করতে হয় তাঁর সঙ্গে আলাপ করে আমি জেনে নেব।

পারু কথা বললেন না।

সুমি বলল, আমি তোমাকে অন্য একটা কথা জিজ্ঞেস করি।

কী কথা?

তুমি হঠাৎ বাড়ির দলিল খুঁজতে শুরু করেছিলে কেন?

পারু গম্ভীর গলায় বললেন, বাড়ি বিক্রি করে ফেলব।

সুমি যেন আকাশ থেকে পড়ল। কী?

হ্যাঁ। এছাড়া বাঁচার উপায় নেই। গেন্ডারিয়ার সবচাইতে কমদামী এলাকায় দেড়কাঠার ওপর এই বাড়ি। আট ন’লাখ টাকার বেশি বিক্রি করা যাবে না। এই টাকা থেকে তোর বিয়ে দেব।

তারপর?

বাকি টাকা ব্যাংকে রাখব। পারিবারিক সঞ্চয়পত্র আছে, সেটা কিনব। তাতে যা ইন্টারেস্ট আসবে, আমার আর অমির চলে যাবে।

তোমরা থাকবে কোথায়? বাসা ভাড়া নেব।

কী?

হ্যাঁ। দেড় দুহাজার টাকায় ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নেব। তাছাড়া অমি টিউশনি করবে। কিছু টাকা সেও রোজগার করবে। অমির পড়াশুনো শেষ হলে আমার আর চিন্তা কী? অমি চাকরি বাকরি করবে, দিন চলে যাবে।

পারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

মায়ের দীর্ঘশ্বাসটা যেন বুকে এসে লাগল সুমির। মন খারাপ করা গলায় বলল, তারচে’ আমার বিয়ের চিন্তাটা যদি বাদ দাও।

চমকে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন পারু। মানে?

এই অবস্থায় বিয়ের চিন্তা বাদ দেয়াই ভাল মা। আমি এমএ পরীক্ষা দিয়েছি, কিছুদিনের মধ্যেই রেজাল্ট বেরুবে। চেষ্টা করলে ভাল একটা চাকরিও পাব। আমি একা চাকরি করে তোমাদের দুজনকে নিয়ে ভালই চলতে পারব। তারপর অমি যখন দাঁড়িয়ে যাবে তখন না হয়….।

সুমির কথা শেষ হওয়ার আগেই পারু বললেন, তখন আর বিয়ের বয়স থাকবে না।

না থাক।

ভাল পাত্রও পাওয়া যাবে না।

না যাক।

না না এসব কোনও কথা নয়। সেলিমের সঙ্গে সব ঠিকঠাক হয়ে আছে। তোর বাবাই করে গেছেন সব।

তাতে কী?

না না এ হবে না।

কেন হবে না মা?

নিজেদের সুবিধার জন্য তোর জীবন আমি নষ্ট করতে পারব না।

তোমাদের জীবন নষ্ট করে আমার জীবন ভাল করবার দরকার কী?

এসব কথা বাদ দে। সেলিমের সঙ্গে বিয়ে তোর ডেট মতোই হবে। আমি যা প্লান করেছি তাই করব।

সুমি কাতর গলায় বলল, এটা ঠিক হবে না মা।

পারু দৃঢ় গলায় বললেন, অবশ্যই ঠিক হবে। তুই ওই উকিল সাহেবের সঙ্গে কথা বলে দলিলের কপি তোলার চেষ্টা কর।

ওসবের জন্য তো টাকা লাগবে মা।

টাকা দেয়া যাবে।

কোত্থেকে?

টেলিফোন বিক্রির টাকা থেকে।

পারু টেলিফোন শব্দটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে ডাইনিংস্পেসের সামনে রাখা টেলিফোনটা বেজে উঠল।

একবার।

দুবার।

পারু উঠছেন না দেখে সুমি গিয়ে ফোন ধরল। হ্যালো, স্লামালেকুম।

ওপাশ থেকে ভারি ধরনের পুরুষকণ্ঠ ভেসে এল। ওয়ালাইকুম সালাম। সালামের ভঙ্গিতেই বুঝেছি তুমি মাসুদ সাহেবের মেয়ে। ভাল  আছ মা?

ভদ্রলোকের কথা বলার ধরন অমায়িক। ভাল লাগল সুমির। বলল, জ্বী আছি। কিন্তু আপনাকে ঠিক….।

আমাকে তোমার চেনার কথা না মা। আমার নাম মকবুল। জায়গা জমি বাড়িঘর এসব কেনা বেচার বিজনেস করি। তোমার বাবার সঙ্গে খুবই চেনা জানা ছিল কিন্তু যাওয়া আসাটা তেমন ছিল না।

জায়গা জমি কেনাবেচা কথাটা শুনেই বুকটা ধ্বক করে উঠেছে সুমির। কিছু একটা বলতে যাবে সে তার আগেই মকবুল সাহেব বললেন, তোমার বাবা মারা গেছেন জানি। কয়েকদিন ধরেই ভাবছি ফোন করব। তারপরে ভাবলাম, থাক, কয়েকদিন পরেই করি। শোকটা তোমরা একটু সামলে ওঠ। এখন তোমাদের মনের অবস্থা কেমন মা?

সুমি বলল, এই আর কী! সবাই মিলে সামলে ওঠার চেষ্টা করছি।

তাহলে তো মা কাজের কথাটা আমি বলতে পারি।

জ্বী বলুন।

তোমরা কি মা জানো যে তোমার বাবা বাড়ির দলিল রেখে গত দেড় বছরে আমার কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে লাখ তিনেক টাকা নিয়েছেন?

শুনে সুমি একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। না, না তো!

হ্যাঁ মা। প্রতিলাখে মাসে চারহাজার টাকা ইন্টারেস্ট। সবমিলে অংকটা মা প্রায় সাড়ে চারলাখে দাঁড়িয়েছে।

সুমি কোনও রকমে বলল, ও।

মকবুল সাহেব বললেন, তিনি আমাকে রিকোয়েস্ট করেছিলেন তোমাদেরকে আমি যেন এসব না জানাই।

বুঝলাম। কিন্তু টাকা তিনি কীভাবে শোধ করবেন বলেননি?

তাতো বলেছেনই।

কীভাবে?

বাড়ি বিক্রি করে।

জ্বী?

হ্যাঁ মা।

কিন্তু বাড়ি বিক্রির কথা বাবার মুখে কখনও শুনিনি।

তাই নাকি?

জ্বী। কখনও ভাবতেও দেখিনি।

আমাকে অবশ্য বলেছিলেন আমিই যেন বাড়িটা নিয়ে নেই। বাজারে যে হিসেবে দাম আছে সেই দামে নিয়ে, নিজের টাকাটা কেটে রেখে বাকি টাকা দিয়ে দেব। আমি মা এখনও সেই শর্তে রাজি আছি। তুমি একটা কাজ কর মা, তোমার মাকে নিয়ে যে কোনওদিন আমার এখানে আস। কীভাবে কী করা যায় আমরা আলোচনা করি।

জ্বী আচ্ছা।

তাহলে আজ রাখি মা।

সুমি মৃতের গলায় বলল, জ্বী আচ্ছা।

মকবুল সাহেব ফোন নামিয়ে রাখলেন। কিন্তু সুমি তখনও ফোন ধরে রেখেছে। সে যেন এখন আর মানুষ নয়, সে যেন এখন এক পাথর।

এদিকে মেয়েকে এতক্ষণ ধরে ফোনে কথা বলতে দেখে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন পারু। সুমির কথায় ব্যাপারটা তিনি আঁচ করেছেন। এখন তাকে ফোন ধরে পাথর হয়ে থাকতে দেখে ভাঙাচোরা গলায় বললেন, ফোন ধরে দাঁড়িয়ে কী লাভ? নামিয়ে রাখ।

সুমি অসহায় ভঙ্গিতে ফোন নামিয়ে রাখল।

পারু বললেন, যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। কিন্তু দুঃখ একটাই, আমার কাছে কেন তিনি এসব লুকিয়ে গেছেন? আর এতগুলো টাকা এনেই বা কী করেছেন?

সুমি আগের মতোই অসহায় গলায় বলল, তুমি যেটাকে বাবার রোজগার মনে করেছিলে ওটা রোজগার ছিল না মা। ইন্টারেস্টে টাকা এনে সংসার চালিয়েছেন বাবা। টেলিফোন, কম্পিউটার সব ওই টাকার। বইয়ের দোকানে লস হয়েছিল। সব ওই টাকা থেকে ম্যানেজ করেছেন।

কোন ফাঁকে চোখ ভেঙে কান্না নেমেছে পারুর। চোখ মুছতে মুছতে তিনি বললেন, আজ মনে হচ্ছে তিনি একা মারা যাননি, আমাদেরকেও

মেরে রেখে গেছেন।

পারু আর দাঁড়ালেন না। চোখ মুছতে মুছতে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন।

সুমি তখন একেবারে স্তব্ধ হয়ে আছে।

.

১১.

বেচারাম দেউড়ির গলির ভেতর মকবুল সাহেবের পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। এই বাড়ির নীচতলার একটি রুমে তাঁর অফিস।

অফিস মানে নিজের বসার জন্য চেয়ার টেবিল, লোকজনের জন্য টেবিলের সামনে তিনটে হাতছাড়া চেয়ার আর একসেট গাবদা গোবদা সোফা। আদ্যিকালের কালো ভারি ধরনের একটা টেলিফোন সেট আছে টেবিলের ওপর। আজকাল এরকম টেলিফোন সেট আর দেখা যায় না।

মকবুল সাহেবের টেবিলের সামনে বসে এই টেলিফোন সেটের দিকে তাকিয়ে আছে সুমি। সকালবেলাই এই অফিসে চলে এসেছে সে।

মকবুল সাহেব বললেন, এক কাপ চা খাও মা?

সুমি বলল, জ্বী না, এখন খাব না।

আমারই অবশ্য ভুল হলো।

সুমি চোখ তুলে তাকাল।

মকবুল সাহেব বললেন, জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল তুমি নাশতা করেছ। কী না! তা না জিজ্ঞেস করে চায়ের কথা বললাম।

সুমি মাথা নীচু করল। আমি নাশতা করে বেরিয়েছি।

তাহলে খাও এক কাপ চা।

না। নাশতার সঙ্গে চাও খেয়েছি। বেশি চা খাওয়ার অভ্যেস আমার নেই।

মকবুল সাহেব ভদ্রলোক বেশ অমায়িক ধরনের। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা, মুখে কাঁচাপাকা বেশ ঘনদাড়ি। তবে দাড়ি তেমন লম্বা নয়। মাঝারি মতো, সুন্দর করে ছাটা। মাথায় সাদা একখানা টুপি আছে। মুখটা মায়াবি ধরনের।

এই মুখ আরও মায়াবি করে তিনি বললেন, আমি বুঝেছিলাম তোমার মা আসবেন না। তিনি নিশ্চয় খুব দুঃখ পেয়েছেন।

সুমি উদাস গলায় বলল, জ্বী।

মকবুল সাহেব কথা বললেন না। ড্রয়ার থেকে একটা ফাঁইল আর লম্বা ধরনের মোটা একটা খাতা বের করলেন। ফাঁইলটা সুমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই তোমাদের দলিলের ফাঁইল।

ফাঁইলটা ধরল না সুমি। মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে দেখল। ফাঁইলের ওপর বাবার হাতের লেখাটা ফুটে আছে। দেখে সুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

সেই দীর্ঘশ্বাস টের পেলেন না মকবুল সাহেব। লম্বা মোটা খাতাটা খুলে পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলেন। তারপর একটা পৃষ্ঠায় এসে থামলেন। খাতাটা সুমির দিকে এগিয়ে দিলেন। আর এই যে দেখ তোমার বাবা সই করে টাকা নিয়েছেন।

অপলক চোখে বাবার সই করা পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে রইল সুমি। তারপর আগের মতোই উদাস গলায় বলল, আপনি যে মিথ্যে বলেননি তা আমি জানি।

না না মিথ্যে বলব কেন? মিথ্যে বলা, ছল চাতুরি এসব আমি কোনওদিন করিনি, করবও না। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। তোমাদের ওইটুকু সম্পত্তির জন্য মিথ্যে বলার কোনও দরকার আমার নেই।

জ্বী তাতো বটেই।

তবে মা, আমি ব্যবসায়ি মানুষ। টাকা খাঁটিয়ে টাকা রোজগার করি। এক্ষেত্রে আমার কোনও কম্প্রোমাইজ নেই।

অপলক চোখে মকবুল সাহেবের মুখের দিকে তাকাল সুমি। আমরা তাহলে কী করব এখন?

কী করবে মা, তা আমি কী করে বলব!

না মানে আপনার সাজেসান চাচ্ছি। আমাদের অবস্থা তো আপনি জানেনই, এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত আমাদের?

বলব?

জ্বী বলুন।

আমার কথা আবার অন্যভাবে নেবে না তো?

না না, প্রশ্নই ওঠে না।

বুদ্ধিমানের কাজ হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার টাকাটা শোধ করে দেয়া। নয়তো যতদিন যাবে ইন্টারেস্ট বাড়বে, এবং চক্রবৃদ্ধি হারে। তাতে তোমাদের আরও ক্ষতি হবে। তুমি কী মা চক্রবৃদ্ধি হার জিনিসটা বোঝ?

জ্বী বুঝি।

তাহলে তো তোমাকে আর বোঝাবার কিছু নেই।

জ্বী।

তবে মা, এক্ষেত্রে একটা হেলপ অবশ্য তোমাদেরকে আমি করতে পারি।

বাড়িটা আপনিই নিয়ে নেবেন। আপনার টাকা এডজাস্ট করে বাকিটা আমাদেরকে …..।

কারেক্ট। বাহ তুমি তো খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে। বলবার আগেই সব বুঝে যাও। হ্যাঁ, এটা করাই তোমাদের জন্য সব চাইতে ভাল হবে।

আমি তাহলে আমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করি।

অবশ্যই অবশ্যই। তবে যাই কর, তাড়াতাড়ি করো। কারণ যতদিন যাবে, ওই যে চক্রবৃদ্ধি হার।

সুমি উঠল। না না দেরি করব না। দিন সাতেকের মধ্যে আপনাকে আমি জানাব।

মকবুল সাহেবও উঠলেন। ঠিক আছে মা, ঠিক আছে।

.

১১.

পারু নির্বিকার গলায় বললেন, আমার মতামতের কোনও দরকার নেই। তুই যা ভাল বুঝিস কর।

সুমি কাতর গলায় বলল, সবকিছু আমার ওপর চাপাচ্ছ কেন?

যেহেতু আমার কিছু বলার নেই, কিছু করার নেই। এজন্যই চাপাচ্ছি।

ডাইনিংস্পেস থেকে হেঁটে নিজের রুমে চলে গেলেন পারু।

সুমির তখন এত অসহায় লাগছে! কী করবে কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে তার। এই অবস্থায় সুমি কি একটু সেলিমের সঙ্গে কথা বলবে!

সেলিমের অফিসে ফোন করল সুমি।

সব শুনে সেলিম বলল, তোমার মায়ের খুব অভিমান হয়েছে। এটা খুব অস্বাভাবিক নয়। এতবড় একটা ব্যাপার যেহেতু তার কাছে তোমার বাবা লুকিয়ে গেছেন, অভিমান তার হতেই পারে।

সুমি বলল, এখন এরকম অভিমানের কোনও মানে নেই। যে মানুষ চলে গেছেন তার ওপর অভিমান করে কী হবে!

তবু অভিমান অভিমানই।

এই ধরনের অভিমানকে আমার ছেলেমানুষি মনে হয়।

সেলিম চুপ করে রইল।

সুমি বলল, কিন্তু আমি কী ডিসিসান নিই বল তো?

আমি কী বলতে পারি, বল!

সুমি কেমন বিরক্ত হলো। কী বলবে মানে? আমার সমস্যাটা শেয়ার করবে না? হেলপ করবে না আমাকে?

অবশ্যই।

বল তাহলে কী করা উচিত আমার!

অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, বাড়ি বিক্রি ছাড়া তো কোনও উপায় দেখছি না।

ঠিকই বলেছ।

আর মকবুল সাহেবের কাছে বিক্রি করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

আমারও তাই মনে হয়।

এবং আর একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, ভদ্রলোক তোমাদেরকে ঠকাবেন না।

এটা আমিও মনে করি। কারণ তিনি লোক ভাল। তবে হানড্রেট পার্সেন্ট ব্যবসায়ি।

তা তো কেউ কেউ হতেই পারেন।

সেলিম একটু থামল। আর দু একটা কথা বলব?

বল।

বিয়েটা ডেট মতোই হওয়া উচিত আমাদের।

কেন?

আমি দু একটা জায়গায় বলে রেখেছি, রেজাল্ট বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে চাকরি হয়ে যাবে তোমার। তুমি যা বেতন পাবে, পুরো টাকাটা তুমি তোমার মাকে দিতে পারবে। আমাদের সংসারে একটি পয়সাও তোমাকে খরচ করতে হবে না। তারপর আমি আছি, আমিও তোমার মা এবং ভাইকে দেখব।

সেলিমের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল সুমি। বলল, খুব ভাল লাগল তোমার কথা শুনে। মনটা ভাল হয়ে গেল।

তখুনি কলিংবেল বাজল।

সুমি বলল, কে যে এল। রাখি এখন। পরে কথা বলব।

ঠিক আছে।

টেলিফোন রেখে ছুটে গিয়ে গেট খুলল সুমি। খুলে থতমত খেল।

ঝকঝকে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে গেটের বাইরে। ধপধপে সাদা টিশার্ট আর আকাশি রংয়ের জিনস পরা। চোখে সানগ্লাস। পায়ে বুট। গা

থেকে সুন্দর পারফিউমের গন্ধ আসছে।

সুমিকে দেখেই সানগ্লাসটা খুলল সে। মিষ্টি হেসে বলল, হাই।

তারপরই যেন নিজেকে সামলালো। দুঃখিত। স্লামালেকুম।

আপনি …….?

আগে বলুন, এটা মাসুদ সাহেবের বাড়ি তো?

জ্বী।

সঙ্গে সঙ্গে কী যে খুশি হলো যুবক! মুহূর্তে উজ্জ্বল মুখ আরও উজ্জ্বল হয়ে গল তার। থ্যাংকস গড। খুব সহজেই পেয়ে গেলাম। তিনি আছেন?

সুমির মুখ ম্লান হয়ে গেল। গভীর দুঃখের ছায়ায় আচ্ছন্ন হলো মুখ।

ব্যাপারটা খেয়াল করল যুবক। চিন্তিত গলায় বলল, কী হয়েছে?

বাবা, বাবা গত মাসের একুশ তারিখে, সিভিয়ার হার্টএটাক…

কথা শেষ করতে পারল না সুমি। জলে চোখ ভরে এল। চোখের জল সামলাতে অন্যদিকে মুখ ফেরাল সে।

যুবক ততোক্ষণে একেবারেই নিভে গেছে। কোনও রকমে সে শুধু বলল, ওহ, গড!

সুমি আবার তার দিকে তাকাল। কিন্তু আপনাকে ঠিক …….।

না না চিনবার কথা নয়। আমার নাম মনজু। মনজুর রহমান। নিউইয়র্কে থাকি। আচ্ছা, আপনার মা বাড়িতে আছেন? আমি কি তাঁর সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি?

আসুন।

সুমির পিছু পিছু তাদের ড্রয়িংরুমে এসে ঢুকল মনজু।

সুমি বলল, আপনি বসুন। আমি মাকে ডাকছি।

জ্বী আচ্ছা।

মিনিটখানেকের মধ্যে পারুকে নিয়ে এই রুমে ফিরে এল সুমি। এই আমার মা।

সঙ্গে সঙ্গে মনজু তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। কেমন আছেন আপনি?

পারু বললেন, এই অবস্থায় কেমন থাকা যায় বলো? কিন্তু বাবা …..।

আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বলবেন আসলে কেমন করে যে পরিচয়টা দেব? আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা।

কী নাম তার?

আপনি বোধহয় তাকে চিনবেন না। তাছাড়া এতকাল আগের ঘটনা।

তবু নামটা বল।

আতিকুর রহমান। মাসুদ চাচা এবং বাবা একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে সুমি কেমন উত্তেজিত হলো। গোয়ালিমান্দ্রার যুদ্ধে গুলিতে একটা পা …। হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা আমাকে একদিন তার কথা বলেছিলেন।

সুমির দিকে তাকাল মনজু। তাহলে তো আপনার জানার কথা। গুলিতে ডানপাটা একেবারেই শেষ হয়ে গিয়েছিল বাবার। পাকিস্তানিদের আক্রমণে নতুন করে সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য পিছু হটছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। বাবার দিকে ফিরে তাকাবার সময় ছিল না কারও। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাসুদ চাচা আমার মৃতপ্রায় বাবাকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। আমার। বাবার জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন।

সুমি বলল, সেই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারাই জয়ী হন। একটি পাকিস্তানিও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।

পারু বললেন, তোমার বাবা বেঁচে আছেন?

জ্বী আছেন এবং শরীরও খুব ভাল তাঁর।

কোথায় আছেন?

নিউইয়র্কে। স্বাধীনতার পর পর ট্রিটম্যান্টের জন্য আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। সেই সময়ও বাবাকে পাঠাবার জন্য মাসুদ চাচা অনেক চেষ্টা তদবির করেছিলেন। সব মিলে আমার বাবার জীবনে মাসুদ চাচার ভূমিকার কোনও তুলনা হয় না।

সুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পা কি পুরোপুরি ভাল হয়ে গিয়েছিল তার?

না। কেটে বাদ দিতে হয়েছে। বাবা ক্রাচে ভর দিয়ে চলেন। তবে বাবার পায়ের অভাবটা পূরণ করে দিয়েছেন আমার মা।

পারু বললেন, তোমার মা কোথাকার মানুষ?

আমেরিকান বাঙালি। ওখানেই জন্মেছেন।

ও।

তারপর পারু বললেন, তুমি চা খাবে তো, বাবা?

জ্বী না।

সুমি বলল, আপনার মায়ের কথা বলুন।

মা ছিলেন নার্স। ট্রিটম্যান্টের জন্য যে হাসপাতালে ছিলেন বাবা, সেই হাসপাতালের নার্স। পরে বাবার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বাবা আমেরিকাতেই থেকে গেলেন।

আর কখনও দেশে ফেরেন নি?

না।

কেন?

দেশে কেউ ছিল না আমাদের।

আত্মীয় স্বজন কেউ না?

না। আমার দাদা দাদী আগেই মারা গিয়েছিলেন। আমার একজন ফুফু ছিলেন, সেই ফুফুকে বাবা পরে আমেরিকায় নিয়ে যান। আমার সেই ফুফুও নিউইয়র্কেই থাকেন। তার দুটো ছেলে। ফুফার একটা গ্রোসারিশপ আছে। নিজের সুন্দর বাড়ি। অবস্থা বেশ ভাল।

পারু বললেন, খুব ভাল লাগল বাবা। খুব খুশি হয়েছি। তোমার বাবা পুরনো দিনের কথা মনে রেখেছেন। দেশে এসে তুমি আমাদের খোঁজ খবর নিতে এসেছ। আজকাল কে কার কথা মনে রাখে, বল?

মনজু কথা বলল না। সুমি বলল, কিন্তু আপনি আমাদের ঠিকানা পেলেন কী করে?

বাবা বলে দিয়েছিলেন গেণ্ডারিয়া এলাকাতেই আছেন আপনারা। যুদ্ধের সময় যে বাড়ি ছিল হয়তো সেই বাড়ি এখন আর নেই। তবু খুঁজলে নিশ্চয় পাওয়া যাবে।

কিন্তু আগের সেই বাড়ি তো নেই।

তবু পেয়ে গেলাম। খুব একটা খুঁজতে হয়নি। ইচ্ছে এবং চেষ্টা থাকলে সব হয়।

পারু বললেন, চা খেতে চাইছ না কেন?

সুমি বলল, চা না হয় অন্য কিছু একটু খান। এভাবে খালি মুখে বসে আছেন!

ঠিক আছে।

সুমি উঠতে যাচ্ছিল, পারু বললেন, তুই বোস। আমি যাচ্ছি।

পারু চলে যাওয়ার পর মনজু বলল, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে আমার অন্যরকমের কিছু ঝামেলা আছে।

সুমি বলল, কী রকম?

বাবা আমাকে বলেছেন পুরনো ঢাকায় বিকেলবেলা ঘন দুধের চা আর ডালপুরি, অসাধারণ টেস্টি। ভাবছিলাম আপনাদের এখান থেকে বেরিয়ে কোনও একটা রেস্টুরেন্টে বসে ওরকম চা আর ডালপুরি খাব। এজন্যই চাটা খেতে চাইনি।

মনজুর কথা শুনে চঞ্চল হলো সুমি। আগে বলবেন তো! ও রকম চা আর ডালপুরি আপনাকে আমি আনিয়ে দিচ্ছি।

উঠে দ্রুত পায়ে মায়ের রুমের দিকে চলে গেল সুমি।

সুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর মনজুও উঠল। উঠে মাসুদ সাহেবের ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার দুর্ভাগ্য আপনার সঙ্গে আমার দেখা হলো না। স্বপ্ন ছিল, আমার বাবাকে যিনি বাঁচিয়েছেন, পায়ে হাত দিয়ে তাকে একবার সালাম করব। আমার কৃতজ্ঞতা জানাব। সেদিন যদি আমার বাবাকে আপনি না বাঁচাতেন, আমার তাহলে এই পৃথিবীতে আসা হতো না। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হওয়া হতো না।

ঠিক তখুনি ডাইনিংস্পেসে টেলিফোন বাজল। পারু টেলিফোন ধরলেন। হ্যালো। জ্বী। হা হা বলুন। আমি সুমির মা। ওয়ালাইকুম সালাম।

ড্রয়িংরুম থেকে মনজু সব শুনতে পাচ্ছিল।

পারু বললেন, ও মকবুল সাহেব। জ্বী জ্বী চিনেছি। আপনার ওখান। থেকে এসে সুমি আমাকে সব বলেছে। কী? সাতদিনের মধ্যে জানাবে বলেছে? না না সাতদিনের দরকার নেই। আপনি এখনই শুনুন। বাড়ি আপনিই নিয়ে নেবেন। আপনার পাওনা টাকা রেখে বাকিটা আমাদেরকে দিয়ে দেবেন। দু একদিনের মধ্যেই সুমি এবং তার জামাইকে আমি আপনার ওখানে পাঠাব। ওরা সব ফাইনাল করে আসবে। জ্বী না, এখনও বিয়ে হয়নি। এনগেজম্যান্ট হয়েছে, বিয়ের ডেট হয়েছে। জ্বী আচ্ছা।

ড্রয়িংরুম থেকে সব কথাই শুনেছে মনজু। শুনে কী রকম স্তব্ধ হয়ে আছে।

এসময় ট্রেতে চা এবং ডালপুরি নিয়ে সুমি এল। যখন সেন্টারটেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখছে সুমি তার হাতের এনগেজম্যান্ট রিংটা দেখতে পেল মনজু। তখনও আগের মতোই স্তব্ধ, আনমনা ভাব তার।

সুমি বলল, এই আপনার ওরকম চা আর ডালপুরি।

মনজু কথা বলল না।

সুমি অবাক হলো। কী হয়েছে?

মনটা একটু খারাপ।

কেন?

আপনার হাতের আংটি দেখে।

সুমি ভুরু কুঁচকালো। আমার আংটি দেখে আপনার মন কেন খারাপ হবে?

না মানে বুঝে গেছি আমার কোনও সম্ভাবনা নেই।

জ্বী?

মনজু হাসল। সিনেমা নাটকে তো এমনই হয়। বাবার বন্ধুর ছেলেতে মেয়েতে ….। হয় না?

সুমিও হাসল। আপনি খুব মজা করে কথা বলেন।

যত মজাই করি কিন্তু আপনার আমার কোনও সম্ভাবনা নেই।

তারপর একটু থেমে বলল, রাগ করলেন নাকি? না না রাগ করবেন না। মনের কথা মনে আমি লুকিয়ে রাখতে পারি না। বলে ফেলি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

সুমি হাসল। চা এবং ডালপুরি দুটোই ঠাণ্ডা হচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে বসল মনজু। একটা ডালপুড়ি নিয়ে কামড় দিল, সঙ্গে এক চুমুক চা। এবং খেয়ে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। আহা, সত্যি অতুলনীয় খাবার। বাবার মুখে কত টুকটাক বাঙালি খাবারের কথা যে শুনেছি। এবার

একে একে সব খেয়ে যাব।

আবার ডালপুরিতে কামড় দিল মনজু। চায়ে চুমুক দিল। আচ্ছা, কচুরলতি, গাঠি, কচুরমুখি এসব আপনি চেনেন?

সুমি অবাক হলো। ওমা, চিনব না কেন?

ওসবের যত রকমের আইটেম করা যায়, করে আমাকে একদিন খাওয়াবেন তো!

তারপর আবার নির্মল মুখ করে হাসল মনজু। সীমা লংঘন করছি না তো?

কী রকম?

মানে প্রথম দিনই এত অধিকার নিয়ে কথা বলছি! আসলে আপনাদেরকে আমি খুব আপন মনে করছি। আমার নিজের মানুষ মনে করছি। যতদিন দেশে আছি ঘুরে ফিরে আপনাদের এখানে আমি আসব। বিরক্ত হলেও আসব।

কথা বলতে বলতে দুটো ডালপুরি এবং এক কাপ চা শেষ করেছে। মনজু। এবার উঠে দাঁড়াল।

তাকে দাঁড়াতে দেখে সুমি বলল, আমরা কখনই বিরক্ত হবে না। আপনি আসবেন।

তারপর আচমকা মনজু বলল, ভদ্রলোক কী করেন?

কোন ভদ্রলোক?

মানে আপনার যার সঙ্গে হবে।

সুমি হাসল। ও।

আপনি তো আমার চে’ ছোট হবেন, ছোটবোনের জামাইকে কি দুলাভাই বলা যায়? আচ্ছা, বললেই বা কী হয়!

সুমি আবার হাসল। না কিছুই হয় না। ইচ্ছে করলেই বলা যায়। তবে তার আগে ছোটবোনটিকে তুমি করে বলতে হয়?

মনজু সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেল। ভুল বললি। তুই করে বলতে হয়।

তারপর আদেশের গলায় বলল, শোন, দুলাভাইর নামধাম অফিস ইত্যাদি সব লিখে দে তো। চট করে একটা সারপ্রাইজ দিয়ে আসব।

দিচ্ছি।

সঙ্গে তোদের এই বাড়ির টেলিফোন নাম্বারটাও দিবি। যখন তখন ফোন করব।

কথাটা শুনে হাসিমুখ ম্লান হয়ে গেল সুমির। ফোন নাম্বারটা দিতে পারছি না।

কেন?

ফোনটা আর আমাদের নেই।

মানে?

ফোনটা আমরা বিক্রি করে ফেলেছি। দুতিন দিনের মধ্যে ট্রান্সফার হয়ে যাবে।

মনজু একটু থতমত খেল। তারপর সামান্য সময় কিছু ভেবে বলল, ঠিক আছে। দুলাভাইর অফিসের এডড্রেস দে।

সুমি এডড্রেস লিখে দিল।

.

১২.

খুবই একাগ্রতা নিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে সেলিম। কী একটা জটিল হিসেব বের করার চেষ্টা করছে।

এ সময় তার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল মনজু। খুবই উফুল্ল গলায় বলল, স্লামালেকুম দুলাভাই। ভাল আছেন?

চমকে মনজুর মুখের দিকে তাকাল সেলিম। তারপর ঠোঁট টিপে হেসে নির্বিকার গলায় বলল, ওয়ালাইকুম সালাম। জ্বী ভাল আছি। বসুন।

সেলিমের এরকম নির্বিকার ভাব দেখে মনজু অবাক হলো। আপনার সমস্যাটা কী?

কিসের সমস্যা?

আমার সাইজের একটা লোক দুলাভাই দুলাভাই করছে আর আপনি একটুও অবাক হচ্ছেন না!

কম্পিউটার অফ করে হাসল সেলিম। আপনি বোঝেননি কেন অবাক হচ্ছি না?

না।

সুমি আমাকে সব বলেছে।

ও এই কথা। আচ্ছা মুরগির কলিজা গিলা দেয়া সিঙারা কোথায় পাওয়া যাবে বলুন তো?

তারপরই নিজেকে সামলালো মনজু। থাক, লাঞ্চ আওয়ার হয়ে গেছে। চলুন হাজির বিরিয়ানী খেয়ে আসি।

বলেই নির্মল মুখ করে হাসল। বিরক্ত হচ্ছেন না তো? আসলে আমার যাকে ভাল লাগে আমি তার সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

আমার সঙ্গেও মিশবেন। কোনও অসুবিধা নেই।

আপনাকে আমার খুব ভাল লাগল।

ধন্যবাদ।

এরপর একটা এবং আছে।

কী?

আপনার কাছে আমি একটা হেলপ চাইব।

কী ধরনের?

চলুন বিরিয়ানী খেতে খেতে বলব।

সেলিম উঠল। তবে আমার একটা কথা আছে।

বলুন।

বিরিয়ানীর বিলটা আমি দেব।

তা তো দেবেনই। দুলাভাই সঙ্গে থাকলে শ্যালকরা কি কখনও বিল দেয়?

না তা দেয় না।

তাহলে?

অবশ্য বাঙালি সভ্যতায় এই প্রথম একটা অভিনব ব্যাপার ঘটছে।

কী বলুন তো?

হবু স্ত্রীর বড়ভাইও শ্যালক সেজেছে। হওয়া উচিত সমুন্দি।

মনজু হাসল। না আমি আপনার শ্যালক হয়েই থাকতে চাই।

বিরিয়ানী খেতে খেতে মনজু যা বলল শুনে চোখ স্থির হয়ে গেল সেলিমের। কোনও রকমে সে বলল, আপনি এসব কেন করতে চাচ্ছেন?

মনজু সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি মনে করছি এটা আমার কর্তব্য।

কর্তব্য মনে করবেন কেন? ওরা তো আসলে আপনার কেউ না।

এক অর্থে কেউ না, আরেক অর্থে খুব আপন। সেই যুদ্ধের দিনে মাসুদ চাচা না বাচালে আমার বাবা বেঁচে থাকতেন না, আমার এই পৃথিবীতে আসা হতো না। আপনাদের মতো কতো ভাল মানুষ চারদিকে, এইসব মানুষের সঙ্গে দেখা হতো না।

কিন্তু আমি এসব সামাল দেব কেমন করে?

সামাল দেয়াটা আপনার পক্ষেই সব চাইতে সহজ। আপনাকে শুধু। বলতে হবে আপনি সব করছেন।

কেউ বিশ্বাস করবে না।

কেন?

আমিই যদি সব করব এতদিন করিনি কেন?

এসবের কোনও একটা অজুহাত বের করবেন।

বলেই সেলিমের একটা হাত ধরল মনজু। আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে যিনি বাঁচিয়েছিলেন সেই মহান মুক্তিযোদ্ধার পরিবারটিকে বাঁচাতে আপনি আমাকে সাহায্য করুন।

সেলিম অপলক চোখে মনজুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

.

১৩.

পারু চিন্তিত গলায় বললেন, তুমি এতকিছু সামাল দেবে কেমন করে?

সন্ধের পর সুমিদের বাড়ি এসেছে সেলিম। অফিস থেকে সরাসরিই এসেছে। এসেই কিছু কথা বলেছে। শুনে পারু ওই কথা বললেন।

পারুর কথা শুনে সেলিম বলল, আমি সামাল দিতে পারব।

কীভাবে?

ব্যবস্থা আছে।

কী ব্যবস্থা?

শেষ কথাটা বলল সুমি। সে দাঁড়িয়েছিল দরজার সামনে।

সেলিম সুমির দিকে তাকাল। তোমাদের ফ্যামিলির অবস্থা দেখে এসব নিয়ে অফিসে কথা বলেছিলাম আমি।

কবে?

বেশ কয়েকদিন আগে।

তারপর?

বলেছিলাম লাখসাতেক টাকা হলে সব মিটে যায়। মকবুল সাহেবের টাকা শোধ করা যায়, বিয়ের খরচ, তোমার চাকরি বাকরি না হওয়া পর্যন্ত সংসার খরচ।

সাত লাখ টাকার কথা শুনে পারু একেবারে আঁতকে উঠলেন। সাত লাখ টাকা কি মুখের কথা?

সেলিম বলল, কিন্তু টাকাটা আমি এরেঞ্জ করেছি।

সুমি বলল, কীভাবে?

অফিস আমাকে লোন দেবে।

পারু বললেন, এত টাকা লোন দেবে?

জ্বী দেবে।

টাকা তুমি শোধ করবে কেমন করে?

মাসে মাসে বেতন থেকে কেটে নেবে।

সুমি কী রকম চিন্তিত চোখে সেলিমের দিকে তাকিয়ে রইল।

পারু বললেন, না না। আমাদের জন্য এত বড় ঝামেলায় জড়াবার। দরকার নেই তোমার। তারচে বাড়ি চলে যাক। তাছাড়া তোমাদের বাড়িতে ব্যাপারটা জানাজানি হলে ….।

সেলিম দৃঢ় গলায় বলল, কেউ জানবে না। এসব নিয়ে আপনি ভাববেন না।

তারপর সুমির দিকে তাকাল সেলিম। সুমি, টেলিফোনটা যারা কিনতে চেয়েছে তাদেরকে মানা করে দিও। আর মকবুল সাহেবের ফোন নাম্বারটা দাও।

সুমি তখনও আগের মতো চোখ করে সেলিমের দিকে তাকিয়ে আছে।

.

১৪.

দুদিন পর সকালবেলা মকবুল সাহেবের অফিসে এসে ঢুকল মনজু এবং সেলিম।

মকবুল সাহেব ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

সেলিম বলল, আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম।

মকবুল সাহেব ব্যস্ত হলেন। ও আচ্ছা। বসুন, বসুন।

ওরা দুজন মকবুল সাহেবের মুখোমুখি বসল।

সেলিম বলল, কাগজপত্রগুলো সব রেডি আছে?

জ্বী। হাতের কাছেই আছে।

ড্রয়ার থেকে ফাঁইলটা বের করলেন, সেই মোটা খাতাটা বের করলেন।

এসবের দিকে ফিরেও তাকাল না মনজু। আচমকা ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল মকবুল সাহেবের দিকে। আমি মনজু। সুমির ভাই।

মনজুর হাত ধরলেন মকবুল সাহেব। মাসুদ সাহেবের এতবড় ছেলে আছে বলে তো জানতাম না!

আমি তার ছেলে নই, তার সহযোদ্ধার ছেলে।

তাই বলুন।

তারপর সেলিমের দিকে তাকালেন মকবুল সাহেব। চেক এনেছেন বাবা?

সেলিম বলল, জ্বী।

মনজু বলল, তবে অংকটা এখনও লেখা হয়নি। একজাক্ট ফিগারটা…।

চারলক্ষ বেয়াল্লিশ হাজার। চক্রবৃদ্ধি হার।

কোনও অসুবিধা নেই।

তারপর একটু থামল। আপনি আমার বাবার বয়সী। আপনাকে চাচা বলতে পারি?

মকবুল সাহেব বিগলিত হলেন। নিশ্চয়, নিশ্চয়। চা দিতে বলি। চা খান বাবা।

মনজু হাসল। খেতে পারি, তবে দোকানের চা। সঙ্গে নিমাকপারা। বাবা বলেছেন পুরনো ঢাকার দোকানের চায়ের সঙ্গে নিমাকপারা অসাধারণ লাগে।

কোনও অসুবিধা নেই। এখুনি আনিয়ে দিচ্ছি।

মতি নামের অল্প বয়েসি একটা কাজের ছেলে আছে মকবুল সাহেবের। মতিকে ডাকলেন তিনি। মতি, মতি।

ভেতর থেকে ছুটে এল মতি। জ্বী।

সালুর দোকান থেকে কেটলি ভরে চা আন আর দশটাকার নিমাকপারা।

সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল মতি।

মনজু বলল, আপনাকে খুব ভাল লেগেছে চাচা। আপনি লোক ভাল।

হ্যাঁ বাবা। লোক আমি খারাপ নই।

একাত্তর সালে কোথায় ছিলেন?

গ্রামে ছিলাম বাবা। বিক্রমপুরের ইছাপুরা গ্রাম।

মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন?

অস্ত্র কাঁধে নিয়ে যুদ্ধ করিনি, অর্থাৎ সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা না। তবে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যতটা সম্ভব সাহায্য করেছি।

এটা আপনি না বললেও আমি বুঝতাম।

মকবুল সাহেব অবাক হলেন। কী ভাবে?

মাসুদ চাচাকে টাকা দিয়ে যেভাবে সাহায্য করেছেন তাতে বোঝা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আপনার গভীর ভালবাসা আছে।

এই কথাটা ধরল সেলিম। কিন্তু টাকা তো ইন্টারেস্টে দিয়েছেন!

মুখ ঘুরিয়ে সেলিমের দিকে তাকাল মনজু। যেভাবেই হোক, দিয়েছেন তো!

তারপর আবার মকবুল সাহেবের দিকে তাকাল মনজু। চাচা, মাসুদ চাচার ফ্যামিলি সম্পর্কে আপনি সবই জানেন। তাঁর মৃত্যুতে খুবই বিপাকে পড়েছে পরিবারটি। যে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে, জীবন দিয়ে একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন আপনাদেরকে, সেরকম এক বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবার আজ বিপর্যস্ত। সেই পরিবারটিকে আপনি একটু সাহায্য করতে পারেন না?

মকবুল সাহেব ফ্যাল ফ্যাল করে মনজুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মতি এসময় চা এবং নিমাকপারা নিয়ে এল।

এক মুঠো নিমাকপারা মুখে দিয়ে এক চুমুক চা খেল মনজু। তারপর পকেট থেকে চেক বই বের করল। চক্রবৃদ্ধি হারে কত টাকা বললেন?

মকবুল সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, সব হিসাব তো আপনি উলট পালট করে দিয়েছেন বাবা। আপনার কথা শুনে একাত্তর সালে ফিরে গেলাম। সেই দুর্দিন থেকে যারা আমাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন, দেশ স্বাধীন করে দিয়েছেন সেরকম এক মুক্তিযোদ্ধার পরিবার বিপদে পড়েছে, আমি অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করব। আপনি আমার মূল টাকাটাই দিন বাবা। তিনলাখ। ইন্টারেস্ট বাদ।

মনজু মুগ্ধ গলায় বলল, গ্রেট।

.

১৫.

হোয়াইট হাউস হোটেলের লবিতে বিষমুখে বসে আছে সুমি।

প্রায় ছুটতে ছুটতে তার সামনে এল মনজু। তুই হঠাৎ আমার হোটেল? রিসেপসান থেকে ফোন করেছে, এক মহিলা মানে ভদ্রমহিলা দেখা করতে চান। শুনে আমি তো হতভম্ব। আমার কাছে আবার ভদ্রমহিলা কে? এই, তুই কি ভদ্রমহিলা নাকি? বলতে পারলি না তুই আমার বোন!

সুমি কথা বলল না। অপলক চোখে মনজুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

মনজু অবাক হলো। কী ব্যাপার? এত গম্ভীর হয়ে আছিস কেন?

সুমি গম্ভীর গলায় বলল, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

সুমির কথা বলার ধরনে কী যে মুগ্ধ হলো মনজু! বলল, তুই যে আমাকে তুমি করে বলছিস এবং সত্যি আপন ভেবেছিস এতেই আমি খুশি। এখন যদি তুই আমার সঙ্গে রাগারাগিও করিস, আমি কিছু মনে করব না। বল, কী কথা?

তুমি আগে আমার সামনে বস।

মনজু বসল।

সুমি বলল, এসব তুমি কী করেছ?

কথাটা প্রথমে বুঝতে পারল না মনজু। বলল, কী করেছি?

তারপরই চমকাল। সর্বনাশ! দুলাভাই কি তোকে সব বলে দিয়েছে? না না এটা তো ঠিক করেনি।

সে বলেনি।

তাহলে?

মকবুল সাহেব আমাকে ফোন করেছিলেন।

তাই বল।

কিন্তু আমাদের জন্য এতটা তুমি কেন করলে?

শোন, মানুষের জীবন আসলে এক যুদ্ধক্ষেত্র। বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যেকেই যুদ্ধ করছে। কখনও দেশের জন্য, কখনও জীবনের জন্য। যুদ্ধের নিয়ম হচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও সহযোদ্ধাকে সাহায্য করা। যে সাহায্য তোর বাবা আমার বাবাকে করেছিলেন।

এতকাল পর তুমি সেই ঋণ শোধ করলে?

ঋণ শোধ নয়। জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত হওয়া কিছু যোদ্ধার পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

একটু থামল মনজু। শোন, আজই ফিরে যেতে হচ্ছে। রাত সাড়ে এগারোটায় ফ্লাইট।

সুমি চমকাল, কী?

হ্যাঁ। বাবা ফোন করেছিলেন। আমাকে ছাড়া নাকি ভাল লাগছে না। আমাকে নাকি খুব মিস করছেন। এজন্য হঠাৎ করেই …।

মার সঙ্গে দেখা করে যাবে না?

অবশ্যই। চল এখুনি যাই।

চল।

তার আগে দুলাভাইকে একটা ফোন করি। আজ তো ছুটির দিন। তাকেও আসতে বলি।

দরকার নেই। সে এমনিতেই আসবে।

বাস্তবিকই সুমিদের বাড়ি এসে সেলিমকে দেখতে পেল মনজু। ড্রয়িংরুমে বসে আছে। তার সঙ্গে গল্প করছেন পারু এবং অমি।

এই রুমে ঢুকে মনজুর চলে যাওয়ার কথা বলল সুমি।

শুনে পারু বললেন, আমাদের বিপদ যখন কাটল তখনই তুমি চলে যাচ্ছ বাবা? তোমাকে একবেলা খাওয়াতেও পারলাম না।

মনজু সেই নির্মল ভঙ্গিতে হাসল। আরেকবার যখন আসব তখন রোজই খাব। কারণ তখন তো আমি এই বাড়িতেই থাকব।

তারপর পারুর পাশে গিয়ে বসল সে। আপনাকে একটা অনুরোধ করব।

কী বাবা?

যদি কখনও কোনও প্রয়োজনে আমার কথা আপনাদের মনে হয়, একটু কষ্ট করে আমাকে শুধু একটা ফোন করবেন। দেখবেন আমি এসে ঠিকই হাজির হয়েছি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।

পারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হ্যাঁ বাবা, করব।

তারপর অমির দিকে তাকাল মনজু। তোকে আমার বলার কথা একটাই, লেখাপড়া শিখে মানুষ হবি। মনে রাখবি তুই একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।

অমি মাথা নীচু করে বলল, আমি মনে রাখব।

মনজু তারপর সেলিমের দিকে তাকাল। বেশ নাটকীয়ভাবে বিদায় নিচ্ছি, না? শেষ নাটকটা আপনার সঙ্গে করছি দুলাভাই। সময় থাকলে আপনার বিয়েটা খেয়ে যেতাম। তারপরও উইস করছি, বিবাহিত জীবন সুখের হোক।

সেলিম মৃদু কণ্ঠে বলল, ধন্যবাদ।

সুমি ততোক্ষণে চোখ মুছতে শুরু করেছে।

মনজু এসে তার সামনে দাঁড়াল। কাঁদছিস কেন?

তারপর বলল, আচ্ছা কাঁদ। ভাল করে কাঁদ। ভাই দূরে চলে গেলে বোনদের একটু কাদা উচিত।

সবশেষে মাসুদ সাহেবের ছবিটার সামনে এসে দাঁড়াল মনজু। হাত তুলে আর্মি কায়দায় স্যালুট করল ছবির মানুষটাকে।

.

১৬.

এতরাতে এয়ারপোর্টে আসবে সুমি এবং সেলিম মনজু তা কল্পনাই করেনি। অবাক গলায় বলল, কিরে তুই আবার এখানে এসেছিস কেন? এতরাতে দুলাভাই বেচারাকেও কষ্ট দিচ্ছিস।

সেলিম বলল, না। কিসের কষ্ট?

সুমি বলল, তোমাকে আমি একটা কথা বলতে এসেছি।

কী কথা?

মানুষ যখন খুব কষ্টে থাকে, দুঃখ বেদনা কিংবা আসময়ের মধ্যে থাকে তখন মনে মনে সে শুধু চায় তার কষ্টটা কেটে যাক, দুঃখ বেদনা একদম চলে যাক জীবন থেকে। অসময় কেটে গিয়ে সুসময় দেখা দিক। মনে মনে সে শুধু সুসময়কে ডাকে, সুখ এবং আনন্দকে ডাকে। আজকের পর থেকে জীবনের যে কোনও কষ্টের মুহূর্তে, দুঃখ বেদনা এবং অসময়ে আমি কেবল তোমাকে ডাকব। মনে মনে বলব, এসো, এসো তুমি। আমার কষ্ট কাটিয়ে দিয়ে যাও। দুঃখ বেদনা কাটিয়ে দিয়ে যাও। আমার অসময়কে ঠেলে দাও সুসময়ের দিকে। এসো, এসো তুমি।

মনজুর একটা হাত ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগল সুমি।

তোমাকে

তোমাকে – ইমদাদুল হক মিলন

০১.

দোতলার সিঁড়িতে একটা পা মাত্র নামিয়েছেন হোসেন সাহেব সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে পড়ল মেয়ের কথা। সঙ্গে সঙ্গে পাটা তুললেন তিনি। নামলেন না।

তাকে থামতে দেখে পেছনের দলটাও থেমেছে। রঞ্জু, রঞ্জুর বউ ছবি এবং তাদের পাঁচ বছরের ছেলে টুপু।

হোসেন সাহেব ছবির দিকে তাকালেন। অপরা কই, বউমা?

বাবার কথায় রঞ্জুরও যেন বোনের কথা মনে পড়ল। তাই তো!

তারপর ছবির দিকে তাকাল রঞ্জু। অপরা যাবে না?

কী জানি?

হোসেন সাহেব বললেন, তুমি একটু ওর রুমে যাও তো বউমা। দেখ তো ব্যাপারটা কী!

ঠিক আছে। আপনারা নামুন, আমি দেখছি।

দ্রুত হেঁটে অপরার রুমে এসে ঢুকল ছবি।

কিন্তু অপরা রুমে নেই। খুবই মন খারাপ করা ভঙ্গিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।

শৈবালের এই বারান্দা থেকে পরিষ্কার দেখা যায় সমুদ্র।

বিকেলবেলার সমুদ্রের দিকে উদাস,অপলক চোখে তাকিয়ে আছে অপরা। মুখ দেখে বোঝা যায় তার মন ভাল নেই।

ছবি এসে অপরার সামনে দাঁড়াল। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

অপরা বিষণ্ণ চোখে ছবির দিকে তাকাল। তাহলে কী করব?

কী করবে মানে? কক্সবাজার এসে বিকেলবেলা লোকে কী করে? তাড়াতাড়ি চল। সূর্য ডুবে যাবে।

আমি যাব না ভাবী।

কেন?

ভাল লাগছে না।

বল কী! সবাই মিলে এখানে বেড়াতে এলাম আর প্রথম দিনেই তোমার ভাল লাগছে না?

অপরা কথা বলল না।

ছবি যেন একটু বিরক্ত হলো। ভাল না লাগলে এসেছ কেন?

আসতে চাইনি। তোমরাই জোরাজুরি করলে!

সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে অপরার একটা হাত ধরল ছবি। এখনও সেই জোরাজুরিটা করছি। চল।

আমার সত্যি ভাল লাগছে না।

সমুদ্রতীরে চল, দেখবে ভাল লাগছে। সমুদ্র মানুষের মন বদলে দেয়।

অপরা মনে মনে বলল, আমারটা বদলাতে পারবে না।

তারপর ছবির সঙ্গে তার রুম থেকে বেরুল।

.

০২.

শৈবালের সামনের দিককার বাগানে বেশ একটা আড়াল দেখে দাঁড়িয়ে আছে দিপু। তার পরনে স্কীনটাইট ফেডেড জিনস আর আকাশি রংয়ের টিশার্ট। পায়ে বুট, চোখে সানগ্লাস। মুখে চুইংগাম আছে দিপুর। আর হাতে একটা ক্যামেরা। ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় কারও জন্য অপেক্ষা করছে সে।

কিন্তু চোখে সানগ্লাস থাকার ফলে বোঝা যাচ্ছে না কোনদিকে তাকিয়ে আছে সে।

দিপুর অদূরে শৈবাল থেকে সমুদ্রের দিকে যাওয়ার পায়েচলা পথ। সেই পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন হোসেন সাহেব আর রঞ্জু। পাশে সবুজ ঘাসের মাঠ পেয়ে তাতে ছুটোছুটি করছে টুপু।

এসময় অপরাকে নিয়ে ছবি এসে দাঁড়াল হোসেন সাহেব এবং রঞ্জুর সামনে।

মেয়েকে দেখেই চঞ্চল হলেন হোসেন সাহেব। কোথায় ছিলি তুই? তাড়াতাড়ি চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রে সূর্য ডোবে খুব তাড়াতাড়ি। এই দেখবি নামতে শুরু করেছে, তারপরই দেখবি টুপ করে চলে গেছে পানির তলায়।

অপরা কোনও কথা বলল না। বাবার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল।

ছবি চলে গিয়েছিল মাঠে, টুপুর কাছে। এখন টুপুর হাত ধরে সে আছে সবার পেছনে।

এই দলটিকে দূর থেকে ফলো করতে লাগল দিপু।

.

০৩.

সূর্য ডোবার এখনও অনেক দেরি।

ছবির কথা শুনে তার দিকে তাকাল রঞ্জু। দেরি হলেই তো ভাল। চল একটু নির্জনে যাই।

মুখ ঘুরিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল ছবি। মানে?

রঞ্জু হাসল। আমি অন্যকিছু মিন করিনি। এই বীচটা এখন বাজারের মতো। দেখছ না কী পরিমাণ লোক। হঠাৎ করে তাকালে মনে হয় মেলা বসেছে।

লোকের তো আসলে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কী করবে? চান্স পেলেই কক্সবাজার চলে আসে।

আমি আসলে এসবই বলতে চেয়েছি।

হাত দিয়ে হিমছড়ির দিকটা দেখাল রঞ্জু। ওই দিকটা বেশ ফাঁকা। চল ওই দিকে যাই।

বাবা অপরা ওদেরকেও ডাক।

ওই তো ওরা আসছে। আমরা যেদিকে যাব ওরাও সেই দিকেই আসবে।

তখন যেন হঠাৎ করে ক্যামেরার কথা মনে পড়ল ছবির। আঁতকে উঠল সে। ক্যামেরা আননি?

রঞ্জু হাসল। কী মনে হয় তোমার?

কই, দেখছি না তো?

এই যে পকেটে।

প্যান্টের একদিককার পকেট দেখাল রঞ্জু। পকেটটা উঁচু হয়ে আছে।

ছবি বলল, বের কর। আমার দুএকটা ছবি তোল।

পকেট থেকে তার ছোট্ট ক্যামেরাটা বের করল রঞ্জু। সবাই আসুক, সবার ছবিই তুলি।

তাতো তুলবেই। এখন আমার দুএকটা তোল।

না থাক।

কেন?

দূর থেকে বাবা নিশ্চয় দেখবেন।

দেখলে কী হয়েছে?

আমার লজ্জা করবে।

কিসের লজ্জা?

বাবা ভাববেন ছেলেটা কী রকম নির্লজ্জ টাইপের। বাবার সামনেই নিজের বউর ছবি তুলছে।

একথা শুনে খুবই বিরক্ত হলো ছবি। আশ্চর্য কথা! বাবার সামনে নিজের বউর ছবি তুলতে পারবে না? লজ্জা করছে? কিন্তু বাবা বোনকে নিয়ে তো এক ফ্ল্যাটেই থাক তুমি। রাতে যখন বউ নিয়ে নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে ঘুমাও তখন লজ্জা করে না? ছেলেটা যে হলো তখন বাবার কথা ভেবে তোমার লজ্জা হয়নি?

তারপর ধমকের সুরে ছবি বলল, তোল ছবি।

রঞ্জু আমতা আমতা গলায় বলল, ঠিক আছে। তুমি তাহলে একটু পানিতে নামো।

সমুদ্রজলে মাত্র পা ছুঁইয়েছে ছবি, হোসেন সাহেব অপরা এবং টুপু এসে দাঁড়াল রঞ্জুর পাশে। মাকে সমুদ্রে নামতে দেখে টুপু ছুটে গেল। আমিও তোমার সঙ্গে থাকব।

রঞ্জু বলল, হ্যাঁ তুমি টুপুকে ধরে দাঁড়াও। আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।

হোসেন সাহেব সাবধানী গলায় বললেন, টুপুকে শক্ত করে ধরে রেখ বউমা। সমুদ্রের ঢেউ কিন্তু আচমকা এসে….।

কথাটা শেষ করলেন না তিনি।

কিন্তু এসবের কিছুই ভাল লাগছে না অপরার।

সে বাবার দিকে তাকাল। আমি একটু ওই দিকটায় যাই বাবা?

হোসেন সাহেব মেয়ের দিকে তাকালেন। কোনদিকে?

হাত তুলে দূরের একটা বালিয়াড়ি দেখাল অপরা। মাঝখান দিয়ে ঝিরঝিরে একটি জলের ধারা বয়ে গেছে।

একেবারেই ফাঁকা নির্জন জায়গা।

হোসেন সাহেব বললেন, ঠিক আছে। যা।

অপরা হাঁটতে লাগল। এক সময় সেই বালিয়াড়িতে এসে সমুদ্রের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে রইল।

সূর্য তখন আস্তেধীরে সমুদ্রজলের দিকে নামছে।

.

০৪.

বেশ অনেকটা দূর থেকে অপরাকে একা হয়ে যেতে দেখল দিপু।

দেখেই তার মাথায় একটা প্ল্যান এলো। হিমছড়ি থেকে একটি পরিবার নিয়ে ফিরছিল ভাড়ার হুডখোলা জিপ। যাত্রী নামতেই সেই জিপের সামনে গিয়ে দাঁড়াল দিপু। জিপটা ভাড়া নিয়ে নিল। ড্রাইভারকে বলল, এক ঘণ্টার জন্য ভাড়া নেব। টাকা যা লাগে দেব। তবে আমার একটা শর্ত আছে।

কী শর্ত?

ড্রাইভ করব আমি।

আর আমি কোথায় থাকব?

আমার পাশে।

আপনি ভাল চালাতে পারেন তো?

বোধহয় আপনার চে’ ভাল পারি।

তবে ঠিক আছে।

তারপর ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল দিপু। সামুদ্রিক হাওয়ার বেগে জিপ চালিয়ে দিল। এক টানে প্রায় অপরার কাছাকাছি।

অপরা তখনও তার মতো করে তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। জিপ গাড়িটা এসে যে অদূরে থেমেছে, খেয়ালই করল না।

ড্রাইভিং সিটে বসেই ক্যামেরা তুলল দিপু। একটার পর একটা ছবি তুলতে লাগল অপরার।

কোনও কোনও ক্ষেত্রে মানুষের সিক্সথ সেন্স খুব কাজ করে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। কেউ কোনও মেয়েকে আড়াল থেকে দেখছে কিংবা তাকে নিয়ে কিছু ভাবছে, বলছে, মেয়েরা যেন চট করেই তা টের পায়। মনের ভেতর থেকে কেউ যেন তাদেরকে কাণ্ডটার কথা বলে দেয়।

অপরাকেও যেন কেউ বলল, এই মেয়ে, দেখ, একজন তোমার ছবি তুলছে।

সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে তাকাল অপরা। তারপর দিপুকে দেখে যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল, পাগল হয়ে গেল। মুহূর্তে কোথায় উধাও হলো তার মনমরা ভাব, বিষণ্ণতা। অদূরে বাবা এবং ভাই ভাবী আছেন, টুপু আছে, কিছুই মনে রইল না তার। পাগলের মতো দিপুর দিকে ছুটতে লাগল সে।

কিন্তু দিপু একেবারেই নির্বিকার। অপরা তার দিকে ছুটে আসছে আর সে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের ভঙ্গিতে তার ছবি তুলতে লাগল।

দিপুর জিপের কাছে এসে আনন্দে উত্তেজনায় ফেটে পড়ে অপরা বলল, তুমি? সত্যি তুমি? তুমি কখন এলে? কী করে জানলে আমরা এখানে এসেছি?

দিপু আগের মতোই নির্বিকার। একটিও কথা বলল না। অপরা কথা বলছে আর সে ছবি তুলছে। যেন অপরার প্রতিটি শব্দকে ক্যামেরাবন্দি করতে চাইছে সে। প্রতিটি মুখভঙ্গিকে চিরস্থায়ী করে রাখতে চাইছে।

কিন্তু অপরার এসব একদম ভাল লাগছে না। অস্থির গলায় সে বলল, কথা বলছ না কেন? কী হয়েছে? এই, তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ? কিন্তু আমার কোনও দোষ নেই। হঠাৎ করে প্রোগ্রামটা হলো। আমি আসতে চাইনি।

দিপু তবু কথা বলল না।

দিপুর পাশে বসা জিপের মালিক কিংবা ড্রাইভার হতভম্ব হয়ে আছে। একবার দিপুর দিকে তাকাচ্ছে সে, আরেকবার অপরার দিকে।

এই ফাঁকে লাফ দিয়ে জিপ থেকে নামল দিপু। আবার ছবি তুলতে লাগল অপরার।

অপরা বলল, অনেকবার তোমাকে ফোন করেছি। কিছুতেই পাইনি। কোথায় ছিলে তুমি? তোমাকে বলে আসতে পারিনি, আমার যে কী মন খারাপ হয়েছে।

তারপর মিষ্টি করে হাসল সে। এখন মন ভাল হয়ে গেছে। এখন আমি খুব আনন্দ করব। সমুদ্র, সূর্যাস্ত, গভীর রাতে চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া সমুদ্র সব এনজয় করব। এই, তুমি উঠেছ কোথায়?

দিপু একেবারেই নির্বিকার। অন্যদিকে তাকিয়ে চুইংগাম চিবাতে লাগল।

অপরা অসহায় গলায় বলল, এমন করো না প্লিজ। আমার খুব খারাপ লাগছে। কথা বলো। প্লিজ কথা বলো।

দিপু তবু কথা বলল না।

.

০৫.

দূর থেকে হঠাৎ করেই এই দৃশ্যটা দেখে ফেললেন হোসেন সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জু এবং ছবিকে ডাকলেন। ওরা দেখল দৃশ্যটা।

হোসেন সাহেব বললেন, ছেলেটা কে?

রঞ্জু বলল, বুঝতে পারছি না।

ছবি বলল, নিশ্চয় অপরার পরিচিত। এখানে এসে হয়তো দেখা হয়ে গেছে।

রঞ্জ বলল, তাই হবে।

তারপর হোসেন সাহেবের দিকে তাকাল। বাবা, তুমি একটু সূর্যের দিকে তাকিয়ে দাঁড়াও তো, তোমার একটা ছবি তুলি।

হোসেন সাহেব সূর্যের দিকে তাকিয়ে দাঁড়ালেন।

রঞ্জু ক্যামেরা তুলল।

.

০৬.

অপরা বেশ রেগে গেছে।

গম্ভীর গলায় বলল, অনেক হয়েছে। আমি কিন্তু এখন রেগে যাব।

দিপু তবু কথা বলল না। চুইংগাম চিবাতে চিবাতে নির্বিকার ভঙ্গিতে ক্যামেরা তুলল।

আচমকা ক্যামেরাটা ছিনিয়ে নিল অপরা। নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এত করে বলার পরও তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছ না! কী করেছি আমি? কী করেছি? তোমার যেমন মন খারাপ হয়েছে, আমার হয়নি? মন কি তোমার একাই আছে? আমার নেই?

কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল অপরা।

দিপু তবু নির্বিকার। আস্তেধীরে হেঁটে গিয়ে ক্যামেরাটা কুড়িয়ে আনল সে। তারপর জিপে চড়ল।

অপরা ছুটে এসে তার সামনে দাঁড়াল। অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছ তুমি। অতিরিক্ত। আমি কিন্তু এখন চিৎকার করব। চিৎকার করে কাঁদব। আমাদের ফ্যামিলির সবাই আছে এখানে, আমি সবাইকে ডাকব। আমি কিন্তু কেলেংকারি করব।

দিপু এসবের কিছুই কেয়ার করল না। হাওয়ার বেগে জিপ চালিয়ে দিল।

অপরা পাগলের মতো জিপের পিছু পিছু ছুটতে লাগল। দিপু, যেও। যেও না। দাঁড়াও, প্লিজ দাঁড়াও।

.

০৭.

টুপু অবাক গলায় বলল, ফুপির কী হয়েছে মা?

সঙ্গে সঙ্গে তিনজন মানুষ অপরার দিকে তাকাল। তাকিয়ে দিশেহারা হয়ে গেল। বালিয়াড়ির ওপর হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে সে।

এই দৃশ্য দেখে প্রথমে ছুটল রঞ্জু। তার পিছু পিছু ছবি। সব শেষে হোসেন সাহেব এবং টুপু।

অপরাকে জড়িয়ে ধরে ছবি বলল, কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?

হোসেন সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললেন, ছেলেটা কে?

রঞ্জু বলল, তোকে ডিস্টার্ব করেছে?

ততোক্ষণে নিজেকে সামলেছে অপরা। চোখ মুছতে মুছতে বলল, তোমরা যা ভেবেছ তা নয়।

হোসেন সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, তাহলে কী? ব্যাপারটা কী?

ভাবীকে আমি সব বলব। তার কাছ থেকে জেনে নিও।

.

০৮.

শৈবালের সামনে এসে জিপ থেকে নামল দিপু।

মানিব্যাগ বের করল। কত?

পাঁচশো টাকা দেন।

দিপু একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে দিল।

ড্রাইভার অবাক। যা চাইলাম তাই দিলেন?

হ্যাঁ।

আপনে খুব অন্য ধরনের মানুষ।

হ্যাঁ। আসুন। খোদা হাফেজ।

কিন্তু আমার একটা কথা আছে।

কী কথা?

মানে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। করব, সাহেব?

না।

শুনেই না করে দিচ্ছেন?

এই প্রথম সানগ্লাসটা খুলল দিপু। মুখ থেকে চুইংগাম ফেলল। শুনতে হবে না। আমি জানি কথাটা কী?

বলেন তো কী?

আপনি জানতে চাইবন মেয়েটা আমার কে? কেন এভাবে আমি তার ছবি তুলোম। কেন আমি তার সঙ্গে একটাও কথা বললাম না।

জ্বী। কারেক্ট।

ওসব জানার আপনার কোনও দরকার নেই। আপনি আসুন।

হন হন করে হেঁটে সিঁড়ির দিকে চলে গেল দিপু।

দিপুর দিকে তাকিয়ে জিপঅলা হাসিমুখে বলল, বুঝছি। মাথায় ছিট আছে।

.

০৯.

শৈবালের সুইটগুলোতে সুন্দর লিভিংরুম আছে।

রাতেরবেলা হোসেন সাহেব রঞ্জু আর ছবি বসেছে লিভিংরুমে। হোসেন সাহেব বললেন, এখন বল বউমা, ব্যাপারটা কী? অপরা তোমাকে কী বলল।

ছবি মাথা নীচু করে বলল, ওদের দুজনের অনেকদিনের সম্পর্ক।

তাই নাকি?

জ্বী।

রঞ্জু বলল, ছেলেটার নাম কী?

নাম বলল ছবি।

হোসেন সাহেব বললেন, করে কী সে?

মাস্টার্স দেবে।

কোত্থেকে?

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।

সাবজেক্ট।

বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশান।

রঞ্জু বলল, ফ্যামিলি কেমন?

খুবই ভাল।

অবস্থা?

বিশাল। ধানমন্ডিতে রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি। কিন্তু বাড়িটি মায়ের।

হোসেন সাহেব অবাক হলেন। মানে?

বাবা নেই। গার্জিয়ান হচ্ছেন নানা।

কী করেন তিনি?

বিজনেস।

কিসের?

শিপিং বিজনেস। প্রচুর টাকার মালিক। দিপুর মা তার একমাত্র সন্তান। দিপুও তার মা বাবার একমাত্র সন্তান।

রঞ্জু বলল, অর্থাৎ ঝামেলামুক্ত পরিবার।

ছবি বলল, হ্যাঁ একেবারেই ঝামেলামুক্ত।

হোসেন সাহেব বললেন, বুঝলাম। কিন্তু ছেলেটার স্বভাব চরিত্র আমার পছন্দ হয়নি।

ছবি অবাক হলো। স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে আপনি জানলেন কী করে?

না মানে এভাবে আমাদের পিছু পিছু কক্সবাজার পর্যন্ত চলে এসেছে। সীবিচে মেয়েটিকে ডিস্টার্ব করেছে।

ছবি হাসল। ডিস্টার্ব কিন্তু করেনি, মজা করেছে।

তারপর একটু থেমে বলল, বাবা, আমার কিন্তু দিপুকে খুব ভাল লেগেছে। অপরার জন্য ওর যে প্রচণ্ড টান, তা আমি বুঝতে পেরেছি।

হোসেন সাহেব কোনও কথা বললেন না।

.

১০.

শৈবালের দক্ষিণ দিকে যে সুন্দর পুকুর, ভোরবেলা সেই পুকুরের ঘাটলায় এসে বসে আছে অপরা। মুখটা বিষণ্ণ, চোখে উদাস দৃষ্টি।

নিজের রুম থেকে দৃশ্যটা দেখতে পেল দিপু। দেখে অপরার জন্য একেবারে পাগল হয়ে গেল। প্রায় ছুটে পুকুরঘাটে এল সে।

দিপুকে দেখে স্বরাচ্ছন্ন চোখে তাকিয়ে রইল অপরা।

অপরার পাশে বসে তার একটা হাত ধরল দিপু। রাগ করেছ?

অপরা কথা বলল না।

দিপু বলল, তোমাদের বাড়িতে ফোন করে হতভম্ব হয়ে গেছি। আমি জানি না অথচ তুমি কক্সবাজারে। কাজের মেয়েটা বলল তোমরা পাজেরো নিয়ে গেছ। সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যান করলাম। জিএমজিতে আমার এক সিনিয়র ফ্রেন্ড আছে, তাকে ফোন করে টিকিট ম্যানেজ করলাম। এবং তোমাদের আগে কক্সবাজার।

কিন্তু নাটকটা না করলেও পারতে।

কেন? কী হয়েছে?

সবাই তোমার কথা জেনে গেল।

আমি তো জানাতেই চেয়েছি।

কী?

হ্যাঁ। তোমাকে ছেড়ে আর একটি মুহূর্তও আমি থাকতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হয়। আমার খুব অস্থির লাগে।

দিপুর কথায় দিপুর জন্য আশ্চর্য এক মমতায় বুক ভরে গেল অপরার। ডান হাতে দিপুর গালটা একটু ছুঁয়ে দিল সে। আমারও লাগে। আমারও খুব কষ্ট হয়। রাতে ঘুম হয় না। শুধু তোমার কথা মনে পড়ে। এখানে এসে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত খুব মন খারাপ ছিল।

একটু থামল অপরা। তারপর হৃদয়ের গভীর থেকে বলল, দিপু, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।

দুই করতলে দিপু তারপর অপরার মুখখানি তুলে ধরল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে অপরার মতো করেই বলল, আমিও তোমাকে খুব ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব।

.

১১.

দিপুর রুমের একদিককার দেয়ালে সাইত্রিশটি ছবি পেস্ট করা।

একেকটি একেক সাইজের। ফলে দেয়াল প্রায় ভরে গেছে। আর দেয়ালটি দিপুর বিছানার মুখোমুখি হওয়ায় বিছানায় শুয়েই ছবিগুলো দেখতে পায় সে।

একজন মানুষেরই বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবি। তবে একই পোশাকের, একই লোকেশানের।

লোকেশান হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রতীর। সময় পড়ন্ত বিকেল। সমুদ্রজলে শেষ সূর্যের আভা। বহুদূর সমুদ্রে আকাশ থেকে আস্তেধীরে নামছে দিন শেষের সূর্য।

বিছানায় শুয়ে দিপু এখন অপলক চোখে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। দিপুর মা রেখা এসে দরজায় নক করলেন। এই শব্দে চোখে পলক পড়ল দিপুর। বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে দিপু বলল, কে?

বাইরে থেকে রেখা বললেন, আমি।

ও মা! এসো।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন রেখা। ঢুকেই দেয়ালে পেস্ট করা ছবি দেখে অবাক হলেন। এ কি?

দিপু সরল গলায় বলল, কী আবার? দেখতে পাচ্ছ না, ছলি।

কিন্তু কার ছবি?

অপরার।

রেখা অবাক হলেন। অপরা কে?

দেখছ না একটি মেয়ে।

তা দেখছি। নাম অপরা?

হ্যাঁ।

অদ্ভুত নাম তো!

অদ্ভুত মানে?

অপরা। শুনলেই অপয়া মনে হয়।

দিপু গম্ভীর হল। বাজে কথা বলো না। অপরা মানে জান?

না।

যে পর নয়।

বুঝলাম। কিন্তু মেয়েটা কে?

দিপু হাসল। আগেই তো বলে দিলাম যে পর নয়।

রেখা সরল গলায় বললেন, তারপরও আমি বুঝতে পারিনি।

বুঝতে পারনি?

না।

দিপু কেমন বিরক্ত হল। তুমি চট করে সব বুঝতে পার না কেন মা?

দিপুর পাশে বসলেন রেখা। পারছি না যখন, বুঝিয়ে বল।

তোমার বউ হবে।

একথায় মোটেই চমকালেন না রেখা। নির্বিকার গলায় বললেন, তাই নাকি?

হ্যাঁ।

রেখা কথা বললেন না। দিপুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

দিপু বলল, কেন? তোমার পছন্দ হয়নি।

রেখা গম্ভীর গলায় বললেন, না।

কী?

হ্যাঁ পছন্দ হয়নি।

দিপু বেশ উত্তেজিত হলো। বিছানায় উঠে বসল। অপরাকে তোমার সত্যি পছন্দ হয়নি?

বললাম তো! সত্যি পছন্দ হয়নি।

আর ইউ সিওর?

সিওর না হয়ে কেউ পছন্দ অপছন্দর কথা বলে!

দিপু যেন নিভে গেল। স্নান গলায় বলল, কিন্তু মা, অপরা খুব সুন্দর। মেয়ে।

রেখা আগের মতোই নির্বিকার গলায় বললেন, আমার মনে হচ্ছে না।

আমি বলছি, সে সত্যি খুব সুন্দর মেয়ে।

হতে পারে। হয়তো ছবিগুলোই ভাল হয়নি। অনেক সুন্দরী মেয়ে আছে যাদের ক্যামেরা ফেস ভাল না। এমনিতে দেখল মাথা খারাপ হয়ে যায় কিন্তু ছবি দেখলে বিরক্ত লাগে। মোটেই সুন্দর মনে হয় না।

হ্যাঁ কারও কারও ক্ষেত্রে এরকম হয়। কিন্তু অপরার ছবিগুলো কিন্তু আমার খুব ভাল লাগছে।

তুই তুলেছিস?

হ্যাঁ।

নিজের তৈরি ঘি সব গোয়ালাই ভাল বলে।

তাহলে অপরাকে তোমার সামনা সামনি দেখা উচিত।

দেখা।

তোমার কাছে নিয়ে আসব?

আনতে পারিস।

বলেই উঠলেন রেখা।

দিপু বলল, কিন্তু তুমি আমার রুমে এসেছিলে কেন?

কী যেন বলতে এসেছিলাম।

বল।

এখন আর মনে নেই।

বলে একেবারেই নির্বিকার ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন রেখা।

মায়ের আচরণে দিপু খুবই অবাক হলো।

.

১২.

সব শুনে অপরা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

দিপুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার খুব ভয় করছে।

কেন?

ছবি দেখে মা আমাকে পছন্দ করেননি।

বাস্তবে দেখলে নিশ্চয় করবেন।

যদি না করেন?

আমার মনে হয় করবেন।

এজন্যই আমার ভয় করছে।

কিচ্ছু হবে না। তুমি চল।

নিজের অসম্ভব সুন্দর চোখ তুলে দিপুর দিকে তাকাল অপরা। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

সিওর।

যদি তোমার মা আমাকে পছন্দ না করেন তাহলে তুমি কী করবে?

দিপু একটু চিন্তিত হলো। বুঝতে পারছি না।

আমি বুঝতে পারছি।

কী বলো তো?

তুমি আমাকে …..।

কথাটা শেষ করল না অপরা।

দিপু আগের মতোই চিন্তিত গলায় বলল, মা চায়নি এমন কাজ আমি কখনও করিনি।

একথা আমি জানি। জানি বলেই বললাম।

অপরার এই কথাটি যেন শুনতেই পেল না দিপু। নিজের কাছে বলার মতো করে বলল, মাকে কখনও দুঃখ দিইনি আমি।

দিপুর মন অন্যদিকে ঘোরাবার জন্য অপরা বলল, তোমার জন্য একটা সুসংবাদ আছে।

দিপু অপরার দিকে তাকাল। কী?

আমাদের বাড়ির সবাই তোমাকে দেখে মুগ্ধ।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তোমার ব্যাপারে কারও কোনও আপত্তি নেই।

বুঝলাম। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কোথাও না কোথাও একটা প্যাঁচ লেগেই যায়।

মানে?

এই যেমন আমার মায়ের দিকটায় লাগল। তবে মা যদি কিছুতেই রাজি না হয় তারপরও একটা পথ আমার আছে।

কী?

নানাকে ধরব।

তিনি তোমার কথা রাখবেন?

অবশ্যই। আমি হচ্ছি আমার নানার জান। তিনি কিছুতেই আমার কথা ফেলবেন না।

তারপর অপরার একটা হাত ধরল দিপু। চল।

অপরা আর কোনও কথা বলল না।

কিন্তু দিপুদের বাড়ির সিঁড়িতেই মঈনুল সাহেবের মুখোমুখি পরে গেল ওরা।

মঈনুল সাহেব সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলেন। নিশ্চয় কোথাও বেরুচ্ছেন তিনি। পরনে ক্রিম কালারের সুন্দর স্যুট। ধপধপে সাদা শার্ট আর গাঢ় নীল রংয়ের টাই। পায়ে চকচকে জুতো। গা থেকে চমৎকার পারফিউমের গন্ধ আসছে। সব মিলিয়ে চমৎকার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ তিনি।

দিপু এবং অপরাকে দেখে নাকের দিকে নেমে আসা চশমাটা চোখের দিকে ঠেলে দিলেন তিনি।

সঙ্গে সঙ্গে অপরাকে দিপু বলল, এই হচ্ছেন আমার নানা। মঈনুল চৌধুরী। শিপিং বিজনেস করেন।

অপরা নরম লাজুক ভঙ্গিতে সালাম দিল।

মঈনুল সাহেব বললেন, তোমাকে আমি ঠিক …..।

দিপু বলল, ও হচ্ছে অপরা?

অপরা?

হ্যাঁ।

বাহ খুব সুন্দর নাম। একেবারেই আনকমন।

তারপর দিপুর দিকে তাকালেন তিনি। তুই না বললেও আমি বুঝতে পারতাম ও হচ্ছে অপরা।

দিপুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। কী করে? মা তোমাকে বলেছে?

না। ওকে নিয়ে রেখার সঙ্গে আমার কোনও কথা হয়নি।

দিপু হতাশ হলো। তাহলে?

ওর মুখ দেখলেই বোঝা যায় ও অপরা।

তোমার কথার অর্থ আমি বুঝতে পারছি না নানু।

মঈনুল সাহেব হাসলেন। ওর মুখটা অতি আপন। এই ধরনের মুখের মানুষ কখনও পর হতে পারে না।

মঈনুল সাহেব অপরার দিকে তাকালেন। যাও উপরে যাও।

দিপু বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

আমার একটা মিটিং আছে।

মঈনুল সাহেব নেমে গেলেন।

.

১৩.

আলতো ভঙ্গিতে অপরার চিবুকে হাত দিলেন রেখা।

মুখখানি তুলে ধরলেন। তারপর মুগ্ধ চোখে অপরার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

একটুখানি দূরে মুখে গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিপু।

রেখা একবারও দিপুর দিকে তাকালেন না। মুগ্ধ গলায় অপরাকে বললেন, ছবির চে’ তুমি অনেক বেশি সুন্দর।

এই বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই বুকটা চিব ঢিব করছিল অপরার। মঈনুল সাহেবের কথায় প্রাথমিক ভয়টা তার কেটেছিল। এখন রেখার কথায় একেবারেই ভারমুক্ত হয়ে গেল সে। বুকের ঢিবঢিবানিটা বন্ধ হলো। মনটা আশ্চর্য এক ভাল লাগায় ভরে গেল।

রেখা বললেন, এমনও হতে পারে দিপু তোমার ছবিগুলো ঠিক মতো তুলতে পারেনি।

দিপুর মুখ থেকেও ততোক্ষণে টেনশান উধাও। অস্বস্তি কেটে যাওয়া গলায় বলল, আমি ছবি খুব ভাল তুলি মা।

এবার দিপুর দিকে তাকালেন রেখা। আবার কি সেই গোয়ালের উপমাটা দেব?

না না দরকার নেই।

অপরা ঠোঁট টিপে হাসল।

রেখা দিপুকে বললেন, তুই আর এখন কোনও কথা বলবি না।

দিপু বাধ্য শিশুর মতো বলল, আচ্ছা।

রেখা আবার অপরাকে নিয়ে ব্যস্ত হলেন। তোমাকে দেখে আমার মন ভরে গেছে মা। অনেকদিন পর বাড়িটা যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। দিপুর বাবা বেঁচে থাকলে তিনি যে আজ কী খুশি হতেন!

দিপু ভুলে গেল মা তাকে কথা বলতে বারণ করেছেন। বেশ উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, বাবা নেই তো কী হয়েছে? বাবার অভাব আমি কখনও ফিল করিনি। আমার তুমি আছ, নানু আছেন।

তারপর একটু থামল দিপু। মা, অপরাকে তোমার পছন্দ হয়েছে?

এবার হাসিমুখে ছেলের দিকে তাকালেন রেখা। ছবি দেখেই পছন্দ হয়েছিল।

দিপু যেন আকাশ থেকে পড়ল। কী?

হ্যাঁ।

তাহলে যে বললে …..।

বাস্তবে দেখার জন্যই তোর সঙ্গে অমন ব্যবহার করেছিলাম।

সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মতো ছুটে গিয়ে রেখাকে জড়িয়ে ধরল দিপু। আমার খুব ভাল লাগছে মা, খুব ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে, তোমাকে একটু কোলে নিই।

ধুৎ পাগল।

সত্যি। মনে হচ্ছে কোলে নিয়ে তোমাকে শিশুর মতো দোলাই।

দিপুর কাণ্ড দেখে অপরা তখন মুখ নীচু করে হাসছে।

দিপুর হাত ছাড়িয়ে দিতে দিতে রেখা বললেন, পাগলামো করিস না। ছাড়।

মাকে ছেড়ে দিল দিপু।

রেখা দরজার দিকে পা বাড়ালেন। অপরাকে বললেন, তুমি বসো মা। আসছি।

রেখা বেরিয়ে যাওয়ার পর অপরার সামনে এসে দাঁড়াল দিপু। বিশাল করে একটা হাঁপ ছাড়ল।

অপরা বলল, কী হল?

বুকের ওপর হাজারমনি একটা পাথর চেপেছিল। সেই পাথরটা নেমে গেছে।

অপরা মিষ্টি করে হাসল। আমারও একই অবস্থা।

আমি আমার মাকে খুব ভালবাসি। মাকে অত খুশি দেখে তাকে আমার কোলে নিতে ইচ্ছে করছিল।

তাতো শুনলামই।

আমি জানি তুমি শুনেছ। কারণ তোমার সামনেই তো বললাম।

তাহলে এখন আবার বলছ কেন?

অন্য কারণে।

কী কারণ?

এখন ইচ্ছে করছে তোমাকে কোলে নিতে।

যাহ।

সত্যি।

আমি কি শিশু যে আমাকে তুমি কোলে নেবে।

অপরার মুখের কাছে মুখ নিয়ে দিপু বলল, না তুমি শিশু নও। তুমি হচ্ছ আমার ভবিষ্যৎ শিশুর মা।

কিছুক্ষণ পরই এই রুমে ফিরে এলেন রেখা। তার হাতে ভেলভেটের ছোট্ট একটা অর্নামেন্ট বক্স। অপরার পাশে বসে বক্সটা খুললেন তিনি। ডায়মন্ডের সুন্দর একটা নাকফুল বের করলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে বিজনেসের কাজে বেলজিয়াম গিয়েছিলেন দিপুর বাবা। তুমি নিশ্চয় জানো ডায়মন্ড সবচে’ ভাল পাওয়া যায় বেলজিয়ামে। সেখান থেকে তিনটি ডায়মন্ড এনেছিলেন। তার একটি দিয়ে নিজেই এই নাকফুলটা করিয়ে ছিলেন। করিয়ে ছিলেন আমার জন্যই। কিন্তু আমার কখনও পরা হয়নি। তিনি মারা গেলেন, তারপর তো আর নাকফুল পরা যায় না। তখন থেকে ভেবে রেখেছি, এটা পরবে আমার ছেলের বউ।

দিপু অবাক গলায় বলল, কিন্তু অপরা পরবে কী করে?

রেখা বললেন, কেন? অসুবিধা কী?

ওর তো নাকে ফুটোই নেই।

অপরা লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নীচু করল। ফুটো একবার করিয়ে ছিলাম, বন্ধ হয়ে গেছে।

রেখা বললেন, নাকফুল ব্যবহার না করলে কখনও কখনও এমন হয়।

হাত বাড়িয়ে নাকফুলটা নিল অপরা। আর হবে না। নাক আমি আবার ফুটো করিয়ে নেব।

.

১৪.

দিপু বলল, নাক ফুলটায় তোমাকে খুব মানিয়েছে।

অপরা বলল, আমি জানি।

কে বলেছে?

ভাবী।

তার বলা আর আমার বলা এক হলো?

না তা নয়।

তাহলে?

এমনি বললাম।

অপরা মিষ্টি করে হাসল। এই নাকফুল পরার জন্য কী কষ্ট করেছি জান?

জানি।

কী বল তো?

নতুন করে নাক ফুটো করিয়েছ।

তাতে আমার কষ্ট হয়েছে না?

না হয়নি।

মানে?

আজকাল নাককান ফুটো করতে কোনও কষ্ট নেই। বিউটি পারলারগুলোতে গেলেই একধরনের স্প্রে করে, যেগুলো লোকাল এনেসথেসিয়ার কাজ দেয় তারপর সুট করে ফুটো করে ফেলে।

বাবা তুমি এত কিছু জানো?

জ্বী।

তারপরই কেমনে অস্থির হলো দিপু। ইস চোখের পলকে যদি পরীক্ষাটা হয়ে যেত, চারটা মাস যদি কেটে যেত।

দিপুর অস্থিরতাটা বুঝল অপরা। তারপরও বলল, তুমি এত অস্থির হয়েছ কেন?

তোমাকে ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করে না।

আমার করে?

তাতো আমি জানি না। আমি শুধু আমারটাই জানি।

আমার অবস্থাও তোমার মতোই।

এই, বিয়ের পর আমাদের প্রতিটি দিন কীভাবে শুরু হবে?

অপরার গলা স্বরাচ্ছন্ন হয়ে গেল। সকালবেলা উঠেই আমি তোমার জন্য চা নিয়ে আসব।

তারপর?

তুমি তখনও ঘুমে। কিন্তু আমি তোমাকে শব্দ করে ডাকব না। আলতো করে ছুঁয়ে দেব তোমার গাল।

তোমার স্পর্শে আমি চোখ মেলে তাকাব। চায়ের কথা ভুলে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকব। বুঝতেই পারব না দৃশ্যটি বাস্তব না স্বপ্ন।

হ্যাঁ, ঠিক তাই।

তুমি আমাকে রান্না করে খাওয়াবে না?

আমি রাধতে পারি না।

আমার জন্য শিখে নিও।

নেব। প্রতিদিন খুব যত্ন করে তোমাকে খাওয়াবো।

তুমি আমার সঙ্গে খাবে না?

না।

কেন?

আমি খাব তোমার খাওয়া শেষ হলে।

দিপু আবার বলল, কেন?

তুমি খেতে বসেছ, অমনি চলে গেছে ইলেকট্রিসিটি। হাত পাখায় তখন আমি তোমাকে বাতাস করব।

আমার জন্য এত কষ্ট কেন করবে তুমি?

আমি যে তোমাকে ভালবাসি।

ভালবাসলে এত কষ্ট করতে হয়?

এটা যে কষ্ট একথা তোমাকে কে বলেছে?

দিপু কথা বলল না।

অপরা আগের মতোই স্বরাচ্ছন্ন গলায় বলল, রাতের বেলায় তোমার যেদিন ঘুম আসবে না, মাথায় হাত বুলিয়ে আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব।

তাহলে তুমি ঘুমোবে কখন?

তুমি ঘুমোবার পর।

তখন তোমার নিজেকে একা মনে হবে না?

না। কারণ আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে রাখব যে।

আমার ওপর রাগ করে কখনও বাপের বাড়ি চলে যাবে না তো?

বাপের বাড়ি যাব না।

তাহলে?

গেলে চাচার কাছে চলে যাব।

দিপু অবাক হলো। তোমার চাচা আছেন নাকি?

হ্যাঁ আছেন।

কখনও বলনি তো!

বলা হয়নি।

কেন?

কারণ বাবা তাঁর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখেননি।

বল কী?

হ্যাঁ।

কেন?

একমাত্র ছোটভাইর সঙ্গে জায়গা সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ হয়েছিল বাবার। বাবার অমতে চাচা তার অংশ বিক্রি করে কোনও এক মফস্বল শহরের পাশে গিয়ে স্কুল করেছেন।

স্কুল করা খারাপ কী?

বাবা হয়তো তা চাননি।

চাচার বাড়িও কি ওখানে?

হ্যাঁ।

সংসারে কে কে আছে?

অপরা হাসল। সংসারই নেই।

দিপু অবাক হলো। মানে?

চাচা বিয়েসাদি করেননি। স্কুলটাই তার জীবন।

তার মানে তোমাদের কারও সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।

একজনের সঙ্গে আছে।

কার সঙ্গে?

বুঝতেই পারছ।

তোমার সঙ্গে?

হ্যাঁ।

তোমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়?

না। তিনি আমাকে চিঠি লেখেন।

মুখের মজাদার একটা ভঙ্গি করল দিপু। তো আমার সঙ্গে রাগ করে তুমি সেই চাচার কাছে চলে যাবে?

অপরা মাথা নাড়ল।

তারপর বলল, কিন্তু এখন যে আমাকে একটু সোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে।

কেন?

নোট নিতে হবে।

তা দিচ্ছি কিন্তু তুমি বাড়ি ফিরবে কী করে?

ওসব তোমার ভাবতে হবে না।

তাহলে কে ভাববে?

আরে বাবা, সোমাদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি কাছেই। রিকশা করে চলে যাব।

বুঝলাম। কিন্তু ভাবতে হবে না বলছ কেন? তোমার সবকিছু নিয়ে ভাবতে চাই আমি। তোমার বলা প্রতিটি কথা, প্রতিটি বিষয় এমন করে মনে গেঁথে থাকে আমার, তুমি যখন পাশে না থাকো তখন শুধু ওসবই ভাবি। আমার মাথা জুড়ে, মন জুড়ে, চোখ জুড়ে শুধু তুমি তুমি তুমি।

দিপুর চোখের দিকে তাকিয়ে গভীর মায়াবি হাতে তার গালটা একটু ছুঁয়ে দিল অপরা।

বনসীমান্ত

০১.

গ্রামের কাছাকাছি এসে বাদল টের পেল সে আর ছুটতে পারছে না।

পা দুটো ভেঙে আসছে বাদলের, বুকটা হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে আর মাথাটা যেন চরকির মতো ঘুরছে।

তবু নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করল সে। প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল। কিন্তু গ্রামে ঢোকার মুখে যে মাঠ সেই মাঠের ধারে এসে লুটিয়ে পড়ল সে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

মাঠের ওপারে গ্রামের মসজিদ।

ফজরের নামাজ শেষ করে মাত্র বেরিয়েছেন মির্জা সাহেব। তাঁর সঙ্গে জলিল মোতালেব সোনামিয়া ও তালেব। ছুটতে ছুটিতে মাঠপারে এসে যে একজন মানুষ লুটিয়ে পড়ল এই দৃশ্যটা প্রথমে দেখলেন মির্জা সাহেব। অবাক হয়ে সঙ্গের লোকদের দিকে তাকালেন তিনি। ব্যাপারটা

কী? কে ওইভাবে পড়ে গেল?

ততোক্ষণে অন্যদের চোখেও পড়েছে দৃশ্যটা।

তালেব বলল, চলেন তো দেখি।

চারজন মানুষ পা চালিয়ে বাদলের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর বাদলকে দেখে দিশেহারা হয়ে গেল।

মির্জা সাহেব বললেন, আরে এ তো বাদল! আমার ছেলে?

তারপর দুহাতে বাদলকে প্রায় কোলে টেনে নিলেন তিনি। বাদল, বাবা, বাবা, তুই কোত্থেকে এলি? কী হয়েছে?

ততোক্ষণে মাঠপারে ম্যালা লোকজন। মির্জা বাড়ির পুরনো গোমস্তা নবু, দশ বারো বছরের কাজের ছেলে বিলু।

বাদালের মুখের দিকে তাকিয়ে নবু বলল, ভাইয়ে ফিট হইয়া গেছে। একদম ফিট হইয়া গেছে।

মির্জা সাহেব অস্থির গলায় বললেন, কিন্তু বাদল তো ছিল ঢাকায়। সূর্যসেন হলে থাকে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। সে এভাবে কোত্থেকে এল?

সোনামিয়া বলল, এইসব কথা পরে বলেন। আগে জলধর ডাক্তাররে খবর দেন।

মির্জা সাহেব বিলুর দিকে তাকালেন। বিলু, তুই যা। তাড়াতাড়ি গিয়া জলধররে নিয়া আয়।

সঙ্গে সঙ্গে জলধর ডাক্তারের বাড়ির দিকে ছুটল বিলু।

জলধরকে নিয়ে বিলু যখন ফিরল বাদলকে ততোক্ষণে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। বড়ঘরের পালঙ্কে শুয়ে আছে সে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। তার চারপাশে প্রচুর লোকজন। মির্জা সাহেব, তাঁর স্ত্রী বকুল এবং তেরো চৌদ্দ বছরের মেয়ে খুকি। খুকি এবং বকুল দুজনেই কাঁদছে। বকুল বিলাপের সুরে বলছেন, হায় হায় কী হল আমার ছেলের! বাদল, বাদল!

জলধর ডাক্তার আস্তেধীরে পানির ছিটা দিচ্ছিলেন বাদলের মুখে।

এক সময় চোখ খুলল বাদল। চোখ দুটো টকটকে লাল, এবং সেই চোখে আতংকিত দৃষ্টি। ভয়ার্ত ভঙ্গিতে সে বলল, আমি কোথায়? এ্যা, কোথায় আমি? কোথায়?

ছেলের মুখের ওপর ঝুঁকে বকুল বললেন, বাড়িতে বাবা। তুমি এখন বাড়িতে।

বাড়িতে এসে পড়েছি?

মির্জা সাহেব বললেন, হ্যাঁ বাবা। বাড়িতে এসে পড়েছ।

এবার মির্জা সাহেবের দিকে তাকাল বাদল। বাবা, বাবা…

কথা শেষ না করে মায়ের দিকে তাকাল। মা মা, সব শেষ হয়ে গেছে মা। সব শেষ হয়ে গেছে। হলের একটি ছেলেও বেঁচে নেই। যাকে যাকে পেয়েছে সবাইকে গুলি করে মেরেছে। সবাইকে।

বলিস কী?

হ্যাঁ মা। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় লাশ। শুধু লাশ, শুধু লাশ। রাত দুপুরে লাশের ওপর দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে সদরঘাট পর্যন্ত এসেছি। তারপর নদী পার হয়ে….।

বাদলের কথা শুনে আতঙ্কিত গলায় জলধর বললেন, সর্বনাশ! ঢাকায় আর্মি নেমে গেছে? কিলিং শুরু হয়ে গেছে?

বাদল বলল, ডাক্তার কাকা, ডাক্তার কাকা, হলের মেয়েদেরকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে। রাজারবাগে পুলিশদের সঙ্গে ওদের যুদ্ধ হয়েছে। মানুষ মেরে শেষ করে ফেলেছে ওরা। আমি কোনও রকমে বেঁচে এসেছি।

জলধর চিন্তিত গলায় বললেন, বঙ্গবন্ধুর কথা মতো এখন তাহলে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।

.

০২.

বনসীমান্ত গ্রামের স্কুল মাঠ আজ লোকে লোকারণ্য।

মাঠের মাঝখানে লম্বা একখানা বাঁশ পোতা। কিছুদিন আগেও এই বাঁশের মাথায় উঠে যেত পাকিস্তানি পতাকা। স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা সার ধরে দাঁড়িয়ে গাইতো ‘পাক ছার জমিন’।

সেই বাঁশের মাথায় বাদল আজ তুলছে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা। এই দৃশ্য দেখতে বনসীমান্তের লোকজন তো বটেই, চারপাশের গ্রামের লোকজনরাও এসে জুটেছে।

বাদলের অদূরে সার ধরে দাঁড়িয়ে আছে পনের বিশজন যুবক। তাদের সঙ্গে কয়েকজন মধ্যবয়সীও আছে। প্রত্যেকের হাতে বাঁশের লাঠি। দূরে ভিড় করে আছে মানুষজন। নবু এবং বিলুও আছে।

পতাকা তোলা শেষ করে পতাকার উদ্দেশে স্যালুট করল বাদল। তার দেখাদেখি সার ধরে দাঁড়ানো যুবকরাও করল।

ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ানো বিলুর খুব ভাল লাগল ব্যাপারটা। সেও বাদলের মতো করে স্যালুট করল পতাকাকে।

.

০৩.

খালেকের চায়ের দোকানে আজকাল ভিড়টা যেন একটু বেশি হয়।

বাজারের তিনটি চায়ের দোকানের মধ্যে তার দোকানে ভিড় বেশি হওয়ার কারণ খালেকের দোকানে একটা ট্রানজিস্টার আছে। মারফি কোম্পানীর লাল রংয়ের ট্রানজিস্টার। যতক্ষণ দোকান খোলা ততোক্ষণ ট্রানজিস্টারটা সে বাজায়। ওই শুনতে গাহাকরা ভিড় করে।

আজ বিকেলে দোকানে বসে ট্রানজিস্টারের নব ঘোরাচ্ছে খালেক। দোকানে গাহাক আছে ভালই। কিন্তু কে কে আছে না আছে সেদিকে যেন খেয়াল নেই খালেকের।

খালেকের মনোযোগ আকর্ষণের জন্যই কি না কে জানে, তালেব বলল, খালেক, তুমি কি আকাশবাণী কলিকাতা ধরতাছ?

খালেক কথা বলল না।

জলিল বলল, রেডিও পাকিস্তান ঢাকা ধর মিয়া।

এবার জলিলের দিকে তাকাল খালেক। ক্যান?

ঢাকার খবর হইল আসল খবর।

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল মোতালেব। কে কইছে তোমারে?

আমি জানি।

তুমি জানো কচু। ঢাকার খবর আসল খবর না। আসল খবর হইল আকাশবাণীর।

তালেব বলল, বিবিসি, ভয়েজ অব আমরিকা, এইসব জাগার খবরও ঠিক।

মোতালেব বলল, হ। রেডিও পাকিস্তানের খবর ঠিক না।

একথার সঙ্গে সঙ্গে মোতালেবকে সাপোর্ট করল সোনামিয়া। হ মাস্টারের কথা ঠিক। মেলেটারিরা যে মানুষ মাইরা সাফা কইরা ফালাইতাছে এই খবর রেডিও পাকিস্তান থিকা কয় না।

খালেক বলল, রেডিও পাকিস্তান থিকা খালি কার্ফুর খবর কয়।

জলিল বলল, ধর না! কার্ফুর খবরই হুনি।

মনে হয় অধিবেশন শেষ হইয়া গেছে।

ট্রানজিস্টার বন্ধ করে দিল খালেক।

তখনই লাঠি ভর দেয়া ভিক্ষুক জমির এসে দোকানের সামনে দাঁড়াল। আল্লার ওয়াস্তে খয়রাত দেন বাবারা।

তালেব খেকুড়ে গলায় বলল, মেলিটারিরা দেশ শেষ কইরা ফালাইতাছে আর তুই চাস খয়রাত? যা ভাগ।

.

০৪.

এই বটগাছটা কতকালের পুরনো কে জানে!

জন্মের পর থেকে বাদল তো এরকম দেখছেই, বাদলের বাবা মির্জা সাহেবও নাকি তাঁর জন্মের পর থেকেও এরকমই দেখছেন। বাদল তার দাদীর মুখে শুনেছিল তার দাদাও নাকি জন্মের পর থেকে এমনই দেখছে গাছটা।

তার মানে কত বছর বয়স হবে এই গাছের?

একশো সোয়াশো বছর!

তবে গাছটি আছে বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে, অনেকখানি জায়গা নিয়ে। অনেকখানি জায়গা ছায়াময় করে রেখেছে সে।

আজ দুপুরবেলা এই বটতলায় এসে বসেছে বাদলরা চারজন। বাদল আলমগির সুজন আর মন্টু।

বাদল বলল, একজন অভিজ্ঞ লোক দরকার।

আলমগির বলল, কী ব্যাপারে?

আমাদের ট্রেনিংয়ের জন্য।

সুজন বলল, অর্থাৎ আমাদেরকে ট্রেনিং দেয়াতে পারবে?

হ্যাঁ। আমরা তো আসলে কিছুই জানি না।

ঠিকই বলেছিস। এভাবে কাজ হবে না।

আলমগির বলল, কীভাবে কাজ হবে বাদলের তা জানার কথা।

মন্টু বলল, হ্যাঁ বাদল শিক্ষিত ছেলে।

বাদল বলল, আমি শুনেছি দেশের সব জায়গায় ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে। কলকাতা আগরতলা মেলাঘর চলে যাচ্ছে আমাদের বয়সী ছেলেরা। ওসব জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং চলছে।

আলমগির বলল, চল তাহলে আমরাও চলে যাই।

আর কয়েকটা দিন দেখি।

সুজন বলল, তাহলে চল এনামুল ভাইকে গিয়ে ধরি। তিনি ইপিআরে ছিলেন। এইসব ট্রেনিং কেমন করে দেয়াতে হয়, জানেন।

শুনে লাফিয়ে উঠল বাদল। ঠিক বলেছিস। চল।

.

০৫.

ক্রাচে ভর দিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল এনামুল।

ছফিটের কাছাকাছি লম্বা, দশাসই চেহারা তার। মুখে হাসি বলতে নেই। খুবই গম্ভীর ধরনের মুখ।

বাদলের দিকে তাকিয়ে বলল, কী ব্যাপার?

উদ্দেশ্যটা বলল বাদল।

শুনে এনামুল বলল, পাটা এমন ভাঙা ভাঙল, চাকরি আর করতে পারলাম না।

কিন্তু জানেন তো সবই।

হ্যাঁ তা জানি।

ট্রেনিং দেওয়াতে পারবেন না?

অবশ্যই পারব।

একথা শুনে চারজনের মুখেই হাসি ফুটল।

আলমগির বলল, খুব খুশি হলাম এনামুল ভাই।

সুজন গভীর উৎসাহের গলায় বলল, তাহলে আজ থেকেই শুরু করুন।

এনামুল বলল, কিন্তু বাঁশের লাঠিতে তো ট্রেনিং হবে না।

মন্টু হতাশ গলায় বলল, তাহলে?

বন্দুক, রাইফেল এসব জোগাড় কর।

আলমগির বলল, এসব আমরা কোত্থেকে জোগাড় করব?

বাদল বলল, আমি জানি কোত্থেকে জোগাড় করতে হবে।

মন্টু বলল, কোত্থেকে?

দেশের বিভিন্ন থানা থেকে অস্ত্র জোগাড় করছে আমাদের বয়সী ছেলেরা।

এনামুল বলল, এছাড়াও একটা পথ আছে।

কী?

নিজ নিজ এলাকার যেসব বাড়িতে বন্দুক আছে সেসব বন্দুক জোগাড় করা।

জ্বী। ঠিকই বলেছেন।

পুলিশ ইপিআরের জোয়ানরা যার যার অস্ত্র কাঁধে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেইসব অস্ত্র দিয়েও ট্রেনিং হচ্ছে।

বাদল দৃঢ় গলায় বলল, আপনি চিন্তা করবেন না। আমাদের এলাকার সব বন্দুক আমরা নিয়ে নেব।

আলমগির বলল, দরকার হলে থানা লুট করব আমরা।

এনামুল উফুল্ল গলায় বললেন, সাবাস!

.

০৬.

নিজের বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন জলধর ডাক্তার।

পরনে ধুতি আর হাতাঅলা কোড়াগেঞ্জি। গলার পৈতে একপাশে ঝুলছে। পৈতের সঙ্গে প্রায় ঝুলে পড়েছে তার ভুড়ি।

জলধর ডাক্তারের শরীর বেশ মোটা। অত্যন্ত আমুদে ধরনের লোক তিনি। মুখখানা সব সময়ই হাসি হাসি, উজ্জ্বল। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই উজ্জ্বল মুখ কেমন ম্লান, চিন্তিত। হ্যারিকেনের আলোয় খুবই বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। বুকের কাছে তাঁর ছোট্ট একখানা ট্রানজিস্টার। নীচু ভলিউমে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র শুনছিলেন তিনি। এই মাত্র খবর শেষ হলো। সঙ্গে সঙ্গে ট্রানজিস্টার অফ করলেন তিনি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

অদূরে জলধরের মুখোমুখি তাঁর বিধবা মেয়ে মাধবির বিছানা। হাত পা গুটিয়ে বিছানায় বসে আছে মাধবি। বাবাকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখে তাঁর দিকে তাকাল।

জলধর বললেন, না অবস্থা ভাল না।

তা বুঝতে পারছি। ঢাকার খবর কিছু বলল?

ঢাকা শান্ত। তাই নাকি?

হ্যাঁ। ওরা পলিসিটা ধরেছে অন্যরকম। ঢাকায় এখন আর তেমন কিছু করছে না। আর্মি ছড়িয়ে গেছে সারাদেশে। গ্রামে গঞ্জে মফস্বলে।

গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষ মারছে।

মাধবি দুঃখি গলায় বলল, মিলিটারিরাও তো মানুষ! মানুষ হয়ে মানুষ এভাবে মারে কী করে?

জলধর বিছানায় উঠে বসলেন। ওরা মানুষ না। মানুষের মতো দেখতে এক প্রকারের জন্তু। বুড়িগঙ্গার ওপারে, কেরানীগঞ্জ, সুভাই, জিঞ্জিরা এসব এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। ঢাকা আক্রান্ত দেখে ভেবেছে নদীর ওপারে নিরাপদ থাকা যাবে। এপ্রিলের দুই। তারিখে, ভোররাতে হঠাৎ জন্তুগুলো সেখানে আক্রমণ চালায়। তিন চারহাজার লোক মেরে ফেলে এক সকালে। মাঠঘাট আর বাড়ির উঠোনে শুধু লাশ, শুধু লাশ।

শুনে বুকটা তোলপাড় করে উঠল মাধবির। সে খুবই নরম মনের মেয়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ভগবান নিশ্চয় এর বিচার করবে।

ঠিক তখুনি দুম দুম করে শব্দ হলো দরজায়। বাপ মেয়ে দুজনেই চমকাল।

জলধর বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন, কে?

বাইরে থেকে শব্দ এলো। আমি। আমি ডাক্তার কাকা?

তুমি কে?

আমি বাদল। দরজা খোলেন।

গলাটা খুবই চেনা চেনা। তবু দরজা খুললেন না জলধর। বললেন, কোন বাদল?

মির্জা সাহেবের ছেলে।

সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হলেন জলধর। মোটা শরীর নিয়ে প্রায় ছুটে গিয়ে দরজা খুললেন। হাসিমুখে বললেন, তোর গলা আমি চিনতে পারিনি বাবা। কার শরীর খারাপ হলো?

বাদলের হাতে একটা টর্চ। সঙ্গে গ্রামের আরও তিন যুবক। আলমগির সুজন এবং মন্টু। দরজা খোলার পর ঘরের ভেতর থেকে ছিটকে আসা আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না সবার মুখ।

জলধরের কথা শুনে বাদল হাসিমুখে বলল, কারও শরীর খারাপ হয়নি কাকা।

তাহলে?

অন্য একটা কাজে এসেছি।

আয় ঘরে এসে বস।

না কাকা।

কেন? বসে বল।

তারপর মাথা নীচু করল বাদল। আসলে ব্যাপারটা হয়েছে কি কাকা, আপনি তো জানেনই মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে। আমরাও আমাদের গ্রামে, স্কুলের মাঠে ট্রেনিং শুরু করেছি।

তা আমি জানি।

এ ব্যাপারে আমাদেরকে একটু সাহায্য করতে হবে যে!

কী সাহায্য বল?

গ্রামে যার যার বন্দুক আছে ….।

বাদলের কথা শেষ হওয়ার আগেই জলধর বললেন, বন্দুক লাগবে?

জ্বী কাকা?

আমারটা নিয়ে যা। গুলিও আছে অনেক। সেগুলোও নিয়ে যা। তোদের মতো যুবকরাই এখন আমাদের ভরসা। যেমন করে পারিস দেশটাকে বাঁচা।

তারপর মাধবির দিকে তাকালেন জলধর ডাক্তার। মাগো, বন্দুকটা ওদেরকে দিয়ে দে।

বিছানা থেকে নেমে আলমারি খুলল মাধবি।

.

০৭.

সকালবেলা মির্জা সাহেবের কাছারি ঘরে আজকাল বেশ একটা আড্ডা হয়।

আজও হচ্ছে।

গ্রামের বেশ কয়েকজন লোক এসে বসেছে। এই মাত্র ভেতর বাড়ি থেকে চায়ের ট্রে হাতে নবু এল কাছারি ঘরে। ট্রেতে অনেকগুলো চায়ের কাপ।

চায়ে চুমুক দিয়ে তালেব বলল, মির্জা সাহেব, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনেন না?

মির্জা সাহেব তালেবের দিকে তাকালেন। আমি শুনি সবই।

জলিল বলল, কিন্তু এইসব কইরা কিছু হইব না।

মোতালেব বলল, হবে না কেন?

সোনামিয়া হাসল। আপনে জানেন না মাস্টার সাব? জলিল তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায় না।

তালেব বলল, হ। জলিল হইতাছে পকিস্তানের পক্ষের লোক।

মির্জা সাহেব বললেন, যার যে পক্ষ ইচ্ছা সেই পক্ষে থাকবে।

মোতালেব বলল, তবে দুদিন আগে আর পরে, দেশ স্বাধীন হবেই।

সোনামিয়া বলল, তাই নাকি?

হ্যাঁ। এই জাতিকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।

কথাটা শুনে জলিল একেবারে তেড়ে উঠল। আরে রাখেন মিয়া। দাবায়া রাখা যাইব না! পাকিস্তান আর্মি হইতাছে দুনিয়ার সেরা আর্মি। তাগ লগে যুদ্ধ কইরা দেশ স্বাধীন করব এসব দুধের পোলাপান? পাগল হইছেন আপনে?

মোতালেব কথা বলবার আগেই মির্জা সাহেব বললেন, কী যে হবে কিছুই বলা যায় না। কুষ্টিয়ার ওদিকে মুজিবনগর হয়েছে। অস্থায়ী

বাংলাদেশ সরকার গঠন হয়েছে। ওপারে গিয়ে ট্রেনিং নিচ্ছে ছেলেরা।

জলিল বলল, ওইপারে ক্যান, এই পারেও তো ট্রেনিং নিতাছে। আপনের ছেলে বাদল স্কুলের মাঠে বাংলাদেশের নিশান লাগাইছে। ইপিআরের এনামুল, আরে ওই যে লেংড়া এনামুল, সে পোলাপানগ ট্রেনিং দেওয়াইতাছে।

তালেব বলল, আপনের বন্দুকটা দিয়া দিছেননি মির্জা সাব?

না, ওরা এখনও আমারটা চায়নি।

জলিল বলল, চাইলেও দিবেন না।

মোতালেব বলল, কেন?

চোখ পাকিয়ে মোতালেবের দিকে তাকাল জলিল। সেইটা আপনেরে কমু না। যারে কওনের তারেই কইতাছি। তার লগে আপনেও শোনেন।

তারপর মির্জা সাহেবের দিকে তাকাল জলিল। বাদলরে আপনে মানা করেন। এইসব ঠিক হইতাছে না। থানায় থানায় মেলিটারি আসতাছে। যদি তারা খবর পায় বনসীমান্ত গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং হইতাছে তাইলে কিন্তু যখন তখন আইসা গ্রাম জ্বালাইয়া দিব। যারে পাইব তারেই গুলি কইরা মারব।

মির্জা সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, কথা ঠিক।

তালেব বলল, আপনে তাইলে …….।

তালেবের কথা শেষ হওয়ার আগেই হাত তুলে তাকে থামাল জলিল। তুই রাখ, আমি কই। মির্জা সাহেব বনসীমান্ত বাঁচাইতে চাইলে বাদলরে আপনে ফিরান।

জলিলের কথা শুনে মির্জা সাহেব চিন্তিত হয়ে গেলেন।

.

০৮.

স্কুল মাঠে পত পত করে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

তার তলায় ক্রাচ হাতে দাঁড়িয়ে আছে এনামুল। অদূরে সবুজ ঘাসের ওপর বন্দুক হাতে ক্রলিং করছে বাদল আলমগির মন্টু সুজন। চারজনের পরনেই প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি। গরমে ঘামে শরীর ভিজে জবজব করছে। তবু মুখে কঠিন কঠোর প্রত্যয় যেন প্রত্যেকের।

ঘণ্টাখানেক পর ট্রেনিং শেষ করে এনামুলের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা।

এনামুল বলল, তোমরা পারবে।

বাদল বলল, পারতে আমাদেরকে হবেই।

কিন্তু তোমাকে আমার অন্য একটা কথা বলার আছে।

বলুন।

গ্রামে যে এখনও একটা বন্দুক রয়ে গেছে সেটা জোগাড় করনি কেন?

বাদল মাথা নীচু করল। বাবার বন্দুকটার কথা বলছেন?

হ্যাঁ।

এখনও বাবারটা আমি চাইনি।

কেন?

তেমন কোনও কারণ নেই।

কিন্তু প্রথমেই তো তারটা নেয়া উচিত ছিল।

আলমগির বলল, আসলে বাদল ওর বাবাকে খুব ভয় পায়।

সুজন বলল, বাবার সঙ্গে সরাসরি সেভাবে কথাই বলে না বাদল।

মন্টু বলল, আমরা ছোটবেলা থেকেই জানি বাদলের যা কিছু দরকার তা ও ওর মাকেই বলে।

এনামুল বলল, বন্দুকটার কথাও তাহলে মাকেই বল।

বাদল আগের মতোই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

আলমগির বাদলের দিকে তাকাল। হ্যাঁ মাকেই বল বাদল।

সুজন বলল, এনামুল ভাইর সঙ্গে আমিও একমত। উচিত ছিল। তোদের বাড়ির বন্দুকটাই আগে জোগাড় করা।

এনামুল বলল, এ কদিন আমি তোমাকে ইচ্ছে করেই বলিনি বাদল।

এবার মুখ তুলল বাদল। কেন?

দেখতে চেয়েছি তুমি কী কর।

বাদল লাজুক গলায় বলল, আপনার কথা আমি বুঝেছি।

এনামুল গম্ভীর গলায় বলল, বুঝে থাকলে আর কিছু বলার নেই। আশা করি বন্দুকটা তুমি আজই নিয়ে নেবে।

কিন্তু বাদলের কথা শুনে বকুল গম্ভীর হয়ে গেলেন। তোর বাবাকে এসব কথা আমি বলতে পারব না।

বাদল বলল, কেন?

রাগি মানুষ। আমার ওপর রেগে যাবেন।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মা এবং ভাইয়ের কথা শুনছে খুকি। বকুল এবং বাদল কেউ তা খেয়াল করল না।

বাদল বলল, কিন্তু আমি কোনও অন্যায় আবদার করছি না মা।

তা আমি জানি।

গ্রামে যার যার বন্দুক আছে তাদের প্রত্যেকেরটাই আমরা নিয়ে নিয়েছি। এই তো সেদিন ডাক্তার কাকারটা নিয়ে এলাম। চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিলেন।

বুঝলাম। তুই তাহলে একটা কাজ কর, নিজে গিয়ে তোর বাবাকে বল।

বাদল বেশ বিরক্ত হলো। ঠিক আছে, আমিই বলব।

খুকির পাশ দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল বাদল।

খুকির মুখটা তখন কী রকম চিন্তিত দেখাচ্ছে। বাদলকে গিয়ে কাছারি ঘরে ঢুকতে দেখল সে। তারপর নিজেও কাছারি ঘরের দিকে পা বাড়াল।

কিন্তু খুকি পৌঁছার আগেই কথাটা মির্জা সাহেবকে বলে ফেলেছে বাদল। খুকি এসে দরজার সামনে দাঁড়াতেই শুনতে পেল মির্জা সাহেব থমথমে গলায় বলছেন, না বন্দুক আমি দেব না।

বাদল বলল, কেন?

পুরো কথাটা শোন। বন্দুক তো আমি দেবই না, তোকে ওসব ট্রেনিং ফ্রেনিংও আর করতে দেব না। এসব তোকে ছাড়তে হবে।

বাদল আবার বলল, কেন?

রাগি চোখে ছেলের দিকে তাকালেন মির্জা সাহেব। কেন মানে? এসব করে কী হবে? এভাবে একটা দেশ স্বাধীন করা যায়?

জীবনে এই প্রথম বাবার মুখের ওপর দৃঢ় গলায় কথা বলল বাদল। এভাবেই দেশ স্বাধীন করা যায়। যখন দেশের প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতা চায় তখন তাদের স্বাধীনতা কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না।

দেশের সবাই স্বাধীনতা চায় না।

কে বলেছে আপনাকে।

আমি জানি। পাকিস্তানিদের পক্ষেও কিছু লোক আছে।

তা থাকলেও কিছু যায় আসে না।

মির্জা সাহেব খরচোখে বাদলের দিকে তাকালেন। তোর কথাবার্তা শুনে খুবই অবাক হচ্ছি আমি।

কী রকম?

এই প্রথম দেখছি তুই আমার সঙ্গে তর্ক করছিস।

এটা তর্ক না। সত্য কথা।

থাম। কোন ফাঁকে এরকম বেয়াদব হয়ে উঠেছিস তুই?

আমি কোনও বেয়াদবি করিনি।

অবশ্যই করেছিস। ভালভাবে চাইলে বন্দুকটা তোকে আমি দিয়ে দিতাম।

আমি ভাল ভাবেই চেয়েছি।

তা তুই চাসনি। তুই আমার সঙ্গে তর্ক করেছিস।

বাদল কথা বলল না।

মির্জা সাহেব আগের মতোই রুক্ষ গলায় বললেন, এই যে আমার সঙ্গে তর্কটা করলি, বন্দুকটা এজন্য তোকে আমি দেব না। যা, তুই যা। আমার সামনে থেকে।

বাদল খুবই মন খারাপ করে বেরিয়ে গেল।

ভাইয়ের জন্য খুকির তখন মনটা কেমন করছে।

.

০৯.

সন্ধেবেলা এনামুলের বাড়ির উঠোনে এসেছে বাদলরা কয়েকজন।

এনামুল বলল, প্রাথমিক ট্রেনিংটা তোমাদের অনেকেরই হয়ে গেছে। এখন অন্যকাজ।

বাদল বলল, কী কাজ?

তিন চারজনের একেকটা করে দল করতে হবে। দু একদিন পর পরই ওরকম একটি দুটি করে দল আগরতলায় পাঠিয়ে দেব। আসল ট্রেনিংটা হবে সেখানে। ফিরে এসেই যুদ্ধ।

প্রথম দলে আমি যেতে চাই।

না।

বাদল চমকাল। কেন?

তোমাদের নিয়ে আমার অন্য প্ল্যান আছে।

বাদল আলমগির সুজন মন্টু এই চারজন একসঙ্গে তাকাল এনামুলের দিকে।

এনামুল বলল, তোমরা চারজন যাবে একে একে।

আলমগির বলল, কেন?

হাত তুলে তাকে থামাল এনামুল। এত প্রশ্ন করো না। আমার কথা শোন। প্রথমে যাবে মন্টু। তার সঙ্গে আরও তিনটি ছেলে। কারণ কাল থেকে চার পাঁচটা গ্রুপ করে ট্রেনিং দেয়া হবে। আমি তো আছিই। আরেক দলে থাকবে বাদল, আরেক দলে আলমগির, আরেক দলে সুজন। এভাবে ট্রেনিং চলবে।

এনামুলের কথার পর কেউ আর কোনও কথা বলল না।

.

১০.

খুকির মুখে সবই শুনেছেন বকুল।

তখন থেকেই তাঁর মুখটা গম্ভীর।

রাতেরবেলা স্ত্রীর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে মির্জা সাহেব বললেন, মুখটা হাড়ির মতো করে রেখেছ কেন?

বকুল গম্ভীর গলায় বললেন, আমার মুখ হাড়ির মতোই।

না আমি জানি কেন এমন করে আছ।

জানোই যখন তাহলে আর কথা বলছ কেন?

তারপর একটু থেমে বলল, ছেলের সঙ্গে এই ধরনের ব্যবহার করা তোমার ঠিক হয়নি।

একথায় মির্জা সাহেবও গম্ভীর হলেন। তোমার ছেলেরও ঠিক হয়নি আমার সঙ্গে তর্ক করা।

কী তর্ক করেছে?

তুমি নিশ্চয় তা শুনেছ।

বকুল কথা বলল না।

মির্জা সাহেব গজগজে গলায় বললেন, লেখাপড়া শিখে বেয়াদব হয়ে গেছে।

আজকালকার ছেলেরা এরকমই।

বলেই চিন্তিত হলেন বকুল। তুমি বাদলের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করলে, আমি কিন্তু অন্যরকম একটা ভয় পাচ্ছি।

কিসের ভয়?

বাদল যদি পালিয়ে ইন্ডিয়া চলে যায়? সেখানে গিয়ে যদি ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ করতে আসে? যদি ছেলেটাকে আমরা আর কোনওদিন ফিরে না পাই?

কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন বকুল।

স্ত্রীর কান্না দেখে মির্জা সাহেব কেমন দমে গেলেন। চিন্তিত গলায় বললেন, এসব আমিও ভেবেছি। ওর বয়েসি ছেলেরা কেউ ঘরে থাকছে না।

তারপরই স্ত্রীর কাঁধে হাত দিলেন মির্জা সাহেব। শোন, বাদলের দায়িত্ব নিতে হবে তোমাকে। সে তোমার কথা শোনে। তাকে তুমি বোঝাও। সব ছেড়ে ঘরে বসে থাকতে বল। দেশ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আমাদের কোনও লাভ নেই। ছেলে গেলে কিন্তু ছেলে পাবে না।

বকুল কথা বললেন না।

পরদিন সকালবেলা বাদলের ঘরে এসে ঢুকলেন বকুল।

শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বেরুচ্ছিল বাদল। মাকে দেখে থামল।

বকুল বললেন, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।

পরে বলো। আমি এখন বেরুচ্ছি।

বাদলের হাত ধরলেন বকুল। না, এখুনি বলব।

কী এমন কথা যে এখুনি বলতে হবে?

খুবই জরুরী কথা।

ছেলেকে টেনে এনে বসালেন বকুল। আমার কথা শুনে তারপর বাইরে যাবি।

আচ্ছা বল।

তোকে সব ছেড়ে দিতে হবে।

কথাটা বুঝতে পারল না বাদল। বলল, কী ছেড়ে দিতে হবে?

দেশ নিয়ে চিন্তা ভাবনা। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং, সবকিছু।

মায়ের কথা শুনে বাদল একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। আমার মা হয়ে এমন কথা তুমি বলছ?

কেন খারাপ কী বলেছি?

তোমার মতো কত মায়ের সন্তান দেশ বাঁচাবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আর আমাকে তুমি ঘরে আটকে রাখতে চাও?

বকুল আবদেরে গলায় বললেন, আমি কিছু বুঝি না, কিছু শুনতে চাই না। তুই কোথাও যেতে পারবি না। যদি পালিয়ে ইন্ডিয়া চলে যাস তাহলে আমি গলায় দাড়ি দেব।

বাদল আঁতকে উঠল। মা!

বকুল কঠিন গলায় বললেন, যদি দেখতে চাস আমি গলায় দড়ি দিয়েছি,তাহলে যেখানে ইচ্ছে চলে যা। আমার কিছু বলার নেই।

কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন বকুল। চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন।

বাদল স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।

.

১১.

সকালবেলা বাবা গিয়ে বসেছেন কাছারি ঘরে আর মা ভাইজানের ঘরে। এই সুযোগে মা বাবার ঘরে এসে ঢুকেছে খুকি। আলমারির চাবিটা কোথায় থাকে জানা আছে ওর।

চাবিটা খুকি বের করল।

তারপর সাবধানী চোখে চারদিক তাকিয়ে আলমারি খুলল।

এই আলমারিতেই থাকে বাবার বন্দুক, গুলির ব্যাগ। অতি সাবধানে দুটো জিনিসই বের করল খুকি। তারপর আলমারি তালাবন্ধ করে, চাবি জায়গা মতো রেখে বন্দুক আর গুলির ব্যাগ নিয়ে ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বেরুল।

জিনিস দুটো বয়ে আনতে একটু কষ্ট হলো তার। তবুও ঘুর পথে তাদের বাড়ি থেকে বেরুবার পথের ধারে, বাঁশঝাড় তলায় এসে দাঁড়িয়ে রইল সে।

কিছুক্ষণ পরই এই পথ দিয়ে আনমনা ভঙ্গিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল বাদল।

খুকি তাকে ডাকল। ভাইজান, দাঁড়াও।

বাদল দাঁড়াল। তুই এখানে কী করছিস।

তারপর বন্দুক দেখে অবাক হলো। এ কী? বন্দুক? বন্দুক কোথায় পেলি?

গুলিও আছে। নাও।

বলে বন্দুক আর গুলির ব্যাগ বাদলের হাতে দিল।

বাদল তখনও অবাক। বাবার বন্দুক, গুলি এসব তুই কীভাবে জোগাড় করলি?

খুকি হাসিমুখে বলল, যেমন করেই হোক করেছি। তুমি নাও।

কিন্তু বাবা জানতে পারলে?

কী করবে? মারবে আমাকে? মারুক।

সঙ্গে সঙ্গে আশ্চর্য এক আনন্দে মন ভরে গেল বাদলের। খুকির মাথায় হাত দিল সে। তোর মতো বোন যে দেশে আছে সেই দেশের স্বাধীনতা কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

ভাইয়ের কথায় উজ্জ্বল হাসিতে মুখ ভরে গেল বোনের।

বন্দুক আর গুলির ব্যাগ হাতে বাদল সোজা চলে এল বটতলায়। এখানে আলমগিররা সবাই আছে।

বন্দুকটা আলমগিরের হাতে দিল বাদল।

আলমগির মুগ্ধ গলায় বলল, শেষ পর্যন্ত তাহলে আনলি?

বাদল লাজুক গলায় বলল, হ্যাঁ।

সুজন বলল, বেশ খানদানি বন্দুক।

বাদল বলল, রাখ এসব। মন্টুরা কখন রওনা দিল তাই বল।

ভোররাতে।

কুমিল্লার ওদিক দিয়েই তো বর্ডার পার হবে, নাকি?

হ্যাঁ।

সুজন বলল, আমার খুব ফূর্তি লাগছে।

কারণ?

কারণ পরের ব্যাচে যাব আমি।

.

১২.

শিরিন বললেন, আর চিন্তা নেই মা। এসে পড়েছি।

মুমূর্ষ ভঙ্গিতে শুয়েছিল যমুনা। একে জ্বর তার ওপর নৌকোর দুলুনি, মাথাটা বন বন করে ঘুরছে তার। তবু নৌকোর ভেতর থেকে বাইরের দিকে তাকাল।

নৌকো ততোক্ষণে খালপারের ঘাট ছুঁয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে মাঝিকে তাড়া দিল যমুনার ছোটমামা বরকত। ব্যাগ সুটকেস তাড়াতাড়ি নামাও।

খালপারে লগি পুতে নৌকো বাঁধল মাঝি। তারপর ব্যাগ সুটকেস নামাতে লাগল।

অকারণেই ঘুরতে ঘুরতে খালপারে এসেছিল বিলু। হঠাৎ ছইঅলা নৌকো এবং অচেনা মানুষজন দেখে নৌকোর কাছে এল সে।

যমুনাকে জড়িয়ে ধরে ততোক্ষণে নৌকো থেকে নেমেছেন শিরিন। বিলু এসে তাদের সামনে দাঁড়াল। আপনেরা ঢাকা থেকে আসলেন?

শিরিন বলল, হ্যাঁ।

ঢাকার খবর কী?

শিরিনের পেছন থেকে বরকত তাকে একটা ধমক দিল। চুপ কর।

বিলু তার ডাগর চোখ দুটো তুলে বরকতের দিকে তাকাল। ক্যান? কোনও অন্যায় কথা বলছি?

মাঝির ভাড়া দিতে দিতে বরকত বলল, অন্যায় নয় তো কী! এইটুকু পুঁচকে ছোঁড়া, তুই খবরের কী বুঝিস?

জ্বরের ঘোরেও বিলুকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল যমুনা। শ্যামল বরণ মিষ্টি ছেলেটি। মুখখানি কী মায়াবি! চোখ দুটো কী সুন্দর! কথা বলার সময় কী সুন্দর করে হাসে!

শিরিনের দিকে তাকিয়ে বরকত বলল, যমুনার জ্বর কেমন, আপা?

শিরিন বললেন, এখন তেমন জ্বর নেই।

যমুনা মুমূর্ষ গলায় বলল, তবে আবার আসবে।

তা বুঝতে পারছি।

ডাক্তার না দেখালে হবে না।

হ্যাঁ, আজই ডাক্তার দেখাব। এখন তো আর কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু ওইটুকু হেঁটে যেতে পারবি মা?

পারব।

বিলু হাসিমুখে যমুনার দিকে তাকাল। কোন বাড়িতে যাবেন আপনারা?

যমুনা কথা বলবার আগেই বরকত বলল, মির্জাবাড়ি।

তারপর দুকাঁধে দুটো ব্যাগ আর হাতে বিশাল সুটকেসটা নিল বরকত। আপা, তুমি যমুনাকে ধরে হাট।

যমুনা বলল, না ধরতে হবে না।

শিরিন মেয়েকে ধরলেন। অবশ্যই ধরতে হবে নয়তো যখন তখন পড়ে যাবি।

কিন্তু মামা অতগুলো লাগেজ একা কীভাবে নেবে?

আমাকে নিয়ে তুই ভাবিস না। আমি পারব?

এই লোকটিকে তেমন পছন্দ হয়নি বিলুর, তবু সে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আপনে একা এতগুলি পারবেন না। আমারে একটা দেন।

বরকত বলল, তুই কি মির্জাবাড়ি চিনিস?

খুব ভাল চিনি। এই গ্রামের সব বাড়িই আমি চিনি। যখন যেই বাড়িতে ইচ্ছা থাকি।

এখন থাকিস কোথায়?

মির্জাবাড়িতেই।

তাহলে তো ভালই। সেই বাড়ি পর্যন্ত এই সুটকেসটা নিতে কত নিবি?

কিছুই নেব না।

যমুনা বলল, কেন?

আমি কুলি না। পয়সার জন্য কাজ করি না। এমনিতেই গ্রামের সবার কাজ করে দিই।

বরকত খুব খুশি হলো। তাহলে তো আরও ভাল।

যমুনা বলল, কিন্তু এতবড় সুটকেস ও পারবে?

বিলু বলল, পারব। তবে মাথায় তুলে দিতে হবে।

তা আমি দিচ্ছি।

বলেই সুটকেসটা বিলুর মাথায় তুলে দিল বরকত।

দৃশ্যটা যমুনার ভাল লাগল না।

.

১৩.

দুপুরবেলাই মির্জা সাহেব টের পেয়ে গেলেন তাঁর বন্দুকটা নেই।

কী কারণে আলমারি খুলেছিলেন, বন্দুক এবং গুলির ব্যাগ না দেখে। সেই কারণটা ভুলে গেলেন। বকুলকে ডেকে বললেন ঘটনাটা।

বকুল ফ্যাল ফ্যাল করে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

মির্জা সাহেব হতাশ ভঙ্গিতে খাটে বসলেন। শেষ পর্যন্ত তোমার ছেলে আমার বন্দুকটা চুরি করল! ছি ছি ছি! ইউনিভার্সিটিতে পড়া ছেলে এমন হয়! বাপের বন্দুক চুরি করেছে ছেলে, একথা কাউকে বলা যাবে!

এই ঘরের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল খুকি। বাবার কথা সে শুনতে পেল। পেয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। বাবা, বন্দুকটা ভাইজান চুরি করেনি।

মির্জা সাহেব এবং বকুল দুজনেই খুকির দিকে তাকালেন

মির্জা সাহেব বললেন, তাহলে কে করেছে?

আমি।

কী?

মির্জা সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে নির্ভীক গলায় খুকি বলল, হ্যাঁ বাবা, আমি করেছি।

বকুল বললেন, কিন্তু তুই বন্দুক দিয়ে কী করবি?

ভাইজানকে দিয়ে দিয়েছি।

তখুনি বিশাল একখানা সুটকেস মাথায় নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল বিলু। উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ও খুকি, খুকি, তোমগ বাড়িতে মেহমান আসছে।

সব ভুলে উঠোনের দিকে তাকাল খুকি।

বিলুর পিছু পিছু তখন তিনজন মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে উঠোনে। তাদেরকে দেখে লাফিয়ে উঠল খুকি। মা, যমুনা আপা এসেছে। শিরিন ফুফু, বরকত চাচা সবাই এসে পড়েছে।

দৌড়ে উঠোনে চলে এল খুকি।

ঘরের ভেতর বকুল তখন মির্জা সাহেবকে বলছেন, বন্দুক টলুক নিয়ে এখন আর কোনও কথা বল না। যা হওয়ার হয়ে গেছে।

.

১৪.

যমুনাদেরকে থাকতে দেয়া হয়েছে পুবের ঘরে।

বিকেলবেলা সেই ঘরের পালঙ্কে শুয়ে আছে যমুনা। তার মুখে থার্মোমিটার, গায়ে লেপ। অদূরে হাতলঅলা চেয়ারে বসে আছেন জলধর ডাক্তার। আর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই বাড়ির সবাই। মির্জা সাহেব বকুল বাদল খুকি শিরিন বরকত নবু বিলু।

শিরিন বললেন, জ্বরটা এসেছে ভয়ে। সারাক্ষণ ভয়ে উৎকণ্ঠায় মেয়েটা আমার জড়সড় হয়ে থাকত।

মির্জা সাহেব বললেন, এই বয়সি মেয়ে নিয়ে ঢাকায় এতদিন তুই থাকলি কেন?

বকুল বললেন, তোমার নিজেরও তো কাঁচা বয়েস।

বরকত বলল, আমাদের মোহাম্মদপুর এলাকায় কোনও ঝামেলা নেই।

জলধর বললেন, মানে?

বিহারি এলাকা তো! মিলিটারিদের সঙ্গে বিহারিদের খুব খাতির।

ভাইকে একটা ধমক দিলেন শিরিন। চুপ কর। বিহারিগুলো আরও খচ্চর। ওদের কারণেই বাড়ি থেকে বেরুতে পারিনি। পিস কমিটি, রাজাকার বাহিনী, বদর বাহিনী, কত বাহিনী হয়েছে। একটি বাঙালিকেও ওরা বাঁচিয়ে রাখবে না।

যমুনার মুখ থেকে থার্মোমিটার টেনে নিয়ে, জ্বর দেখতে দেখতে জলধর বললেন, ওই এলাকা থেকে আপনারা তাহলে বেরুলেন কী করে?

মির্জা সাহেব বললেন, ডাক্তার, ওকে তুমি করে বল। আমার ফুফাতো বোন। অল্প বয়েসে বিধবা হয়েছে।

বিধবা শব্দটা শুনেই মুখখানি মায়াবি হয়ে গেল জলধরের। আমার মাধবির মতো। তবে ভগবানের দয়ায় মাধবির কোনও সন্তানাদি নেই।

শিরিন বললেন, জ্বর কত ডাক্তার বাবু?

এমন কিছু না। একশো এক। অষুদ দিয়ে যাচ্ছি, খাবে। আর একটা দুটোদিন রেস্ট নেবে, তিনদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।

ব্যাগ খুলে প্রেসক্রিপসান প্যাড বের করলেন জলধর ডাক্তার। পকেট থেকে খয়েরি রংয়ের মোটা প্রেসিডেন্ট কলম বের করলেন। তারপর খসখস করে কী কী সব লিখলেন। লিখে শিরিনের হাতে দিলেন। এটা ধর। ট্যাবলেট দিচ্ছি।

ব্যাগ থেকে দুপাতা ট্যাবলেট বের করলেন। একটা করে তিনবেলা খাবে। খাওয়ার পর।

কদিন?

পাঁচদিন। ভগবানের দয়ায় পাঁচদিনেই দেখবে একদম ঠিক।

ব্যাগ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন জলধর। আজ আর বসতে পারছি না।

বকুল বলল, কেন দাদা?

সন্ধে হয়ে যাচ্ছে।

মির্জা সাহেব বললেন, চা খাবে না?

না। আজ খাব না। মেয়েটা একা বাড়িতে।

তারপর শিরিনের দিকে তাকালেন জলধর। কাল এক সময় এসে তোমার যমুনাকে একবার দেখে যাব। কীভাবে ঢাকা থেকে বেরুলে সেই ঘটনাও শুনে যাব।

বিলু এগিয়ে এসে জলধর ডাক্তারের ব্যাগটা ধরল। ব্যাগটা আমার হাতে দেন। আমি দিয়াসি।

বিলুকে দেখে কেমন যেন খুশি হলেন জলধর। কী রে বিলু, তুই এখন থাকিস কোথায়?

বিলু লাজুক গলায় বলল, এই বাড়িতেই।

মির্জা সাহেব বললেন, ওর যখন যে বাড়িতে ভাল লাগে, থাকে। এখন আমার বাড়িতে আছে দুদিন পর দেখবে তোমার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে।

তাহলে তো ভালই হয়। মেয়েটা একা থাকে। বিলু থাকলে তার একটা সঙ্গী হয়। আগে মেয়েটা একা বাড়িতে থাকত, ভয় পেতাম না, আজকাল ভয় লাগে।

বকুল বললেন, লাগবার কথাই।

মির্জা সাহেব বললেন, বিলু তাহলে আজ থেকে তোমার বাড়িতেই থাক।

তারপর বিলুর দিকে তাকালেন মির্জা সাহেব। কী বলিস বিলু?

বিলু মাথা নীচু করে বলল, ঠিক আছে।

.

১৫.

মুখে কোনো একখানা হাসি দিয়ে জলিল বলল, একখানা প্রস্তাব নিয়া আসছি মির্জা সাহেব।

মির্জা সাহেবও হাসলেন। বিবাহের প্রস্তাব?

আরে না।

তালেব বলল, এই বয়েসে আপনে আবার বিবাহ করবেন নাকি?

মির্জা সাহেব বললেন, তোমাকে এতকাল ছাগল হিসাবে জানতাম, ছাগল থেকে রামছাগল হয়েছ কবে?

তালেব একেবারে নিভে গেল।

মির্জা সাহেব বললেন, নিজের কথা বলছি না। বিবাহের উপযুক্ত ছেলে আছে আমার।

জলিল বলল, বাদ দেন ওইসব কথা। বিবাহের ব্যাপার না।

তবে?

ব্যাপার হইতাছে পূর্ব পাকিস্তান।

বুঝলাম।

পূর্ব পাকিস্তানটারে আমরা বাঁচাইতে চাই।

তোমরা মানে?

জলিল তালেবের দিকে তাকাল। তালেব তুই ক।

তালেব ছোট্ট করে গলা খাকারি দিল। আমরা, মানে মেলেটারি সাহেবরা, সাহেবগ লগে পূর্ব পাকিস্তানের যিনারা আছেন তিনারা….।

তালেবকে থামাল জলিল। এইবার তুই থাম। আমি কই।

মির্জা সাহেবের দিকে তাকাল জলিল। থানায় থানায়, ইউনিয়নে ইউনিয়নে পিস কমিটি হইতাছে, রাজাকার বাহিনী হইতাছে। আমাগ ইউনিয়নের চেরম্যান সাবের কাছে প্রস্তাব আসছে…..।

জলিলের কথা শেষ হওয়ার আগেই মির্জা সাহেব বললেন, এসবের মধ্যে আমি নেই।

তালেব বলল, আগে কথাটা শোনেন। চেরম্যান সাব আমগ ইউনিয়নের পিস কমিটিরও চেরম্যান হইছে।

জলিল বলল, আর আমি আর তালেব ভর্তি হইতাছি রাজাকারে। রাজাকারের কমান্ডার হমু। তালেব, ক।

তালেব বলল, চেরম্যান সাবে চায়, আপনে তার লগে থাকেন। সে চেরম্যান আপনে মেম্বর।

জলিল বলল, আর বিদ্যান পোলাডারে সামলান। তারে বলেন টেরনিং বন্দুক জয়বাংলা এইসব য্যান ছাইড়া দেয়। নাইলে…..।

চোখ তুলে জলিলের দিকে তাকালেন মির্জা সাহেব। নইলে?

অসুবিধা আছে আর কী?

মির্জা সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, ঠিক আছে, তোমরা যাও। আমি চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে কথা বলব।

তালেব এবং জলিল উঠে দাঁড়াল।

জলিল বলল, আর একখান কথা।

কী?

কোনও মোসলমানরে মেলেটারি সাবরা আর মারব না। বাইছা বাইছা খালি হিন্দুগুলিরে মারব।

জলিলরা বেরিয়ে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ চুপচাপ কাছারি ঘরে বসে রইলেন মির্জা সাহেব।

.

১৬.

রুগি দেইখা ফিরলেন ডাক্তার বাবু?

জলধর ডাক্তারের হাতে ডাক্তারি ব্যাগ, গলায় স্টেথিসকোপ। পরনে ধুতির ওপর ঝুল পকেটঅলা শার্ট। ধুতি এবং শার্ট দুটোই সাদা। পায়ে কালো পামসু আছে। চৌধুরী বাড়ির লাগোয়া পায়ে চলা পথে কিছুটা উদাস ভঙ্গিতে হাঁটছিলেন তিনি। তালেবকে খেয়াল করেননি। তার কথায় থতমত খেয়ে থামলেন। হ্যাঁ।

তারপর তালেবের সঙ্গে জলিলকেও দেখতে পেলেন। হাসিমুখে বললেন, তোমরা কোত্থেকে?

তালেব কথা বলবার আগেই জলিল বলল, তুই থাম। আমি কই।

তালেব এবং জলিল দুজনকেই আজ অন্যরকম লাগছে। কী রকম মাতাব্বর ভাব দুজনের মাতাব্বর চেহারায় কাউকে তোয়াক্কা না করার ভঙ্গি। অথচ এই দুজন গ্রামের অতি নিম্নস্তরের মানুষ। আজকাল তেমন কিছু করে না। বাজারের চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয় আর এর ওর

পয়সায় চা খায়। গ্রামের মানুষের কাছে ছ্যাচড়া হিসেবে পরিচিত।

সেই ছ্যাচড়া দুটো কোন ফাঁকে এমন বদলে গেছে!

জলধর যখন এসব ভাবছেন তখন জলিল বলল, এখন আমরা বড় বড় কাজে ঘুইরা বেড়াইতাছি, বোঝলেন ডাক্তার সাব?

জলধর হাসলেন, কী রকম বড় কাজ?

দ্যাশের কাজ আর কি। পাকিস্তানের কাজ। পূর্ব পাকিস্তানটারে বাচাইতে হইব।

জলধর একটু থতমত খেলেন। এই ধরনের কথা গ্রামের কারও মুখে কখনও শোনেন নি তিনি। অবাক গলায় বললেন, আচ্ছা।

সঙ্গে সঙ্গে কেমন খেঁকিয়ে উঠল জলিল। আইচ্ছা আইচ্ছা কইরেন না। আপনে অনেক বিপদ।

বিপদ কথাটা শুনে ভেতরে ভেতরে চমকালেন জলধর। বললেন, কী রকম বিপদ?

মেলেটারি সাবেরা একটা হিন্দুও এই দেশে রাখব না।

কী করবে?

এই কথাটার জবাব দিল তালেব। কী আর করব? মাইরা ফালাইব।

বল কী?

হ।

তুমি খবর পেয়েছ?

জলিল বলল, হ পাইছি। আমরা খবর না নিয়া কথা বলি না।

তারপর তালেবের দিকে তাকাল সে। তালেব তুই ক।

তালেব বলল, কী কমু?

ও তুই তো আবার জান না। ঠিক আছে আমিই কই। শোনেন ডাক্তার দাদা, পূর্ব পাকিস্তানে থাকলে বাঁচতে আপনেরা আর পারবেন না।

জলধর অসহায় গলায় বললেন, তাহলে কী করব?

চইলা যান। বাঁচতে চাইলে চইলা যান।

কোথায়?

আর কোথায়? কইলকাত্তা। বেবাক হিন্দুরা যেখানে যায়।

জলধর আর কথা বললেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন।

জলধর চলে যাওয়ার পর তালেবের দিকে তাকাল জলিল। ক তো। ডাক্তাররে চইলা যাইতে কইলাম কেন?

তালেব বলল, জানি না।

সে চইলা গেলেই বাড়িটা আমি দখল করুম। আমার বহুতদিনের শখ আমি একটা হিন্দুবাড়ি দখল করি। এইবার চান্সটা পাইছি।

.

১৭.

‘জয় বাংলা, বাংলার জয়
হবে হবে হবে
হবে নিশ্চয়’

স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে এই গান হচ্ছে। নিজের হাতলঅলা চেয়ারে বসে গান শুনছেন জলধর ডাক্তার। বাবার বিছানা গুছাচ্ছিল মাধবি। হ্যারিকেনের আলোয় মুখটা কেমন অসহায় দেখাচ্ছে তাঁর।

হঠাৎ জলধর বললেন, বাংলার জয় একদিন হবেই কিন্তু আমরা মনে হয় বাঁচব না।

মাধবি চমকাল। কেন বাবা?

বললে তুই খুব ভয় পাবি মা।

তবু বল। না বললে আমি অস্বস্তিতে থাকব।

জলধর হতাশ গলায় বললেন, দেশের একজন হিন্দুকেও বাঁচিয়ে রাখবে না ওরা।

শুনে আঁতকে উঠল মাধবি। মানে?

যেখানে যত হিন্দু আছে বেছে বেছে মেরে ফেলবে। প্রত্যেক থানায়, প্রত্যেক গ্রামে হিন্দু খুঁজতে শুরু করেছে।

তাহলে?

কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আজ জলিল এবং তালেব এইসব কথাই বলল।

হাতের কাজ শেষ না করেই জলধরের পাশে এসে দাঁড়াল মাধবি। বাবার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, আমার খুব ভয় করছে বাবা।

ভয়ের কথাই।

চল আমরা তাহলে কলকাতা চলে যাই।

চোখ তুলে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন জলধর। এতদিনকার বসতবাড়ি, গ্রাম, গ্রামের মানুষজন, আমার বাঁধারোগি সব ছেড়ে চলে যেতে বলিস?

এছাড়া কী করব, বলো? বাঁচতে তো হবে। তবে দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। স্বাধীন হলে আবার ফিরে আসব।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কী করব। তালেব এবং জলিলের কথায় আমি অবশ্য তেমন কিছু ভাবিনি। ওরা বদলোক। আমি ভালই চিনি ওদেরকে। কোন মতলবে কথাটা ওরা বলেছে তাও বুঝেছি। তবে মিলিটারিরা যে হিন্দু পেলেই মারছে এটা সত্য।

কিন্তু একটা কিছু সিদ্ধান্ত তো নিতে হবে।

কী সিদ্ধান্ত নেব বুঝে উঠতে পারছি না।

হঠাৎ করেই যেন কিছু একটা মনে পড়ল মাধবির। উৎফুল্ল গলায় বলল, তুমি একটা কাজ কর বাবা, মির্জা কাকার সঙ্গে কথা বলে দেখ। তিনি বিচক্ষণ মানুষ। তিনি যা বলবেন তাই করব আমরা। তিনি সাহস দিলে থাকব, না হয় চলে যাব।

পরদিন সকালবেলাই মির্জা সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এলেন জলধর। সব শুনে চিন্তিত গলায় মির্জা সাহেব বললেন, ভরসা আমি তোমাকে দিতে পারছি না ডাক্তার। দেশের অবস্থা তুমি আমি সবাই জানি। এই অবস্থায় কে কাকে ভরসা দেবে বল?

জলধর প্রচণ্ড হতাশ হলেন। তার মানে তুমিও চলে যাওয়ার কথাই বলছ?

ভেবে দেখ?

জলধর ফাঁকা শূন্য গলায় বললেন, মা হারা মেয়েটাকে নিয়ে ছিলাম। মেয়েটাকে একা বাড়িতে রেখে রোগি দেখতে যেতাম। মনে হতো চারপাশের সবাই আপন। সবাই মেয়েটাকে আমার দেখে রাখবে। দেখে রেখেছেও। কোনও অনিষ্ট আমার মেয়ের হয়নি।

মির্জা সাহেব বললেন, এখন সেই ভয়ও আছে। চেয়ারম্যান সাহেব পিস কমিটি করেছেন, জলিল তালেবরা হচ্ছে রাজাকার। মিলিটারিদের সঙ্গে ডাইরেক্ট যোগাযোগ। ঘরের ইঁদুরে যদি বাঁধ কাটে তখন আর কিছু করার থাকে না।

জলধরের কাঁধে হাত দিলেন মির্জা সাহেব। জলধর, তুমি আমার ছোটবেলার বন্ধু। তুমি কোনও রিসক নিও না। মেয়ে নিয়ে চলেই যাও।

যাবই বা কেমন করে? পথেও তো কত বিপদ!

তবুও যাও। মালপত্র তেমন কিছু নেবে না। দুজনে সামান্য দুটো ব্যাগ নিয়ে রওনা দেবে। আমি শুনেছি কুষ্টিয়ার ওদিক দিয়ে বর্ডার পার হচ্ছে হাজার হাজার লোক।

মির্জা সাহেবের মুখের দিকে তাকালেন জলধর ডাক্তার। তুমি যখন বলছ, ওই পথেই যাব।

তারপর মির্জা সাহেবের একটা হাত জড়িয়ে ধরলেন জলধর ডাক্তার। গভীর আবেগে বললেন, এই জীবনে তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে কী না জানি না। তুমি আমার ছেলেবেলার বন্ধু। মনে হয় না কখনও কোনও দুঃখ তোমাকে আমি দিয়েছি। তবু নিজের অজান্তে যদি কখনও দিয়ে থাকি, বন্ধু, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।

সঙ্গে সঙ্গে জলধরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মির্জা সাহেব। দুই ধর্মের দুজন বয়স্ক মানুষ তারপর শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

.

১৮.

জ্বর ছেড়ে গেছে ঠিকই কিন্তু দুর্বলতা কাটেনি যমুনার।

ঘর থেকে একেবারেই বেরয় না সে। সারাক্ষণই শুয়ে থাকে। ছোট্ট শিশুকে যেভাবে ধরে ধরে খাওয়ান মা ঠিক সেইভাবে তাকে খাইয়ে দেন শিরিন।

আজ সকালেও যমুনাকে সেভাবে খাইয়ে দিচ্ছিলেন শিরিন।

শিরিনের হাতে এক পেয়ালা দুধ আর দুখানা চালের রুটি। একটা রুটির অর্ধেকটা আর সামান্য দুধ খেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিল যমুনা। আর খাব না মা।

শিরিন অবাক হলেন। কেন?

ভাল লাগছে না।

জ্বর থেকে ওঠার পর খেতে কারই ভাল লাগে না। তবুও খেতে হয়। জোর করে খেতে হয়।

কিন্তু আমি পারছি না। মুখটা কেমন তেতো হয়ে আছে।

জ্বরের পর মুখ এমন হয়।

আবার শরীরও কেমন গুলাচ্ছে।

বমি বমি লাগছে?

হ্যাঁ। মনে হচ্ছে আর একটু খেলেই বমি করে ফেলব।

হাতের খাবার সরিয়ে নিলেন শিরিন। তাহলে আর খাওয়ার দরকার নেই।

এসময় এই ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল বাদল।

প্রথমে যমুনার দিকে তাকাল সে। তারপর তাকাল শিরিনের দিকে। জ্বর এখন কেমন?

শিরিন বললেন, জ্বর নেই, তবে শরীর খুব দুর্বল।

জ্বর হলে শরীর দুর্বল হবেই। দু চারদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।

তারপর যমুনার দিকে তাকাল বাদল। হাসিমুখে বলল, জোর করে ওঠার চেষ্টা কর। হাঁটাচলার চেষ্টা কর। দেখবে তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে গেছ।

যমুনা তখন কী রকম অবাক চোখে বাদলের দিকে তাকিয়ে আছে।

সেদিন বিকেলেই যমুনার সঙ্গে আবার দেখা হলো বাদলের।

মাঠের দিকে হাঁটতে বেরিয়েছে যমুনা, বাদল এসে তার সামনে দাঁড়াল। তুমি তাহলে আমার কথা শোন!

বাদলের মুখের দিকে তাকাল যমুনা। আপনি কী বলেছেন যে আমি শুনেছি?

সকালবেলা বললাম উঠে হাঁটাচলা কর আর বিকেলবেলাই হাঁটাচলা করছ!

সেটা আপনার কথায়ই যে করছি তা আপনি বুঝলেন কী করে?

আমার মনে হলো।

অনেক ভুল কিছুও মানুষের মনে হয়।

তা হয়।

আচ্ছা আপনি কি সকালবেলা আমাকে খেয়াল করে দেখেছেন?

অবশ্যই।

আপনার দিকে যে আমি খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তা কি আপনি দেখেছেন?

দেখেছি।

কেন তাকিয়ে ছিলাম বলুন তো?

জানি না।

দেশের এই অবস্থায় ইউনিভার্সিটি পড়া কোনও ছেলে যে বাড়ি বসে থাকে, এই ভেবে।

বাদল একটু থতমত খেল। তারপর হাসল। বসে থাকিনি তো!

তাহলে কী করছেন?

দেশের কাজ করছি।

কী কাজ?

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধ অর্গানাইজ করছি। প্রাথমিক ট্রেনিংটা নিয়েছি। একেকটা গ্রুপ করে ইন্ডিয়া পাঠাচ্ছি।

একথা শুনে যমুনার জ্বরক্লান্ত মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। সত্যি?

দেশ নিয়ে কি আমি তোমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলব!

না তা নয়।

তবে তোমাকে আমার খুব ভাল লাগল।

যমুনা একটু চমকাল। মানে?

মানে দেশ নিয়ে তোমার ফিলিংসটা জেনে ভাল লাগল।

যমুনা হাসল। তাই বলুন।

চল কোথাও বসি।

চলুন।

মাঠের ধারে অনেকগুলো খড়ের গাদা। বিকেলে রোদ খড়ের গাদার মাথার ওপর উঠে গেছে। তলার দিকটায় ছায়া। এখানটায় এসে বসল ওরা দুজন।

এই দৃশ্যটা দেখে ফেললেন মির্জা সাহেব।

আছড়ের নামাজ পড়তে মসজিদে যাচ্ছিলেন তিনি, খড়ের গাদার ছায়ায় বাদল এবং যমুনাকে দেখতে পেলেন। দেখে চোখে মুখে সামান্য একটা চিন্তা খেলে গেল তার।

তবে বাদল কিংবা যমুনা কেউ মির্জা সাহেবকে দেখতে পেল না।

যমুনা বলল, আপনি এভাবে কাজে করছেন, জেনে ভাল লাগল।

বাদল মুগ্ধ গলায় বলল, কাল সকালেই আমাদের আর একটা ব্যাচ চলে যাবে।

আপনি যাবেন কবে?

বাদল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমার বোধহয় যাওয়া হবে না।

কেন?

মায়ের জন্য।

তিনি কী করেছেন?

মায়ের কথাগুলো যমুনাকে বলল বাদল।

শুনে যমুনা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। এটা কোনও কথা হলো?

তবুও শেষ চেষ্টা আমি করব।

কীভাবে?

মাকে বোঝাব, তুমি যেমন আমার মা, দেশও তোমার মতো আরেক মা আমার। এক মায়ের কারণে আরেক মাকে আমি রক্ষা করব না!

বাদলের কথা শুনে কী যে ভাল লাগল যমুনার! একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। অপলক চোখে বাদলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।

বাদল বলল, কী হলো?

না কিছু না।

তারপর যমুনা বলল, আপনার কথা শুনে নিজের জন্য আমার খুব দুঃখ হচ্ছে।

কেন?

ছেলে হলে, মানে মেয়ে না হয়ে যদি ছেলে হতাম, ঘরে আমাকে কেউ আটকে রাখতে পারত না। দেশের জন্য দরকার হলে জীবন দিয়ে দিতাম আমি।

বাদল মুগ্ধ গলায় বলল, তোমার এই ফিলিংসটাই যথেষ্ট। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ সবাইকে করতে হয় না। তোমার মতো দেশাত্মবোধ যাদের আছে তারাও মুক্তিযোদ্ধা।

তারপর একটু থেমে বলল, তোমাকে একটা কথা বলব?

আবার আগের মতো অপলক চোখে বাদলের দিকে তাকাল যমুনা। যে কোনও কথাই আপনি আমাকে বলতে পারেন।

তোমার নামটা আমার খুব ভাল লাগে। নদীর নামে নাম।

হ্যাঁ। শুধু নদী নয়, বাংলার বিখ্যাত নদী। আমার একটা প্রিয় শ্লোগান হচ্ছে,

‘তোমার আমার ঠিকানা
পদ্মা মেঘনা যমুনা’

যমুনা তখনও আগের মতোই চোখ করে তাকিয়ে আছে বাদলের দিকে। .

.

১৯.

কথাটা শুনে বকুল একেবারে আঁতকে উঠলেন। বল কী?

মির্জা সাহেব তার স্বভাব সুলভ গম্ভীর গলায় বললেন, আঁতকে উঠবার কিছু নেই। সত্য কথাই বলছি।

তাতো বুঝেছিই। তুমি কি আমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলবে?

মির্জা সাহেব হাসলেন। তবে ব্যাপারটা আমার অপছন্দ হয়নি।

কী?

মির্জা সাহেব মাথা নাড়লেন।

তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।

না বোঝার কিছু নেই। যমুনা সুন্দরী মেয়ে। ওদের বংশও ভাল। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি। সবচে বড় কথা, বাদলের সঙ্গে ওকে খুব মানায়।

তার মানে তুমি কি ওদের বিয়ের কথা ভাবছ?

তবে কী?

দেশের এই অবস্থায় ছেলের বিয়ে?

এই অবস্থা বলেই তো বিয়ের কথা ভাবছি।

এবার বকুল কী রকম বিরক্ত হলেন। তুমি বড় প্যাচিয়ে কথা বল, কিছুই বুঝতে পারি না।

মির্জা সাহেব এবার নড়েচড়ে বসলেন। শোন, তুমি যদি সত্যি সত্যি গলায় দড়ি দাও তবুও তোমার ছেলে মুক্তিবাহিনীতে যাবে।

কী বলছ তুমি?

হ্যাঁ। এতদিন চলেও যেত।

তাহলে যায়নি কেন?

কেন যায়নি, আমি জেনে গেছি।

বল তো আমাকে।

ওর সঙ্গে যারা ছিল, সুজন মন্টু ওদেরকে গ্রামে দেখ?

না।

কেন দেখ না বল তো?

জানি না।

ওরা চলে গেছে।

মুক্তিবাহিনীতে চলে গেছে? ইন্ডিয়াতে?

হ্যাঁ। আর মাত্র কয়েকদিন, তোমার ছেলেও যাবে।

এজন্য বিয়ে করিয়ে দিতে চাও?

কারেক্ট।

বকুল হাসল। বুদ্ধিটা খারাপ না।

মির্জা সাহেব বললেন, বিয়ে দিয়ে যমুনাকে বলব, বাদলকে ধরে রাখ।

আমি যদি না পারি, যমুনা কি পরবে?

পারবে।

কী করে বুঝলে?

পুরুষমানুষরা এরকমই। মার কথা ফেললেও বউর কথা ফেলে না।

তুমি তাহলে শিরিনের সঙ্গে কথা বল।

দুচার দিনের মধ্যেই বলব।

.

২০.

বনসীমান্ত গ্রামের খালপারে আজ ভোরবেলা একখানা ছইঅলা নৌকো বাঁধা।

নৌকোয় মাঝারি সাইজের দুখানা হাত কিংবা কাঁধব্যাগ। কিছুক্ষণ আগে জলধর ডাক্তারের বাড়ি থেকে ব্যাগ দুটো বয়ে এনে নৌকোয় তুলেছে বিলু। তুলে আর ফিরে যায়নি। খালপারেই দাঁড়িয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পরই জলধর ডাক্তার এবং মাধবি এলো খালপারে।

জলধরের পরনে আজ ধুতি নেই। পাজামা এবং পাঞ্জাবী পরেছেন। তিনি। মাধবির পরনে সাদাশাড়ি। তবে পাড় নেই শাড়ির।

খালপারে এসেই মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে লাগল মাধবি।

ততোক্ষণে বাদল এবং আলমগিরও এসেছে খালপারে।

মাধবিকে কাঁদতে দেখে বাদল তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কাঁদছ কেন দিদি?

কথাটা সে বলল ঠিকই, কিন্তু তার চোখ দুটোও ছলছল করতে লাগল। গলা বুজে এল উদগত কান্নায়।

তবু মাধবিকে সে সান্ত্বনা দিতে লাগল। দিদি, দিদি এভাবে কেঁদ না। কেঁদ না। দেশ নিশ্চয় স্বাধীন হয়ে যাবে। নিশ্চয় তোমরা আবার ফিরে আসবে।

আলমগির বলল, স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু মুসলমানের কোনও ব্যবধান থাকবে না।

জলধরও তখন দুহাতে চোখ মুছছেন।

মাধবিকে রেখে বাদল গিয়ে দাঁড়াল জলধর ডাক্তারের সামনে। আপনিও ছেলেমানুষি করছেন ডাক্তার কাকা?

জলধর নিজেকে সামলালেন। বড় করে একটা শ্বাস ফেললেন। তোকে একটা দায়িত্ব দিয়ে যেতে চাই বাদল।

জ্বী বলেন কাকা।

ভগবানের দয়ায় কখনও যদি ফিরে আসি তো এলাম, যদি না আসি, আমার বড়িটা তুই বিলুকে দিয়ে দিস বাবা।

আচ্ছা কাকা।

বিলুটা অনাথ ছেলে, ওর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমার বাড়িতে জীবনভর যেন ও থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা তুই করে দিস বাবা।

জলধরের কথা শুনে বিলু তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

জলধর ডাক্তার বিলুর মাথায় হাত বুলালেন। কাঁদিস না বিলু, কাঁদিস না।

এই অবস্থায় জলধরকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল বিলু।

তারপর গেল মাধবিকে সালাম করতে। পাগলের মতো দুহাত বিলুকে বুকে জড়িয়ে ধরল মাধবি। দুজন মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে গেল খালপারের বাতাস।

.

২১.

মির্জা সাহেবের কথা শুনে শিরিন একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। কী বলছেন ভাইজান?

মির্জা সাহেব বললেন, ঠিকই বলছি।

এই অবস্থায় বিয়ে?

অবস্থার কথা ভেবে লাভ নেই। আমার ছেলেকে তোর পছন্দ কিনা তাই বল।

শিরিন আনমনা গলায় বললেন, বাদলের মতো ছেলেকে কে অপছন্দ করবে?

শিরিনের কথা শুনে মির্জা সাহেব খুব খুশি। তাহলে আলহামদুলিল্লাহ। দশদিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাবে।

কিন্তু দেশের এই অবস্থা! বিয়ের খরচাপাতি?

কোনও খরচাপাতি নেই।

জ্বী?

ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে বোনের মেয়ের বিয়ে! এই ধরনের বিয়েতে আবার খরচা কিসের?

মুহূর্তে এই খবর ছড়িয়ে গেল পুরো বাড়িতে।

বাদলের কানে খবরটা গেল বরকতের মাধ্যমে।

শুনে বাদল একেবারে হতভম্ব। কী বলছ চাচা?

বরকত হে হে করে একটু হাসল। জেনে শুনেই বলছি। যমুনার সঙ্গে তোমার বিবাহ। দশ বারোদিনের মধ্যে। কথা ফাইনাল।

এসব শুনে বরকতের মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে রইল বাদল তারপর মা বাবার ঘরে এসে ঢুকল।

মির্জা সাহেব ঘরে নেই। বকুল আছেন।

মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে রাগে একেবারে ফেটে পড়ল বাদল। এই অবস্থায় তোমরা এসব ভাবলে কী করে?

বকুল পরিষ্কার গলায় বললেন, আমি ভাবনি।

তাহলে?

তোর বাবা ভেবেছেন।

বাবাকে তুমি বোঝালে না কেন?

তিনি কি কারও কথা শোনার লোক? নিজে যা ভাল বোঝেন তাই করেন।

একটু থামলেন বকুল। তবে যমুনাকে আমারও পছন্দ। লেখাপড়া জানা লক্ষ্মীমেয়ে।

বাদল আগের মতোই রাগি গলায় বলল, তার মানে তোমারও মত আছে?

তোর মত নেই? যমুনাকে তোর পছন্দ না?

একথা শুনে বাদল একটু দমল। পছন্দ অপছন্দের কথা আমি বলিনি মা।

তাহলে?

আমি বলছি সময়ের কথা। যেখানে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ চলছে সেখানে আমার মতো ছেলে বিয়ে করতে পারে না।

একটু থামল বাদল। আমি অবশ্য বুঝেছি বাবা কেন এই পলিসিটা করেছেন। আজ তোমাকে আমি স্পস্ট বলছি মা, তোমাদের কোনও পলিসিই কাজে লাগবে না।

বাদল রাগি ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল।

.

২২.

কথাটা যমুনা শুনল খুকির কাছ থেকে।

বিকেলবেলা খুকির মাথা আঁচড়ে দিচ্ছে যমুনা, খুকি বলল, তোমার জন্য একটা খবর আছে যমুনা আপা।

কী খবর?

তোমার বিয়ে।

যাহ।

সত্যি?

কোথায়?

এই বাড়িতে।

মানে?

মানে ভাইজানের সঙ্গে তোমার বিয়ে।

কী?

হ্যাঁ।

তোকে কে বলল?

বাড়ির সবাই জানে। তোমার যদি বিশ্বাস না হয়, তুমি গিয়ে ফুফুকে জিজ্ঞেস কর।

খুকির মাথা আঁচড়ানো শেষ না করেই পুবের ঘরে এল যমুনা।

শিরিন ঘরেই ছিলেন। সরাসরি তাঁকে কথাটা জিজ্ঞেস করল যমুনা।

শিরিন বললেন, যা শুনেছিস তা ঠিক।

মানে?

মানে বাদলের সঙ্গে তোর বিয়ে।

তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? কেন?

দেশের এই অবস্থায় কোনও পাগল ছাড়া কেউ নিজের মেয়ের বিয়ের কথা ভাবতে পারে না।

চোখ তুলে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন শিরিন। এসব ব্যাপারে তুই যে আমার সঙ্গে কখনও কথা বলবি, এ আমি ও ভাবিনি।

নিজের ভালমন্দের ব্যাপারে কথা বলার অধিকার আমার আছে।

তা আছে। প্রত্যেক মানুষেরই থাকে।

যমুনা গম্ভীর হল। কী বলতে চাচ্ছ তুমি?

শিরিন থমথমে গলায় বললেন, তোকে সাত বছরের রেখে তোর বাবা মারা গেলেন। যে বয়সে আমি বিধবা হলাম সেই বয়েসে অনেক মেয়ের বিয়েই হয় না। আমারও অধিকার ছিল তোর কথা না ভেবে নিজের কথা ভাবা। কই আমি তো তা ভাবিনি।

দুটো ব্যাপার কিন্তু একরকম নয় মা।

তাহলে কী রকম?

আমি কিন্তু তোমার কথার অবাধ্য হচ্ছি না। তোমাদের সিদ্ধান্তেও আমার আপত্তি নেই।

তাহলে সমস্যাটা কী?

সমস্যা হচ্ছে দেশ। একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে যেখানে সেখানে একটি মেয়ের বিয়ে হয় কী করে?

পরিস্থিতিটা মনে না রাখলেই হয়।

যমুনার দিকে আর তাকালেন না শিরিন। নির্বিকার ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

যমুনার তখন কী যে অসহায় লাগছে! চোখ ফেটে যেতে চাইছে গভীর কান্নায়।

.

২৩.

জলধর ডাক্তার মাধবিকে নিয়ে যে ঘরটায় থাকতেন সেই ঘরের দরজায় এখন বেশ বড় একটা তালা ঝুলছে। নির্জন বাড়িটিকে যেন আরও নির্জন করে তুলেছে ওই তালাটা।

বাড়ি ঢুকে এই তালাটাই প্রথমে চোখে পড়ল জলিলের।

জলিলের সঙ্গে আছে তার সারাক্ষণের সঙ্গী তালেব। আর জনা চারেক কামলা মজুর ধরনের লোক।

রাজাকার হওয়ার পর জলিলের চেহারায় চেকনাই অনেক বেড়ে গেছে। গলার সুর গেছে বদলে। এখন আর কোনও ব্যাপারে কাউকে অনুরোধ করে না জলিল। আদেশ করে।

এখনও করল। তালেব, তালাটা ভাঙ।

তালেব বলল, তারপর?

তালা ভাইঙ্গা ঘর থিকা ডাক্তারের চেয়ারটা বাইর কর।

করে?

আমারে দে। আমি ঐ চেয়ার নিয়া উঠানে বসব।

তারপর?

তারপর আর কিছু না। আইজ থিকা এই বাড়িটা আমার। আগে এই বাড়িরে লোকে বলত জলধর ডাক্তারের বাড়ি, আইজ থিকা বলব জলিল রাজাকারের বাড়ি।

সঙ্গে সঙ্গে শরীরের তাক যেন বেড়ে গেল তালেবের। একজন মজুরের হাত থেকে সাবল নিয়ে জলধর ডাক্তারের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল সে।

ঠিক তখুনি এই বাড়ির দিকে আসছিল বিলু।

গাছপালার আড়াল থেকে দেখতে পেল উঠোনে জলিলরা কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে, আর জলধর ডাক্তারের ঘরের তালা ভাঙছে তালেব।

বিলু আর দেরি করল না। স্কুল মাঠের দিকে দৌড় দিল।

স্কুল মাঠের পতাকাতলে দাঁড়িয়ে ছিল বাদল এনামুল আর আলমগির। বাদলের হাতে মির্জা সাহেবের বন্দুক।

এনামুলকে বাদল বলল, আমি আর দেরি করতে চাই না এনামুল ভাই।

এনামুল বলল, কেন?

অসুবিধা আছে।

কী অসুবিধা?

পারিবারিক। আপনাকে বলতে চাচ্ছি না। আমাকে আর আলমগিরকে আপনি একসঙ্গে পাঠিয়ে দিন।

এনামুল চিন্তিত গলায় বলল, আমাকেও তোমাদের সঙ্গে যেতে হবে।

আলমগির বলল, কেন? গ্রামে আর থাকা যাবে না।

তখুনি পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এল বিলু। আপনেরা তাড়াতাড়ি আসেন। ডাক্তারকাকার বাড়ি দখল করতাছে জলিল মিয়ারা।

শুনে বাদল একটা লাফ দিল। কী?

তারপর বন্দুক হাতে জলধর ডাক্তারের বাড়ির দিকে ছুটল। তার সঙ্গে সঙ্গে ছুটল আলমগির আর বিলু।

কিন্তু এনামুল তেমন জোরে ছুটতে পারছিল না। ক্রাচে ভর দিয়ে যতটা দ্রুত সম্ভব ছুটছিল সে।

ওরা যখন জলধর ডাক্তারের বাড়ি এল, ততোক্ষণে ঘরের তালা ভাঙা হয়ে গেছে। জলধরের হাতাঅলা চেয়ারটা বাইরে, উঠোনে এনে রাখা হয়েছে। সেই চেয়ারে বেশ একখানা ভাব ধরে বসেছে জলিল। একজন কামলা তাকে তালপাখায় বাতাস করছে।

জলিল তাকে বলল, জোরে বাতাস কর। আরও জোরে। আইজ কাইল আমার একটু বেশি গরম লাগে।

বাদল গম্ভীর গলায় বলল, কী করছেন এখানে?

বাদলকে বন্দুক হাতে দেখে আর তার জলদ গম্ভীর গলা শুনে ভয় পেয়ে গেল জলিল। তড়াক করে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল সে। কিছু করি না, কিছু করি না।

ঘরের তালা ভেঙেছে কে?

আমি না, আমি না। তালেব।

ভয়ে তালেবেরও ততোক্ষণে মুখ শুকিয়ে গেছে। ঢোক গিলে সে বলল, আমার দোষ নাই। জলিল আমারে ভাঙতে কইছে।

যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। আমার উচিত আপনাদের দুজনকেই গুলি করা। এটা আপনাদের প্রথম অন্যায় বলে গুলিটা আমি করব না। বেরোন, বেরোন বাড়ি থেকে।

জলিল বলল, হ হ যাইতাছি গা।

তারপর তালেবের দিকে তাকাল। তালেব, ল।

লও।

ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর এনামুল বলল, জলিলের এই যাওয়া কিন্তু শেষ যাওয়া নয় বাদল।

তাহলে?

জলিল হচ্ছে গোখরো সাপ। গোখরো সাপ ব্যথা পেয়ে পালিয়ে যায় ঠিকই কিন্তু আড়াল থেকে শত্রুকে ফলো করে। সুযোগ পেলেই ছোবলটা দেয়।

আলমগির বলল, তার মানে জলিলও ছোবল দেবে?

অবশ্যই।

ঠিক এই কথাটাই জলধর ডাক্তারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বলল জলিল। ছোবল না, আমি দিমু কামড়। কামড় দিয়া খাইয়া ফালামু।

তালেব বলল, তোমার কথা বুঝলাম না।

রাজাকারে নাম লেখাইছি। কাইলই থানায় গিয়া মেলেটারি সাহেবগ জানামু আমগ বনসীমান্ত গ্রামে মুক্তিবাহিনীর টেরনিং হইতাছে। কমান্ডার হইল বাদল। দেখবি আর কিছু লাগব না। ডাক্তারের বাড়ি তো আমি দখল করুমই, মির্জা বাড়িও করুম।

জলিলের কথা শুনে খুবই আমোদ পেল তালেব। খি খি করে হাসতে লাগল সে।

.

২৪.

বিকেলবেলা মাঠের দিক থেকে হেঁটে আসছে বাদল।

বাড়ি ঢুকবে। নাড়ার পালাগুলোর ওদিক থেকে বেরিয়ে এল যমুনা।

যমুনাকে দেখে থমকে দাঁড়াল বাদল। তুমি এখানে?

যমুনা সরল গলায় বলল, আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।

কেন?

আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।

বাদল মাথা নীচু করল। আমি জানি তুমি কী বলবে।

যমুনা বলল, না আপনি জানেন না।

বাদল একটু চমকাল। যমুনার দিকে তাকাল। মানে?

বাদলের চোখের দিকে তাকিয়ে যমুনা বলল, আমি চাই বিয়েটা হোক।

কী?

হ্যাঁ।

কী বলছ তুমি?

আমি আমার মনের কথা বলছি। তবে তারপরও কথা আছে।

সে কথা আর বাকি রাখছ কেন? বলে ফেল।

যমুনা মিষ্টি করে হাসল। কথা না শুনেই রেগে যাওয়া ঠিক না।

আমি রেগে যাইনি।

তাহলে?

অবাক হয়েছি।

অবাক হওয়ারও কিছু নেই। কারণ …….।

কারণ?

বিয়েটা হবে স্বাধীনতার পর।

সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভার নেমে গেল বাদলের। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেল। সত্যি?

যমুনা মিষ্টি করে হাসল। সত্যি। যতদিন দেশ স্বাধীন না হবে, আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব।

বাদল মুগ্ধ চোখে যমুনার দিকে তাকিয়ে রইল।

.

২৫.

মির্জা সাহেব আজ ফিরলেন রাত করে।

বকুল একটু উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলেন। স্বামীকে ঘরে ঢুকতে দেখেই ব্যস্ত হলেন। চেয়ারম্যান সাহেব খবর পাঠিয়েছিলেন কেন?

মির্জা সাহেবের মুখটা থমথম করছে।

বাইরে থেকে এসেই সাধারণত গায়ের পাঞ্জাবিটা খোলেন তিনি। এখন খুললেন না। গম্ভীর মুখে পালঙ্কে বসলেন।

বকুল বললেন, কী হলো? কথা বলছ না কেন?

কী বলব?

কী বললেন চেয়ারম্যান সাহেব?

মির্জা সাহেব কথা বললেন না।

স্বামীর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন না বকুল। তার পাশে বসলেন। কী হয়েছে?

কিছু না।

কিছু না হলে তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

এবার রাগে ফেটে পড়লেন মির্জা সাহেব। বদমাসটাকে চেয়ারম্যান বানিয়ে ছিলাম আমি। আমি না বললে গ্রামের লোকে ওকে ভোট দিত না। সেই ব্যাটা আজ আমাকে শাসায়?

শাসায় মানে? কী বলেছে?

আমাকে বলে ওদের সঙ্গে দালালের খাতায় নাম লেখাতে।

মানে?

মানে পিস কমিটির মেম্বার হতে বলে আমাকে। কী মনে করেছে ও আমাকে? ছেলেকে মুক্তিবাহিনীতে যেতে দিইনি বলে আমি কি দেশের স্বাধীনতা চাই না? আমি কি ওদের মতো পাকিস্তানি কুকুর?

উঠোন দিয়ে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল বাদল।

মির্জা সাহেবের গলা শুনে নিজের ঘরে না গিয়ে মা বাবার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল।

বাদলকে খেয়াল করলেন না মির্জা সাহেব, স্ত্রীকে বললেন, বাদলের মা, তোমার ছেলেকে বলে দাও, বিয়েসাদি বাদ। সে যা চায় তাই করুক। মুক্তিবাহিনীতে চলে যাক।

বাবার মুখে একথা শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না বাদল। ঘরে ঢুকে গেল। বাবা।

বাদলকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন মির্জা সাহেব। আদেশের গলায় বললেন, কাল সকালেই চলে যাবি। দেশ স্বাধীন না করে ফিরবি না।

বাদল দৃঢ় গলায় বলল, অবশ্যই।

তবে ফিরে এসে একটি দালালকেও ছাড়বি না। দেশের জন্য দরকার হলে শহীদ হয়ে যাবি।

বাবার কথায় এতটাই আপুত হল বাদল, বাবাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।

.

২৬.

বাদল ভেবেছিল চলে যাওয়ার সময় যমুনার সঙ্গে তার দেখা হবে না। কারণ এত সকালে তার ওঠার কথা না।

কিন্তু সকাল সকাল রওনা না দিয়ে বাদলের উপায়ও নেই।

মা বাবা ও খুকির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাঠের দিকটায় এসেছে বাদল, খড়ের গাদার ওদিকটায় ঠিক দাঁড়িয়ে আছে যমুনা। ঘুম ভাঙা মুখখানি তার আনন্দে তখন ফেটে পড়ছে।

বাদলকে দেখেই এগিয়ে এল সে।

বাদল বলল, তুমি কখন এখানে এলে?

আপনি যখন মামা মামীর কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন তখনই।

ভাল করেছ। তোমাকে দেখে খুব ভাল লাগছে।

আমারও খুব ভাল লাগছে। আপনি স্বাধীনতা যুদ্ধে যাচ্ছেন আর আমি আপনাকে বিদায় জানাচ্ছি, এটা সত্যি অসম্ভব আনন্দের।

শুনে বাদল খুবই আপুত হল। তোমাকে একটা কথা বলব?

হ্যাঁ।

যাওয়ার আগে তুমি যদি আমাকে একবার তুমি করে বলতে, আমার খুব ভাল লাগত।

বাদলের কথা শুনে অপলক চোখে তার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে রইল যমুনা, তারপর দুহাতে বাদলের একটা হাত জড়িয়ে ধরল। এই যে তোমার হাত ধরলাম, জীবনে এই হাত কখনও ছাড়ব না।

বাদলও ধরল যমুনার হাত। সত্যি?

এরচে’ বড়সত্য আর কিছু নেই আমার জীবনে। যেখানেই থাক তুমি, জানবে, আমি তোমার সঙ্গে আছি। তোমার হাত ধরে আছি।

আবেগে গলা বুজে এল বাদলের। সে আর কোনও কথা বলতে পারল না।

.

২৭.

খানিকটা বেলা হওয়ার পর মাঠপারের দিকে গিয়েছিল মির্জা বাড়ির গোমস্তা নবু, গিয়ে দেখে দূরের রাস্তা দিয়ে সারধরে মিলিটারি আসছে বনসীমান্তের দিকে। তাদের সঙ্গে একজন চেনা লোককে দেখতে পেল নবু। জলিল রাজাকার। সে আছে তাদের আগে আগে। যেন পথ দেখিয়ে আনছে মিলিটারিদেরকে।

মুহূর্তখানেক দৃশ্যটা দেখল নবু, তারপর চিৎকার করতে করতে মির্জা বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল। মেলেটারি আসতাছে, মেলেটারি আসতাছে।

মুহূর্তে পুরো বনসীমান্ত জেনে গেল কী ঘটতে যাচ্ছে। যে যেখানে যে অবস্থায় ছিল ছুটতে শুরু করল।

মির্জা বাড়িতেও হুলস্থুল পড়ল।

ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যমুনা বলল, কী? মিলিটারি আসছে?

শিরিন বললেন, সর্বনাশ! এখন কী হবে?

বরকত বলল, যে ভয়ে ঢাকা থেকে পালালাম সেই ভয় তো এখানেও!

বকুল বললেন, বাড়ির লোকজন নিয়ে এখন কোথায় যাব আমরা?

মাকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে কাঁপতে লাগল খুকি। আমার ভয় করছে। মা।

মির্জা সাহেব ছিলেন কাছারি ঘরে, হৈ চৈ শুনে ছুটে বেরুলেন। কী হয়েছে এ্যাঁ, কী হয়েছে?

নবু হাপাতে হাপাতে বলল, মেলেটারি আসতাছে। আমি নিজ চোখে দেখছি। লগে জলিল রাজাকার।

তার মানে জলিল মিলিটারিদের জানিয়েছে বনসীমান্তে জয় বাংলার ট্রেনিং হচ্ছে। এজন্য মিলিটারিরা এখন গ্রাম জ্বালাতে আসছে। যাকে পাবে তাকেই এখন গুলি করে মারবে।

নবু বলল, তাই তো মনে হইতাছে।

সর্বনাশ! তাহলে এক্ষুনি সবাইকে নিয়ে পালাতে হবে। নবু, তুই একটা কাজ কর, গোয়ালের গরুগুলো সব ছেড়ে দে। যেদিকে ইচ্ছে চলে যাক।

নবু গোয়ালের দিকে ছুট দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম গুলির শব্দটা হলো।

.

২৮.

বিলু ঘুমিয়ে ছিল জলধর ডাক্তারের ঘরে।

গুলির শব্দে তার ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল সে। ছুটে ঘর থেকে বেরুল।

পুরো বনসীমান্ত জুড়ে তখন মানুষের পায়ের শব্দ। ছুটোছুটি, ভয় চিৎকার আতঙ্ক। গুলির শব্দ হচ্ছে অবিরাম। গাছের পাখিরা সব আকাশে উড়াল দিয়েছে। কাকগুলো সব কা কা করছে।

মুহূর্তকাল কী ভাবল বিলু তারপর স্কুলমাঠের দিকে দৌড় দিল। অন্য কিছুই আর তার মনে নেই, শুধু মনে আছে স্কুলমাঠের লম্বা বাঁশের মাথায় বাঁধা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার কথা। যেমন করেই হোক পতাকাটা তাকে রক্ষা করতে হবে।

ছুটতে ছুটতে স্কুলের মাঠে এল বিলু।

এই দিকটা একেবারেই ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। দূরে গুলির শব্দ হচ্ছেই। মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে।

হাঁপাতে হাঁপাতে বিলু এসে পতাকার খুঁটিটা দুহাতে আঁকড়ে ধরল।

কয়েক মুহূর্ত মাত্র, তারপরই বিলুর চারপাশ থেকে অজস্র বুট পরা পা এগিয়ে আসতে লাগল এই মাঠের দিকে।

বিলু মনে মনে বলল, যত মেলেটারিই আসুক, জীবন থাকতে আমার কাছ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা কেউ ছিনাইয়া নিতে পারব না।

Exit mobile version