কিন্তু বাড়ির দলিল পরচার ফাঁইলটা পেলেন না পারু।
ফাইলগুলো রাখা আছে তাদের বেডরুমের একমাত্র আলমারিতে। একে একে সব ফাঁইল নামালেন পারু। একটা একটা করে ঘাঁটলেন কিন্তু দলিলের ফাঁইলটা নেই।
পারু একেবারে দিশেহারা হয়ে গেলেন।
কোথায় গেল ফাঁইলটা?
এই আলমারি ছাড়া অন্যকোথাও থাকার কথা নয়। সাধারণত মাসুদ সাহেবই হাতাহাতি করতেন ফাঁইলপত্র। প্রয়োজনে বের করে, কাজ সেরে আবার জায়গামতো রেখে দিতেন। এসব ফাঁইল অন্যকোথাও যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
তাহলে?
তারপর ঘরের ভেতর সম্ভাব্য যত জায়গা আছে খুঁজলেন পারু।
না নেই।
ফাইলটা কোথাও নেই।
পারু খুবই অস্থির হয়ে পড়লেন। আবার নামালেন ফাঁইলের স্থূপ, আবার ঘটতে লাগলেন।
এই বাড়িতে রাতের খাবার আটটার দিকে খাওয়ার নিয়ম। নিয়মটা মাসুদ সাহেব চালু করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরও নিয়মটা চালু আছে। আটটা বাজলেই টেবিলে খাবার এনে রাখে বুয়া। সুমি অমি এসে বসে। সবার শেষে আসতেন মাসুদ সাহেব এবং পারু। মাসুদ সাহেব নেই, এখন পারু আসেন সবার শেষে।
কিন্তু আজ প্রায় সোয়া আটটা বেজে গেল, তিনি আসছেন না।
সুমি অমি দুজনেই অবাক হলো।
অমি বলল, আমরা বসে আছি কিন্তু মা আসছে না! ব্যাপার কী? কী করছে?
ডালের পেয়ালা রাখতে রাখতে শিরিন বুয়া বলল, কী জানি খুঁজতাছে।
সুমি একটু চিন্তিত হলো। কী খুঁজছে?
তা জানি না।
অমি উঠে দাঁড়াল। আমি যাই, মাকে ডেকে আনি।
সুমিও উঠল। আমিও যাই, দেখি কী খুঁজছে।
বুয়া বলল, ভাত তরকারি তো ঠাণ্ডা হইব।
সুমি বলল, ঢেকে রাখ।
দুভাইবোন তারপর পারুর রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে দুজনেই থতমত খেয়ে গেল।
খুবই বিধ্বস্ত ভঙ্গিতে মেঝেতে বসে আছেন পারু, তার চারদিকে ছড়ানো ছিটানো ফাঁইলপত্র।
সুমি বলল, এই অবস্থা কেন? কী হয়েছে?
পারু হতাশ গলায় বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে।
অমি বলল, মানে?
বাড়ির দলিলপত্র কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না।
শুনে আঁতকে উঠল সুমি। বল কী?
হ্যাঁ।
কোথায় ছিল?
তোর বাবা নিজ হাতে সব ফাঁইল করে রেখেছিলেন। মানে একটা ফাঁইলে সব গুছানো ছিল। ফাঁইলটাই পাচ্ছি না।
অমি বলল, ভাল করে খুঁজেছ?
পারু একটু রেগে গেলেন। ভাল করে মানে? এরচে’ ভাল করে আর কী খুঁজব! কোনও জায়গা বাকি রাখিনি। তাছাড়া ফাঁইলগুলো থাকে সব এক জায়গায়। আমার আলমারিতে।
সুমি গম্ভীর গলায় বলল, লাস্ট কবে ফাঁইলটা তুমি দেখেছ?
তা বলতে পারব না। আর আমি তো কখনও ওই ফাঁইল ধরিওনি। তোর বাবা রেখেছিলেন। তবে একদিন ফাঁইল খুলে দলিলপত্র আমাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
অমি বলল, কবে?
অনেকদিন আগে।
সুমি বলল, তারপর ফাঁইলটা তুমি আর দেখনি?
না।
আছে কি নেই, বোঝনি?
না।
রুমে ঢুকে ধপ করে পারুর বিছানায় বসে পড়ল অমি। এখন কী হবে?
দলিলপত্র না পেলে খুব বিপদ হবে। কাগজপত্র ছাড়া বাড়ির কোনও দাম নেই।
সুমি বলল, কিন্তু দলিলপত্র হারালে সেগুলো জোগাড়েরও নিশ্চয় কোনও ব্যবস্থা আছে।
আছে।
তাহলে এত ঘাবড়াবার দরকার কী?
কিন্তু সে সব অনেক ছুটোছুটির ব্যাপার। অনেক টাকা পয়সা খরচের ব্যাপার। আমরা ওসব কেমন করে করব? কে আছে আমাদের? কে সাহায্য করবে?
একটু থামলেন পারু। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, সংসার কীভাবে চলবে তারই ঠিক নেই, তার ওপর এই বিপদ। আমার খুব অস্থির লাগছে।
সুমি এসে পারুর সামনে দাঁড়াল। এখন অস্থির হয়ে লাভ নেই। দলিলের ফাঁইল যাবে কোথায়? নিশ্চয় বাড়িতে আছে। বেশি অস্থির হয়ে খোজাখোজি করলে অনেক সময়ই প্রয়োজনীয় জিনিসটা পাওয়া যায় না। চল, খেতে চল। খেয়েদেয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ঘুমাবে। সকালে উঠে আবার খুঁজবে। আমি এবং অমিও তোমার সঙ্গে থাকব, দেখবে ঠিক পেয়ে যাবে।
মেয়ের কথায় ভরসা পেলেন পারু। বললেন, তুই বলছিস?
হ্যাঁ।
বলেই পারুর হাত ধরল সুমি। চল।
পারু উঠে দাঁড়ালেন।
কিন্তু পরদিন সকালেও ফাঁইলটা পাওয়া গেল না। তিনজন মানুষ তন্ন। তন্ন করে পুরো বাড়ি খুঁজল, এমন কি বুয়াও খুঁজল তাদের সঙ্গে।
না, ফাঁইলটি কোথাও নেই।
শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে নিজের বিছানায় বসলেন পারু। হাহাকারের গলায় বললেন, কোন বিপদ এলো আমার সংসারে? মানুষটা চলে গেল। সংসার অচল। এই অবস্থায় হারাল বাড়ির দলিল।
সুমি অমি দুজন দাঁড়িয়ে আছে পারুর দুপাশে। তাদের অবস্থাও পারুর মতোই।
তবু মেয়ের দিকে তাকালেন পারু। সুমি, আমি তো চোখে কোনও পথ দেখছি না মা! তুই বলেছিলি দলিল নিশ্চয় পাওয়া যাবে। তোর ভরসায় রাতে ঘুমাতেও পারলাম। কিন্তু …….।
পারুর কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমি বলল, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না মা। আমাদের বাড়ি থেকে কখনও কিছু হারায়নি। এত ইম্পরটেন্ট জিনিস কী করে হারাবে?
আমি পাগল হয়ে যাব মা। আমার খুব অস্থির লাগছে। আমি আর পারছি না।
পারুর পাশে বসে দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরল সুমি। তুমি এভাবে ভেঙে পড়ো না। বস। তোমার সঙ্গে অন্যকিছু কথা আছে আমার।
তারপর অমির দিকে তাকাল সুমি। অমি, যা তোর রুমে যা। পড়তে বোস গিয়ে। আমি আর মা দেখছি কী করা যায়।
অমি চলে যাওয়ার পর দরজার সামনে দাঁড়ানো বুয়ার দিকে তাকাল সুমি। বুয়া, তুমিও যাও।
আইচ্ছা।
বুয়া চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুমি বলল, মা, বাড়ির দলিল বাবা অন্য কোথাও নিয়ে রেখে আসেনি তো?