কথাটা শুনে পারু যেন কেঁপে উঠলেন। অন্য কোথায় রেখে আসবে?
কোনও ব্যাংকে কিংবা কারও কাছে? মানে বাড়ির দলিল রেখে বাবা কারও কাছ থেকে টাকা পয়সা আনেনি তো?
পারু দৃঢ় গলায় বললেন, না, প্রশ্নই ওঠে না। আমাকে না জানিয়ে তিনি কোনওদিন কিছু করেননি। অমন হলে অবশ্যই তিনি আমাকে বলতেন। আমি জানতাম।
কিন্তু বছরখানেক আগে বইয়ের দোকানটা যখন ছেড়ে দিলেন বাবা, বাবার কিছু লায়াবেলিটিস ছিল। কিছু ধারদেনা ছিল। তার আগে হুট করে
অমিকে কম্পিউটার কিনে দিল, তারও আগে টেলিফোন আনল!
এসবের জন্য তাকে বাড়ির দলিল রেখে টাকা আনতে হবে কেন? বইয়ের দোকানটা তো ভালই চলতো। ভালই রোজগার করতেন তিনি।
আমার মনে হয় না।
মানে?
দোকান উঠে যাওয়ার পরও প্রায়ই কোত্থেকে যেন কিছু কিছু টাকা আনতেন বাবা।
আরে ওসব তো কাজের টাকা।
কী কাজ?
মানে রোজগারের টাকা আর কী?
তখন কী রোজগার ছিল বাবার?
বাংলাবাজারের পাবলিসারদের সঙ্গে কী কী কাজ করতেন।
সেটা খুবই সামান্য কাজ। প্রুফ দেখা।
প্রুফ দেখে টাকা তো পেতেন।
অতি সামান্য টাকা। কিন্তু আমার যতদূর মনে পড়ে, বাবা টাকা আনতেন বেশ ভালই।
একটু থামল সুমি। তারপর বলল, মা, তুমি কি বাবাকে কখনও জিজ্ঞেস করেছ তার রোজগারটা কী? কোত্থেকে টাকা পয়সা পায় সে?
না।
কেন?
আমি জানতাম কোনও অসৎ কাজ তিনি কখনও করবেন না। আর পুরুষ মানুষদের রোজগার নিয়ে মহিলাদের তেমন না ভাবাই ভাল।
সুমি মাথা নাড়ল। না। কথাটা বোধহয় ঠিক না। যাই হোক, দলিল যে বাড়িতে নেই তা আমি বুঝে গেছি। কোথায় আছে, কার কাছে আছে, খুঁজে বের করতে হবে।
.
০৯.
আজকের দিনটা আমি শুধু ঢাকা শহরে ঘুরব।
মনজুর কথা শুনে হোটেল রিসেপসনিস্ট চোখ তুলে তাকালো। কালকের রিসেপসনিস্টদের একজনও এখন নেই। শিফট ভাগ করা কাজ। এখনকার শিফটে অন্য রিসেপসনিস্ট।
খানিক আগে নিজের রুম থেকে বেরিয়েছে মনজু। সকালবেলা গোসল করে ফ্রেস হয়েছে। তারপর সুন্দর একটা জিনসের প্যান্ট পরেছে, ঘিরঙের টিশার্ট পরেছে। পায়ে বুট, চোখে সানগ্লাস। মনজুকে দেখতে হলিউডের নায়কদের মতো লাগছে।
সে আজ শুধু ঢাকা শহরে ঘুরবে শুনে রিসেপসনিস্ট হাসি মুখে বলল, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ, স্যার?
প্রথমে একটাই কাজ করবেন, আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলবেন।
ওকে স্যার।
বলুন ঠিক আছে।
ঠিক আছে।
এবার আপনাদের হোটেলের একটা কার্ড দিন।
রিসেপসনিস্ট সঙ্গে সঙ্গে কার্ড দিল।
কার্ডটা কেন নিলাম জানেন?
না স্যার। যদি হারিয়ে যাই, কার্ডে লেখা এডড্রেস দেখে ফিরে আসব।
জ্বী স্যার।
আচ্ছা গেন্ডারিয়া এলাকাটা কোথায় বলুন তো?
পুরনো ঢাকায়।
তা আমি জানি। না না আজ যাব না। হয়তো কাল কিংবা পরশু যাব। যাওয়ার ব্যবস্থাটা কী বলুন তো?
রিকশা কিংবা বেবিট্যাক্সি।
বেবিট্যাক্সি মানে অটোরিকশা?
জ্বী স্যার।
ইয়েলোক্যাব যাবে না?
সাধারণত পুরনো ঢাকার দিকে যেতে চায় না। আপনি অবশ্য আর একটা কাজ করতে পারেন।
কী?
রেন্টেকার নিতে পারেন।
আপনারা ব্যবস্থা করে দেবেন?
অবশ্যই।
আর যদি হেঁটে যাই?
রিসেপসনিস্ট হাসল। দূর হবে।
কতদূর?
তা একজাক্টলি বলতে পারব না।
বিশ কিলোমিটার?
না না এত হবে না। এখান থেকে পাঁচ সাত কিলোমিটার হবে।
এ এমন কিছু না। আমার ইচ্ছে হলে আমি হেঁটে চলে যেতে পারি। আবার একটা মার্সিডিজ নিয়েও যেতে পারি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।
বলে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে হাসল মনজু। শুনুন।
রিসেপসনিস্ট ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, জ্বী স্যার।
আপনাদের কিচেনে বলে রাখবেন, বাংলাদেশের নানা রকমের টুকটাক টুকটাক খাবার যখন তখন আমি চাইতে পারি। যেমন করে হোক সেগুলোর ব্যবস্থা যেন করে দেয়।
জ্বী স্যার।
আমি কিন্তু না শুনে অভ্যস্ত নই। এবং টাকা পয়সার ব্যাপারে একদমই ভাবি না।
কিন্তু কী ধরনের আইটেম আপনি চাইতে পারেন?
এক মুহূর্তও ভাবল না মনজু। বলল, এই ধরুন বইচা মাছের চচ্চড়ি।
রিসেপসনিস্ট বেশ অবাক হলো। বইচা মাছটা কী স্যার?
মনজু মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। আপনি বাংলাদেশি না?
জ্বী, অবশ্যই।
বইচা মাছ চেনেন না?
না স্যার।
চেনা উচিত ছিল।
মাছটা বোধহয় কমন নয়।
তা ঠিক। আনকমন মাছ।
দেখতে কেমন?
খলিসা মাছ চেনেন?
জ্বী তা চিনি স্যার। তবে খলিসা খুব রেয়ার হয়ে গেছে। আজকাল তেমন পাওয়া যায় না।
তাই নাকি?
জ্বী স্যার।
এটা খুবই দুঃখের কথা। এইসব মাছ বাংলার ঐতিহ্য। হারিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। যাহোক, খলিসার বাচ্চা সংস্করণ হচ্ছে বইচা। অথবা বইচা আলাদা একটা প্রজাতিও হতে পারে।
মনজু আর দাঁড়াল না। লবির দিকে পা বাড়াল।
নিজের কাজে ব্যস্ত হতে হতে রিসেপসনিস্ট আপনমনে বলল, হোটেলে কাজ করলে কত রকমের পাগল যে দেখতে হয়!
কথাটা শুনে ফেলল মনজু। সে আবার ফিরে এলো।
মনজুকে ফিরতে দেখে রিসেপসনিস্ট নার্ভাস হয়ে গেল। গোপনে সে একটা ঢোক গিলল।
মনজু নির্মল মুখ করে হাসল। পাগল নই, প্রেমিক। দেশপ্রেমিক।
স্যার!
নার্ভাস হবেন না। আমি আপনাকে কিছু বলব না। লোকের পেছনে কথা বলা বাঙালিদের একটা ত্রুটি। আমি নিজে যেহেতু একশো ভাগ। বাঙালি সেহেতু এই ত্রুটিটাকে আমি ত্রুটি মনে করছি না। বরং ত্রুটিটাকেও আমি পছন্দ করি। সংক্ষেপে এই হচ্ছি আমি।
মনজু আর দাঁড়াল না।
.
১০.
বারান্দার লাইটটা আজ কেন যে জ্বালেননি পারু!